X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

থিয়েটার

কাজী সাইফুল ইসলাম
২০ জুলাই ২০২১, ১২:১৬আপডেট : ২০ জুলাই ২০২১, ১২:১৬

আমি যখন বাসা থেকে বের হই তখন সকাল ৭টা। আমি দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার পাশে একটি অটো ধরব বলে। ফাল্গুনের শেষ। বহুদিন বৃষ্টি নেই। গুমোট, ময়লা প্রকৃতি। সবুজ পাতায় জমে থাকা ধুলো রাতের কুয়াশায় ভিজে এমন ভাবে লেপটে আছে—ক্লাস টু তে পড়ার সময় কলাপাতায় বরইয়ের আচারের শেষটুকু যেভাবে থাকত। আমি একটি অটো ধরে এলাম চৌরাস্তা। আমি কোথায় যাব—, তা এখনও ঠিক করিনি। আমার এ যাত্রা অনেকটাই উদ্দেশ্যহীন, এবং একা।

কদিন ধরে আমার ভিষণ মন খারাপ—পালাবার জন্য ব্যাকুল। থিয়েটারের কাজটা ছেড়ে দিয়ে খুবই একা হয়ে গেছি। থিয়েটারে থাকারও কোনো উপায় ছিল না। থিয়েটারে আমাকে মেয়ে সেজে অভিনয় ও নাচ করতে হতো। তাতে আমার কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু বিপদ হলো অন্য কারণে।

চৌরাস্তা থেকে কাওরাকান্দি যাবার বাসে চড়ে বসলাম। জানালার কাছে একটি সিট পেলাম। সকালের রোদ এসে আমার শরীরে জড়িয়ে আছে শীতের চাদরের মতো। জানালায় চোখ রেখে বাইরে তাকিয়ে আছি, আমার হাতে—দ্য ট্রাভেলস অব মার্কো পোলো, বইটি। ম্যানুয়েল কোমরু সম্পাদনা করেছে বইটি।

একটু পরে বইটিতে মন দেই। মার্কো পোলো গিয়েছিল বেথেলহেম শহরে। পূর্বদেশ থেকে তিনজন জ্ঞানী লোক এসেছিল বেথেলহেমে। তখন রাজা হেরোদের রাজত্বকাল। তারা রাজা হেরোদকে বলেছিল—আমরা আকাশের একটি নক্ষত্র লক্ষ করে এখানে এসেছি, ইহুদিদের রাজার জন্ম হয়েছে। রাজা বলেছিল—তোমরা তার সন্ধান পেলে আমাকে খবর জানাবে। আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাতে যাব।

কিন্তু সেই জ্ঞানীদের কাছে স্বপ্নযোগে বার্তা এসেছিল—তোমরা রাজাকে জন্ম নেওয়া শিশুটির খবর জানাবে না। রাজা শিশুটিকে (মুসলমানদের ঈসা আ. আর খ্রিষ্টানদের কাছে—ইসা) মেরে ফেলবে। রাজা হেরোদের ভয়ে বেথেলহেম থেকে সেদিনই ইসা মসিকে নিয়ে মা মরিয়ম পালিয়ে চলে এসেছিলেন মিশরে।

আমি ছিলাম থিয়েটার কর্মী, আমার মুখে ধর্মের কথা সত্যিই বেমানান। কিন্তু থিয়েটার করতে গিয়ে অনেক কিছুই শিখেছিলাম। উচ্চমার্গের বই পড়তে হয়েছিল। একবার আমাকে বেশ্যার অভিনয় করতে হয়েছিল—তখন আমাকে পড়তে হয়েছিল, ভারতের জমিদারদের উপপত্নী, লেডি অফ দ্যা টাউন, কি করে ফিরিঙ্গি বাজারে বেশ্যালয় হলো আরও কত কি!

