X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মন্তাজের নিজের জমি

মাসউদ আহমাদ
২০ জুলাই ২০২১, ১১:৪৩আপডেট : ২০ জুলাই ২০২১, ১১:৪৩

উঠোনের একপাশে মন্তাজের দেহটা পড়ে আছে, চিত হয়ে। নিথর। আম-কাঁঠাল-নারকেল গাছঘেরা মস্ত বাড়ির টিনের চালের ওপর দিয়ে একটা কাক তারস্বরে ডেকে যায়। চোখের সামনে প্রায় ধপ করে পড়ে ছেলের নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ার ছবি দেখে জ্ঞানশূন্য হতে হতেও নিজেকে সামলে নেয় বুড়ো মাটা। বাড়ির মানুষ ও প্রতিবেশীরা পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে এসে জড়ো হয় উঠোনের চারপাশে। প্রথমে কিছুক্ষণ বুকফাঁটা ভঙ্গিতে কেঁদে বিরতি দেয় মন্তাজের মা। এখন সে পাথরচোখে ক্রুরদৃষ্টি নিয়ে বসে আছে। প্রতিবেশীদের কেউ আহা, লোকটা এভাবে চলে গেল; কতই বা বয়েস হয়েছিল; আরেকজন, আল্লাহর মাল আল্লাই লিয়্যাছে গো। পাশ থেকে কারো দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দও ভেসে আসে। এটুকুই। মন্তাজের দ্বিতীয় বউটার মুখ বেজায় ভার, মুখে কথা নেই, চোখে পানি নেই; ঋষির মতো বারান্দায় বসে আছে। উঠোনের পাশে ছবি কিংবা লাশ হয়ে যাওয়া মন্তাজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে; যেন কতকাল আকাশ দেখেনি।

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে মানুষ যেমন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কাঁপতে থাকে আর একসময় ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে, মন্তাজের জীবনের শেষদৃশ্যটা অনেকটা তেমন। খুব বেশি মানুষ দেখেনি। যারা দেখেছে, প্রথমে হতভম্ব হয়ে দূর থেকে দেখেছে। কাছে গিয়ে দেখার, কিংবা ওকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করেনি। খানিক পরে, মৃদুভঙ্গিতে মন্তাজের সুন্দর স্বাস্থ্যের শরীরটা মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে।

বড় কোনো অসুখের আভাস দিয়েছিল গ্রাম্যডাক্তার। কিন্তু মন্তাজের অসুখটা কী—পরিষ্কার বলতে পারেনি।

পঞ্চাশ বছর এমন কোনো বয়স নয়। মন্তাজ দিব্বি সংসারের কাজ করছে, জমির ফসল ও বাগান দেখাশোনা করছে; বিকেল হলেই সাইকেল চালিয়ে দূরের বাজারে গিয়ে তাষ খেলে, চা ও পান খেয়ে, সন্ধ্যা গাঢ় করে বাড়িতে ফিরছে। কেউ টের পায়নি, সে নিজেও উপলব্ধি করতে পারেনি, তাঁর বড় অসুখ করেছে কোনো। কড়া জ্বর ও শরীর ব্যথা, মাঝে দু-একদিন বুকব্যথা; এই। গ্রাম্যডাক্তার নাপা ও গ্যাসের ওষুধ দিলে কয়েকদিন আরামেই কেটে যায়। কয়েকদিন পর আবার। এভাবে কয়েক পর্বের চিকিৎসা চলার পর দুদিন বিছানায় পড়েও ছিল মন্তাজ। একদিন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে সে প্রমাণ করে, ওর কিছুই হয়নি।

এরপর কেটে গেছে বেশ ক’টা দিন।

কিন্তু আজ সকালে শরীর আর টিকল না মন্তাজের। মাঠের খেতে কৃষাণ লাগিয়েছে, তাদের জন্য খাবার আয়োজন করতে স্ত্রীকে বলার জন্য বাড়িতে ফিরছিল; একবার মুঠোফোনে কারও সঙ্গে কথাও হলো তাঁর, এরমধ্যেই, বাড়িতে ঢোকার মুখে অল্প সময়ের ব্যবধানে শরীর ঝিম মারতে মারতে উঠোনে পড়ে গেল। লম্বা শ্বাস নিয়ে নিস্তেজ হতে হতে একসময় দেহটা স্থির হয়ে গেল।