আবার নারী চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে শিখেছিলাম—কত কষ্ট করে নারীরা নিজেদের মানিয়ে নিয়ে চলে শ্বশুর বাড়িতে। মাকে দেখতাম—বুড়ো বয়সেও বাবার বাড়িতে যাবার জন্য কেমন উন্মুখ হয়ে থাকত। মনে হতো ওটাই তার আসল বাড়ি। অথচ, সারা জীবন পরের বাড়িতে নারীদের কাটিয়ে দিতে হয়।

নারীদের সাথে খারাপ আচরণ করো না কখনোই। নারী সেজে দেখো একবার, কত কষ্ট করে সারা জীবন পরের বাড়িটাকে আপনার বানিয়ে বসত করে তারা!

মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। বহু বছর মায়ের সোনামুখটি দেখা হয়নি। তার মৃত্যুতে আরও ছন্নছাড়া জীবন হয়েছে আমার। আমার বড় ভাই তার বৌ নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল মায়ের মৃত্যুর পরপরই। অথচ তার বিয়ের আগে তিনি আমাকে খুবই আদর করতেন। আচ্ছা, বিয়ে করলেই মানুষ কেন বদলে যেতে থাকে? না কি সবই শয়তানের খেলা? ভ্রান্ত পথে নিয়ে গিয়ে দোজখবাসী করতে চায়। বেহেস্ত থেকে বের হবার সময় ইবলিশ আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে এনেছিল—আল্লাহ প্রিয় আদম সন্তানকে সে ভ্রান্ত পথে নিয়ে যাবে। মানুষ হয়তো ইবলিশের চক্রান্তেই পড়ে আছে।

স্পিডবোটে পদ্মা পার হয়ে একটি এসি বাসে চড়ে বসলাম। সিটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে দিতেই গাড়ি চলতে শুরু করে—ক্লান্ত আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঠিক ঘুম নয়, তন্দ্রা। আমি দেখতে পাই, বাদল নামের একটি ছেলের সুন্দর পবিত্র হাসি। তখন আমি কেবল থিয়েটারে ঢুকেছি। আমার চেহারা ভালো ছিল, গায়ের রঙ ছিল ফর্সা, বয়স সতেরো পার করেছিল কেবল। আমার বুকের দুটি কৃত্রিম স্তন বক্ষবন্ধনীতে আটকে দিয়ে আমাকে একটি ঘাগরা পরাবার পর, আমাদের পরিচালক অনেকক্ষণ আমার বুকের দিকে তাকিয়ে বলেছিল—উহু, বোঝার কোনো উপায় নাই, তোকে দিয়েই হবে। এই সমির, ফোম দিয়ে ওর পাছা আরও একটু ভারী করে আমাকে দেখাও।

কথা শেষ করে পাশের সেটে চলে যায় পরিচালক দিপু ভাই। সমির আমার নিতম্ব আরও একটু ভারী করে—, যতটা ভারী করলে পুরুষের কাম জাগে।

সাজগোজ শেষ করে আমি যখন নাচ করার জন্য প্রস্তুত হতাম, তখন আমার নিজের প্রেমে নিজেই পড়েছিলাম। বাদল ছিল আমার প্রথম প্রেমিক। আমি ছেলে হয়েও ছেলে প্রেমিকের কোনো অভাব ছিল না আমার। তখন খুব হাসি পেত, মেয়েরা এসে আমার হাত ধরত। আমার বন্ধু হতে চাইত। আমি একবার ইচ্ছে করেই একটি মেয়ের সাথে আলিঙ্গন করেছিলাম।

সে সব দুষ্টমি যে জীবনে এত বড় কষ্টের কারণ হবে তা ভাবিনি কোনো দিন। থিয়েটার করতে ভালো লাগত, তাই দিনরাত থিয়েটার নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। মানুষ যখন আমার অভিনয়ের প্রশংসা করত, তখন ভাবতাম এক সময় আর এসব মেয়ে সেজে আর কাজ করতে হবে না। কোনো নায়কের চরিত্র নিয়ে অভিনয় করব।

কিন্তু হঠাৎ করেই নায়কের চরিত্র পাওয়া যায় না। তাছাড়া দলে মেয়েরা কম ছিল, তাই আমাকে কিছুতেই ছাড়তে চায়নি দলের পরিচালক।