 

সামান্য কোনো অসুখে লোকটা মারা গেছে; এটা অনেকেরই বিশ্বাস হয় না। বিশেষ করে জিরোদা, মন্তাজের দ্বিতীয় স্ত্রী মানতেই পারে না যে, তার স্বামীর আদৌ কোনো অসুখ ছিল। তার মনে হয়, প্রকৃতির প্রতিশোধে পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই স্বামীর জীবন খোয়া গেছে। এই ভাবনা ও সন্দেহ তাকে স্বস্তি দেয় না।

মন্তাজ ছিল জিরোদার দুলাভাই। পিঠাপিঠি আপন বড়বোনের জামাই। সেই সূত্রে দুলাভাইয়ের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল। বাপের বাড়ি অন্য জেলায় হলেও দুইবোনের বিয়ে হয়েছিল একই থানার পাশাপাশি তিনটে গ্রাম পরে।

শালি-দুলাভাইয়ের রসিকতা ও হালকা প্রেম এমন কিছু মন্দ নয়। প্রাচীনকাল থেকেই এ নিয়ে রসাত্মক গল্প শোনা যায়। কিন্তু হালকা প্রেম-পর্ব অতিক্রম করে তারা সত্যিকারের প্রেমেই থিতু হয়। ততদিনে দুইবোনের ঘরে সন্তান এসেছে। সন্তান বড় হচ্ছে। শালি-দুলাভাইয়ের প্রেমটাও বাড়ছে। নিজের সংসার ফেলে ঘনঘন দুলাভাইয়ের বাড়িতে আসা-যাওয়া নিয়ে কানাঘুষাও হয়। দুজনের কেউই সেসব গ্রাহ্য করেনি। সত্যিকারের প্রেমিকরা কখনো ভয় পায় না, নিন্দায়ও থেমে যায় না। মন্তাজ ও জিরোদা দিনে দিনে হয়ে উঠেছিল তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

দুলাভাই মন্তাজ হাওলাদার দেখতে যেমন সুদর্শন, কর্মঠও। লম্বা, ফরসা ও নির্মেদ শরীর। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া কালো চুল। প্রথম স্ত্রী অসুন্দর ছিল না, তবে খাটো। জিরোদা দীর্ঘাঙ্গী। চোখগুলো সিনেমার নায়িকার মতোন। গমের দানার মতো ত্বক। আহলাদি একটা বাঁক মুখে সেঁটে থাকে। দুজনের মিল ও মহব্বত গাঢ় হতে সময় লাগেনি।

পৈতৃকসূত্রে খুব একটা ধন-সম্পদ পায়নি মন্তাজ। লেখাপড়া তাঁর সামান্যই, কিন্তু জাগতিক সাফল্য কীভাবে রপ্ত করতে হয়, সে জানতো। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও নিষ্ঠুরতার কথা লোকে জানে। বাড়ির ভিটেটুকু যার সম্বল, সেই লোক বাগান ও ফসলি জমির মালিক হয়েছে, একক চেষ্টায়। এসবের বাইরে আর একটা জিনিস ছিল তাঁর; মানুষকে কাছে টানার প্রবল ক্ষমতা। আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। এতেই ধরা পড়েছে সুন্দরী শ্যালিকা জিরোদা শবনম।

মনে পড়ে জিরোদার, একটা সময় পরে স্বামীর কাছে গেলে শরীরটা গুটিয়ে শীতল হয়ে আসতো। ঠান্ডা মেরে যেত। শরীর জাগত না। স্বামীর আদর সোহাগ পেয়ে আনন্দের বদলে বিস্বাদ অনুভূতি হতো। দুলাভাইয়ের প্রতি অনুরাগ গড়ে ওঠার শুরুর দিকে, প্রথম স্বামীর সঙ্গে মনের দূরত্ব নাকি শারীরিক অক্ষমতায় এমনটা হচ্ছিল, কখনো ভাবেনি। যেন তার ভাবার সময় নেই; জিরোদার মনের অবস্থা তখন এমনই। অথচ মন্তাজের কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালে, এমনকি দূর থেকে তাঁকে ভাবলেও সে পুলক অনুভব করত। ফুল ফোটার মতো শরীরটা পাপড়ি মেলত। সমস্ত শরীর উষ্ণ হয়ে উঠত। রক্তের ভেতরে রোমাঞ্চকর এক গতির সঞ্চার হতো। এসব কীভাবে কখন থেকে তৈরি হয়েছে, সে নিজেও জানে না; কিন্তু পুরোটা সত্যি।

তারপরই কি স্বামীর সংসার ছেড়ে প্রেমিকপুরুষ দুলাভাইয়ের বুকে ঘর তোলার স্বপ্ন বাঁধে জিরোদা? এখন সেসব মনে করতে চায় না সে। কিন্তু বাস্তবতা এমন, আগুন থেকে পালিয়ে যেতে যেতে সে টের পায়, তার সারা গায়ে আগুনের কুঁড়ি। শরীর থেকে পোশাক ও আগুন কিছুতেই আলাদা করতে পারে না।

তারপর। ততদিনে দুজনের প্রেম ও নিন্দা ঘটনা হয়ে উঠেছে, পরিবার ও পড়শির চোখে। এর কিছুদিন পর, এক রাতে নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে মন্তাজ হাওলাদার।

প্রথম বউকে কোনোভাবে সরিয়ে দিতে পারলে শালিকে বিয়ে করতে আর কোনো বাঁধা থাকে না। কিন্তু কীভাবে?

সারা রাত মন্তাজ ভাবে। ভাবে আর ভাবে। পাশে শুয়ে থাকা প্রথম স্ত্রীর ঘুমন্ত হাত ও নিশ্বাস তাঁর গায়ে এসে লাগে। ঘুমের মধ্যে বউটা একবার পাশ ফিরে মন্তাজকে জড়িয়ে ধরে। সেসবের কিছুই টেরই পায় না মন্তাজ। সে অন্যজগতে ঢুকে আছে। কীভাবে বউকে নাই করে দিয়ে শালিকে ঘরে আনা যায়; এর বাইরে তাঁর মাথায় আর কোনো কথা ও ভাবনা নেই।

গ্রামে রাত নামলে সমস্ত চরাচর নৈঃশব্দ্যে ডুবে যায়। কোথাও কোনো শব্দ নেই। সাড়া নেই। একা মন্তাজ নির্ঘুম বিছানায় শুয়ে শুয়ে এক অদৃশ্য খাতায় চিত্রনাট্যটা লিখে ফেলে; কীভাবে প্রথম বউ, শালির বড়বোনকে সরিয়ে দেবে।

ঘটনাটি ঘটে একদুপুরে। ঝলমলিয়া বাজার থেকে গরুর মাংস, দুরকম মিষ্টি ও দই নিয়ে আসে মন্তাজ। স্নান সেরে একসঙ্গে খেতে বসে। কিন্তু মুহূর্তেই পুরো গ্রামে রটে যায়, মন্তাজের বউ পেটের পীড়া ও ফুড পয়জনিংয়ে মারা গেছে। মুখে ফ্যাঁপড়া উঠেছে। মানুষ ভেঙে পড়ে মন্তাজের বাড়িতে। একমাত্র ছেলেটা কাটা মুরগির মতো তড়পাতে থাকে। মন্তাজের মা উঠোন পেরিয়ে বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। মন্তাজ জানে, আর সবার চোখ ও মনকে ফাঁকি দিলেও মাকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়।

দুপুর গড়িয়ে যায়। পুলিশ আসে ঠিকই, মন্তাজ ম্যানেজ করে নেয়।

সুখের দিন দীর্ঘ হয় না; সংসারে এই যেন নিয়তি।

ছোটবেলায় এসব কথা অনেক শুনেছে জিরোদা, কথার কথা ভেবে পাশ কাটিয়ে গেছে। কিন্তু এখন সে নিজেও বিশ্বাস করে। জীবন তাকে অনেক দিয়েছে; অবহেলা যেমন, ভালোবাসাও। মানুষ বলে, জীবন হচ্ছে অভিজ্ঞতার ছোট ছোট মালা। ছেঁড়া মালার টুকরো নিয়ে সে বসে থাকে, মালা গাঁথা হয়ে ওঠে না।