বছর চারেক আগেকার কথা। সিরাজগঞ্জ গিয়েছিলাম থিয়েটার করতে। তিন দিনের শো। দুদিন পরই আমাদের এক রকম পালিয়ে আসতে হয়েছিল। শো শেষ করে আমরা রুমের দিকে যাচ্ছিলাম। তখনও আমাদের গায়ে থিয়েটার কস্টিউমস। কতগুলো বদমাইস ছেলে এসে রানু বু আর আমাকে তুলে নিয়ে গেল। ওরা বারবার রানু বু’র পাছায় থাপ্পড় মেরেছিল, আর যখন জানলো আমি ছেলে—তখন খুব করে পেটাল আমাকে। আমাদের উদ্ধার করেছিল পুলিশ গিয়ে। এ ঘটনা শুনে হাসতে হাসতে মরে সবাই। কিন্তু কষ্টে, অপমানে আমি শুধুই কেঁদেছিলাম। এক টানা সাত দিন পরে আমি রুম থেকে বেরিয়েছিলাম। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়! কেউ একজন বলেছিল— শালার পাছা মেরে দে! পুলিশ না এলে হয়তো ওরা ওটাই করত।

তারপর ভেবেছিলাম থিয়েটার আর নয়। অন্তত নারী চরিত্রে আর করব না। ছেলেদের চরিত্র পেলে করব। পরিচালক আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখত। সে আমাকে ছেলের রোল দিলো। কিন্তু সবাই হইচই করে উঠত, সীমাকে দেখার জন্য। আমারই থিয়েটার নাম ছিল—সীমা!

কয়েকটি শো করার পর আমাদের খরচের টাকাই ওঠে না। একই হয়তো বলে ভাগ্য। অল্প বয়সী সুন্দরী একটি মেয়ের অভাবে আমাদের থিয়েটার বন্ধ হতে চলেছে। অনেক খোঁজ করা হলো কিন্তু পাওয়া গেল না। দলে এতগুলো মানুষ, সবার মধ্যে হাহাকার। কে কি করবে? কোথায় যাবে? কি খাবে?

থিয়েটারে এসে ধীরে ধীরে জানলাম—যারা থিয়েটার করে তাদের নাম হয় ঠিকই, মানুষ তাদের ভালোবাসে, বড় মনে করে। কিন্তু তাদের কষ্টের শেষ নেই। শেষজীবনে এক রকম না খেয়ে মরতে হয়। যখন তারা এ সত্য উপলব্ধি করে তখন আর বেরোবার সময় থাকে না। কারণ অন্য কোনো কাজ তাদের জানা থাকে না। তাদের মনটাও এমন নরম হয় যে বাইরের কোনো কাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

শেষ পর্যন্ত আমি আবার সীমা হলাম। সবাই বলল, একটি মেয়ে পেলেই আমাকে ছেলের চরিত্রে ফিরিয়ে আনা হবে। এতগুলো মানুষের দুর্দশা দেখে আমি ভাবলাম থাকি না ছদ্মবেশে, কি এমন ক্ষতি। এতগুলো মানুষের মুখে যদি ভাত জোটে।

ঢাকায় নেমে নিজেকে অসহায় লাগছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে একা হয়ে যাবার কষ্ট। আমার বড় বোন রওশনারা আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছে, শুধু মেয়ে সেজে থিয়েটার করি বলে। অথচ মা মরে যাবার পর সে-ই ছিল আমার একমাত্র আশ্রয়। বড়ভাবি লোকের কাছে বলে বেড়ায়— আমি না কি হিজড়া।

এ থিয়েটারের জন্য সবকিছুই হারাতে হয়েছে আমার, সামাজিক মর্যাদা পর্যন্ত। অথচ আজ সে থিয়েটারই আমাকে ছাড়তে হলো। বুকের ভেতর যে রক্তের নদী আছে তা আমি টের পাচ্ছি। এ রক্তের নদীটি দীর্ঘ-দীর্ঘ পথ চলে এসে সব রঙ হারিয়ে, যখন পানির রঙে সাজে তখন সে দুচোখে ঝরে পড়ে।