অন্যের জীবন নাশ করে কেউ কি নিজের জীবন গড়তে পারে? বড়বোনকে সাজানো সংসার থেকে সরিয়ে দুলাভাইকে বিয়ে করাটা ঠিক হয়নি; একসময় বোঝে জিরোদা। এটা সে প্রথম বুঝতে পারে, যখন বিয়ের বছর খানিক পর মন্তাজের যৌন সমস্যাটা ক্রমশ ধরা পড়ে।

মন্তাজ ভেতরে ভেতরে পুড়তে থাকে, কিন্তু কিছু বলে না। জিরোদা টের পায়, ব্যাপারটা নিয়ে স্বামী লজ্জিত। সংকুচিত।

একরাতে মন্তাজকে পাশে বসিয়ে খাওয়ায় জিরোদা। মাছের মুড়োটা তুলে দিতে গেলে না না খেতে পারব না, বললেও ধীরে ধীরে খেতে থাকে।

তোমাকে একটা কথা বলব, রাগ করবে না তো?

মন্তাজ চমকে ওঠে, অল্প করে হাসে; বলে, না না। কী কথা?

তোমার শরীরটা খারাপ?

খেতে খেতে নিজের শরীরে কোনো পোকা বা তরকারির দাগ পড়েছে, এমনভাবে তাকিয়ে মন্তাজ বলে, কই না তো।

দেখো, আমি তোমার বউ। আমাকে খুলে বলো।

আহা, কী বলছ? শরীর খারাপ হলে তোমাকে বলব না—এটা কোনো কথা হলো?

তুমি কিছু মনে করো না। আমার শ্বশুরবাড়ি এলাকায়, না, থাক—

না না, বলো। কোনো অসুবিধা নেই।

ওদের বাড়ির পেছনে যে স্কুলটা, স্কুলমাঠ; মাঠের উল্টোদিকে একজন হোমিও ডাক্তার বসে। খুব নামকরা ডাক্তার। একবার তাকে দেখাও।

না, আমার লজ্জা করবে। আমি যেতে পারব না।

স্বামীর পিঠে একবার হাত বুলিয়ে জিরোদা হাসে; এসব নিয়ে লজ্জার কিছু নেই।

মুখে আর এক লোকমা ভাত নিয়ে মন্তাজ বলে, দেখি, একটু ভাবি।

অত ভাবনার কিছু নেই, বাপু। একবার যাও। কাজ হবে।

মন্তাজ লজ্জিতভাবে হেসে মাথা কাত করে, যাব।

পরদিন বিকেলে, মন্তাজকে দেখে হোমিও ডাক্তার চশমার ওপর দিয়ে তাকান। গম্ভীর গলায় বলেন, আপনার চোখের নিচে কালি। রাতে ঘুমান না?

মন্তাজ কথা বলে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।

না ঘুমালে আপনি তো মারা যাবেন।

মন্তাজ তবু কথা বলে না। স্ত্রীর আগের পক্ষের শ্বশুরবাড়ি এলাকায় এসেছেন, কেউ কি দেখে ফেলল? এটা ভেবে নাকি নিজের অসুখ নিয়ে সে বিব্রত; বোঝা যায় না।

কী হলো?

মন্তাজ চমকে বাস্তবে ফিরে আসে।

না বাবা, আপনাকে কোনো ওষুধ দেওয়া যাবে না। মারা গেলে শেষে আমাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে।

মন্তাজ একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বলে, আপনি আমাকে মেরে ফেলবেন কী? আমি নিজেই নিজেকে মেরে বসে আছি।

হোমিও ডাক্তার মঈন শেখ তাকায় না, কথা বলে না। মুখটা বিস্বাদ করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। তাঁকে চিন্তিত দেখায়।

মন্তাজ স্বাভাবিক হতে খানিক সময় নেয়। একসময় কথা বলে ওঠে—জিরোদাকে বিয়ের অল্প কিছুদিন পরেই টের পাই, আমি আর আগের মতো নেই।

সেটা কী রকম?