একটি আবাসিক হোটেলে এসে পাঁচ ঘণ্টার জন্য রুম নিলাম। সন্ধ্যার পরপরই বের হব আমি। হোটেলের ওয়াশ রুমে ঢুকে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে, নিচে নেমে এলাম দুপুরের খাবার খাব। আমার প্রিয় গরুর মাংস আর পাতলা ডাল-সরষে ভর্তাও ছিল।

খাওয়ার পরপরই দুচোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। ঘুম একটি সিগারেট টানার সময় দিচ্ছে না। তাড়াহুড়ো করে দুটি টান মেরেই বিছানায় লেপটে গেলাম যেন বহুকাল ঘুমাইনি। আবার যেন তাও নয়—আকাশের সবচেয়ে দূরের নক্ষত্রটির সাথে কথা বলে বলে পার হয়ে গেছে কোটি বছর। দুচোখের পাতায় একটু ঝিম লাগতেই ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে কটকটে রোদ। গোটা ঢাকা শহরটা ভেসে যাচ্ছে সূর্যতাপের প্রখরতায়। অদ্ভুত উদাস দুপুর—ঘরবন্দি পাখির মতো ছটফট করতে থাকি!

আজকের দুপুরটাকে মনে হতে থাকে কারবালা আর মৃদু বয়ে চলা ফোরাত নদীর অসমাপ্ত কান্নার মতো। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিষ্ঠুরতা (এত হত্যা, স্রোতের মতো বয়ে যাওয়া রক্ত, নক্ষত্রের ঘুমভাঙ্গা আর্তনাদ! তৃষ্ণা) দেখতে হয়েছিল।

দুপুর এত বিরহ ডাকে কেন? এত বিরহকে সহ্য করতে পারে! অন্তরের গভীরে বসে থেকে কাঁদায়!

একটি সুন্দরী মেয়ে খুঁজতে থাকে গোটা থিয়েটারের সবাই মিলে। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল—কিন্তু মোটেও অভিনয় জানে না। নাচ হয় না কিছুই। শুধু দেহতে মাংসের তুফান তুলতে পারে। তাতে যৌনতা হয়, কিন্তু শিল্পের কিছু থাকে না। একটি শোতে কাজ করার পর কাজল আর কাজ করতে পারেনি। পরে শুনেছিলাম শিমুল যাত্রাদলের মেয়ে ছিল। নাম কাজল। পরিচয় গোপন করে থিয়েটারে এসেছে।

থিয়েটারে কাজ করতে হলে অভিনয়টা ভালো জানতে হয়। রুমে বসে একটির পর একটি সিগারেট টেনে যাচ্ছি আর ঘড়িতে সময় দেখছি। আমার সাথে কোনো মোবাইল ফোন নেই। আসলে মোবাইলটা বন্ধ করে ঘরেই রেখে এসেছি। ওটা আজকাল অপ্রয়োজনীয় যন্ত্র হয়ে উঠেছে আমার কাছে। তাছাড়া কেউ আমাকে ফোন করবে না। কে খোঁজ নেবে আমার। কেউ তো নেই। যারা ছিল একে একে চলে গেছে সব। মা বেঁচে থাকলে জীবন কি আর এমন হতো? কত দিন আদর পাইনি। স্নেহ, ভালোবাসা ভুলতেই বসেছি। কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি, বা ভালোবেসে কেউ বলেনি—আমি তোমাকে ভালোবাসি।

সারা জীবন মেয়ে সেজে রইলাম। পুরুষরা এসেছে ভালোবাসতে! আমার প্রেমে পড়ে কেউ কেউ সিগারেট ধরেছে, কেউ গঞ্জিকা সেবন করেছে, কেউ আবার বাঙলা মদ খেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করেছে।

বছর খানেক আগের কথা। সিলেট গিয়েছিলাম দশ দিনের জন্য। সেখানে এক ছেলে এমন প্রেমে পড়ল, আমার কাছে পাত্তা না পেয়ে একদিন সন্ধ্যায় মদ খেয়ে এসে চিৎকার করে বলতে থাকে, আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না সীমা!