বিয়ের কিছুদিন পরেই, এক রাতে আমি নিজেকে নপুংসুক হিসেবে আবিষ্কার করি।

আপনার কথা বোঝা যায় না। পরিষ্কার করে বলুন।

আমি এখন আর স্ত্রী-সঙ্গমে সক্ষম নই। অক্ষম পুরুষের চেয়েও খারাপ অবস্থা। আমার পৌরুষ জাগে না। শিশ্ন উত্থিত হয় না। কামানুভূতি তৈরি হয়, কিন্তু শরীর জাগে না। আমি ছটফট করি। আমার অস্থির লাগে। বিচলিত হই। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে পারি না।

এটা নিয়ে আপনার স্ত্রী কিছু বলে না?

না। নীরবে চোখের জল ফেলে। মুখে সে কিছুই বলে না।

ফালতু বয়ান রাখুন, মন্তাজ সাহেব।

মন্তাজ ভড়কে যায়। মাথা নামিয়ে রাখে।

আপনি খুব চালু জিনিস। আরো বেশি বেশি ওই জিনিস করবেন বলেই তো নিজের বিয়ে করা প্রথম বউকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছেন। পরে শালিকে ভাগিয়ে বিয়ে করেছেন। করেছেন না?

সংসারে জোর যার মুল্লুক তার; হাজার বছর ধরে পৃথিবী তো এই নিয়মেই চলে আসছে। আমার সামান্য ইচ্ছে পূরণের ঘটনাটা অপরাধ নয় কোনো। আর তাছাড়া আমি তো জিরোদাকে ভালোবাসি। সেও আমাকে। আমার কাছে এটাই সবচেয়ে বড় যুক্তি ও সান্ত্বনা।

...কথাগুলো নিজের মনেই ভাবে মন্তাজ। ডাক্তারকে বলতে গিয়েও বলে না।

কী হলো, চুপ করে আছেন যে?

মন্তাজ কথা বলে না। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে থাকে। একবার মাথা তোলে। আবার নামিয়ে নেয়।

কয়েক মুহূর্ত নীরবে কেটে যায়।

হোমিও ডাক্তার মঈন শেখ দুধরনের ওষুধ দেন। একটা শিশিতে ছোট ছোট বড়ি। আরেকটায় সিরাপের মতো তরল। বললেন, আধা গ্লাস পানিতে দুচামচ ওষুধ নেবেন। ভালো করে মেশাবেন। একঢোক খেয়ে বাকিটা ফেলে দেবেন। রোজ সকালে, একবার। আর বড়িটা রাতে শোবার আগে সাতটা করে।

বাড়িতে ফেরার জন্য ভ্যান খোঁজে মন্তাজ। অপেক্ষা করতে হয় না। একটা খালি ভ্যান এগিয়ে এলে সে উঠে বসে। মেশিন লাগানো ভ্যান ঝড়ের বেগে চলতে থাকে। এ সময় হঠাৎই সে অনুভব করে, প্রকৃতিরও একধরনের প্রতিশোধ আছে। মানুষের গড়ে তোলা জেল ভেঙে তবু পালানো সম্ভব, প্রকৃতির ঘেরাটোপ থেকে পালানো যায় না।

রাতে ঘুমানোর সময় জিরোদাকে সব জানায়। স্ত্রী কিছু বলে না। গম্ভীর মুখে ঘরের চাতালের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আম-কাঁঠাল-নারকেল গাছঘেরা বাড়ির মস্ত ভিটে, পেয়ারাবাগান ও আবাদি জমি মিলিয়ে সম্পত্তি কম নয় মন্তাজের। কিন্তু কিছুই সে সঙ্গে নিতে পারল না। বাড়ির পেছনে অবহেলায় পড়ে থাকা অনাবাদি জমির একপাশে অল্প একটু জায়গায় তাঁকে কবর দিয়ে ফিরছে প্রতিবেশী ও গ্রামের মানুষেরা।