অনেকেই হাসত, কিন্তু আমার বুকের ভেতর বয়ে যেত রক্তের নদী। এ কি পাপ নয়? মিথ্যে সেজে আর কত! ছেলেরা প্রেমে পড়ছে মিথ্যে এক নারীর। প্রথম-প্রথম মিথ্যে নারী সেজে অভিনয় করে আনন্দ পেতাম। ক্রমশ নিজেকে ছোট মনে হতো। মন খারাপ হতো। সবকিছু ঝেড়ে মুছে নিজেকে আবার থিয়েটারের মঞ্চে নিয়ে দাঁড় করাতাম। আমার অভিনয় আর নাচ দেখে মানুষ মুগ্ধ হতো। আমার অভিনয় দেখে পরিচালক দিপু ভাই শিশুর মতো শব্দ করে কেঁদে উঠেছিল একদিন। তারপর কান্না জড়ানো কণ্ঠে সে বলেছিল—তুই যদি মেয়ে হতি রে, আকাশ ছুঁতি—আকাশ।

আমি মেয়ে নই, এ কষ্টেই তার বুক ফেটে যাচ্ছিল।

সে মঞ্চেই লিয়াকতের সাথে দেখা হলো আমার। খুবই ভদ্র ছেলে, একটি ফুল আমাকে দিয়ে চলে গিয়েছিল। ওর চোখে ছিল ভালোবাসার পরাগ আর বিনয়ের হাসি। সেরাতে আমি ঘুমুতে পারিনি অসহ্য যন্ত্রণায়। নিজেকে মেয়ে মনে হতে থাকে। আমার হরমোন বুঝি পরিবর্তন হচ্ছে ধীরে ধীরে।

হোটেল থেকে বেরিয়ে রাত ৮টার দিকে ফকিরাপুল এসে বান্দরবানের বাস ধরে উঠে বসলাম। নন এসি, কিন্তু সিটগুলো দারুণ। বাস ছাড়ার ফাঁকে দুকাপ লাল চা আর দুটি সিগারেট টেনে নিলাম। আজকাল সিগারেট একটু বেশি টানতে হচ্ছে। কেন, কে জানে!

গাড়ি চলছে। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গান বাজছে—বারে বারে কে যেন ডাকে আমারে/ কার ছোঁয়া লাগে যেন মনোবীণা তারে/ কি যেন সে খুঁজে মরে আকাশের পারে...

লিয়াকত প্রায় প্রতিদিনই দেখা করতে আসে আমার সাথে। ওর হাতে কখনও থাকে ফুল, কখনও থাকে নানা রকম খাবার, আবার কখনও থাকত আমার জন্য নানা রকম গিফ্ট। এ সব কিছুই আমার জানা ছিল না। আমি অবশ্য পরে জেনেছিলাম, খাবার থিয়েটারের সবাই মিলে খেয়ে মজা করত। গিফ্ট নিয়ে যেত মেয়েরা। ওরা বলত—সুজন তো ছেলে। এ মেয়েদের ড্রেস দিয়ে কি করবে!

কথাও ঠিক। তারা লিয়াকতকে নিয়ে মজা করত। কিন্তু এ মজা যে এতটা কষ্ট টেনে নিয়ে আসবে তা বুঝতে পারেনি কেউ। শুধু লিয়াকত কেন, আমাকে মেয়ে ভেবে যে সব ছেলেরা এসেছে, তাদের অনেকের সাথেই মজা করত থিয়েটারের লোকেরা।

লিয়াকতের বাবা ধনী, তাই সে টাকা খরচ করতে থাকে থিয়েটারের অন্য সবার জন্য। আমার সাথে ওর দেখা হতো প্রায় প্রতিদিনই। কথা হতো কম। আমি মেয়েলি কণ্ঠে কথা বলার চেষ্টা করতাম, পাছে ধরা পড়ে না যাই। তাহলে তো থিয়েটারের বারোটা বাজবে।

গাড়ি কুমিল্লা এসে যাত্রা বিরতি দিল ত্রিশ মিনিটের জন্য। সবাই খেতে চলে গেছে। আমি একটি সিগারেট টানছি। মনটা বিষণ্ন হয়ে আছে শ্রাবণ- আকাশের মতো। এত মেঘ কোথা থেকে এলো!