কিছুক্ষণ চারপাশে নীরবতার সাইরেন বয়ে যায়। কারো মুখে কথা নেই। মন্তাজের বন্ধুস্থানীয় একজন বড় করে শ্বাস ফেলে কেবল বলল, এত জমিজমা কোনো কাজে লাগল না। সাড়ে তিনহাত মাটিতেই সে ঠিকানা করে নিল।

বুড়ো এক লোক এগিয়ে আসে। মন্তাজের বন্ধুর মুখে নিরাবেগ চোখে তাকায়—ওটাই ওর নিজের জমি। স্থায়ী। আর সব শূন্য ও আলগা। অকেজো।

মন্তাজের বন্ধু-লোকটা কী বুঝলো কে জানে, মুখে দুঃখী ভাব ফুটিয়ে চোখদুটো রসালো করে ফেলল।

মন্তাজের অকালে চলে যাওয়ায় স্বজন ও পড়শিরা ব্যথিত। কষ্টও পেয়েছে। কিন্তু কোথাও একটা ফাঁক আছে। মৃতদেহ দেখে অনেকে কাঁদল, কিন্তু চোখে জল নেই। এমনকি মন্তাজের মা, সন্তান হারিয়ে দুঃখ পেয়েছেন সত্যি, দুঃখটা যেন আংশিক। তিনি বিব্রত ও ব্যথিত, কিন্তু ভেঙে পড়েননি। বুক ভেঙে যায়নি। তাঁকে শোকে কাতরও হতে দেখেনি কেউ।

কেন?

অনেকেই জানে। হয়তো কেউ জানে না।

শোক ও সমাগম একসময় ফুরিয়ে আসে। দিনে দিনে মানুষ ভুলেও যায় মন্তাজের কথা। মন্তাজ নামের কেউ এ তল্লাটে ছিল কখনো, সেই স্মৃতিও কারো কারো ঝাপসা হয়ে আসে।

স্বামী গত হওয়ার পর, একা ও অসহায় হয়ে ওঠে জিরোদার সময়। বাড়িটা হয়ে ওঠে ভুতুড়ে। রাতবিরেতে টুক করে কোনো শব্দ হলেই বুক কেঁপে ওঠে। কাঁচা ঘুম ভেঙে চোখ কচলে বিছানায় বসে। বুঝতে পারে, ওটা বাতাসের শব্দ। হয়তো নারকেল গাছের অকালমৃত কুঁড়ি খসে পড়েছে।

বিছানার চারপাশ খুঁজে মুঠোফোনটা হাতে নেয়। ভুলে যাওয়া নম্বরটি স্মৃতি হাতড়ে বের করে। একটা কাঙ্ক্ষিত নম্বরে ডায়াল করে। রিং বাজতে থাকে। তার বুকে তোলপাড় হয়।

ফোনের ওপাশে বিব্রত ও বিরক্ত কণ্ঠ; কে আপনি? এত রাতে?

জিরোদা থতমত খায়। ব্যথিত গলায় বলে, বীথি সোনা, আমি তোমার মা।

কে বীথি? এখানে এই নামে কেউ থাকে না। কখনো ছিল না। আপনি অযথা ফোন করে সময় ও পয়সা খরচ করবেন না। বেয়াদব মহিলা।

ফোনের লাইনটা কেটে যায়।

তীব্র শীতের রাতে, পুকুরের বরফশীতল পানি গায়ে ঢেলে দিলে যেমন হয়, জিরোদা ভয় ও লজ্জায় সেভাবে কাঁপতে থাকে। তার মুখ শুকিয়ে আসে। অসহায় অনূভূতি জাপ্টে ধরে। বুকভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

আজকাল বাবা-মা, ভাই-বোনেরাও জিরোদাকে এড়িয়ে চলে। ফোন করলেও সাড়া দেয় না। শাশুড়ি কথা বলে না। প্রতিবেশীরা খোঁজ নেয় না। প্রথম ঘরে ফেলে আসা মেয়েটির জন্য বুকটা কেমন করে। নিজেরই তো রক্ত। সেও মুখের ওপর পাথরচাপা দিতে পারল?

 

সংযোগ ছুটে যাওয়া মুঠোফোন হাতে নিয়ে বিছানায় স্ট্যাচুর মতো বসে থাকে জিরোদা শবনম।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