শুনেছি গাছেদের ভেজা নিশ্বাস না কি মেঘ হয়ে যায় আকাশে, তাই আবার ঝরে পড়ে মাটিতে! আর মানুষের ভেজা নিশ্বাস কষ্ট হয়ে জমে থাকে অন্তরে—যা এক সময় ঝরে পড়ে অশ্রু হয়ে।

গাড়ি যখন বান্দরবান শেষ স্টেশনে থামল, তখন ফজরের আজান হচ্ছে। মুয়াজ্জিন ডাকছে—হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ (নামাজের জন্য এসো, কল্যাণের জন্য এসো)..., আজ যেন আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম। এত সুন্দর আহ্বান অথচ নামাজ পড়াই হয়নি। আমি দাঁড়িয়ে আছি মসজিদের সামনে, মনটা অনুশোচনায় ভরে আছে। ব্যাগ হাতে নিয়ে অজুখানায় গিয়ে অজু করলাম। পাহাড়ি উপত্যকায় মসজিদটি বেশ সুন্দর।

ফজরের নামাজ শেষ করে রাস্তায় এসে দাঁড়াই। চারিদিকে উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা। মসজিদের সামনেই বান্দরবান বাসস্ট্যান্ড। সকাল হলেই এখানে মানুষের ভিড় বাড়ে। একটু সামনেই কয়েকটি হোটেল, রেস্টুরেন্ট। আমি উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি করছি। কোথায় যাব, কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে এ-টুকু বুঝতে পারছি, এখানে দল বেঁধে আসতে হয়। খোলা জিপ (চাঁন্দের গাড়ি) এখানকার বাহন। একা গেলেও যে ভাড়া লাগে, আবার দশজন গেলে ওই একই ভাড়া। সামান্য কিছু কম বেশি।

একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পেটভরে পাহাড়ি কলা আর কেক খেয়ে নিলাম। খাবার আবার কখন কপালে জোটে কে জানে। পাশেই একটি টি-স্টল। চা শেষ কেবল সিগারেট জ্বালাব—এরই মধ্যে একটি চাঁন্দের গাড়ি এসে থামে দোকানের সামনে। ড্রাইভার ডাকছে—একজন লাগবে, একজন…

সিগারেট ফেলে প্রায় দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়লাম। আঁকাবাঁকা-উঁচুনিচু পথে গাড়ি চলতে থাকে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে। শহরটুকু ছাড়তে সময় লাগে না। এর পরই শুরু হলো পাহাড়ি পথ।

তখনও সূর্য খোলস মুক্ত হয়নি। আঁধো আলো-অন্ধকারে ছুটছে গাড়ি। বেশ কিছু দূর আসার পর আমি একজনকে জিগ্যেস করলাম—ভাই আমরা কোথায় যাচ্ছি?

লোকটি আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে— থানচি।

আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস হলো না আমার। কিন্তু বুকের ভেতর কয়েকটি প্রশ্ন বারবার উঁকি মারতে থাকে। কতক্ষণ লাগবে? সেখান থেকে কোথায় যাওয়া যাবে? সেখান থেকে ফিরব কি করে? সেখানে থাকার জন্য কোনো আবাসিক হোটেল আছে কি না?

একটু পরই সব প্রশ্ন হারিয়ে গেল আমার বুক থেকে। প্রচণ্ড রকম বাতাস, পাহাড় বেয়ে গাড়ি এত উপরে উঠছে যে মেঘ ছুঁয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। সূর্য উঠতে দেখতে পেলাম, পাহাড়ি উপত্যকায় জমে আছে মেঘ, সাদা মেঘ। একেবারেই খাড়া পাহাড়, বাতাসের শব্দ সাথে নিয়ে ছুটছে গাড়ি। মাঝে মাঝে ভয়ে পিলে চমকে যাচ্ছে—এই বুঝি গাড়ি একেবারে নিচে পড়ে যাবে।

গাড়ি এসে থামে একটি আর্মি চেকপোস্টে। চেকপোস্ট পার হতেই চোখে পড়ে একটি নদী, এ যেন অলৌকিক কোনো জলের ধারা—আসমানি কিতাবে যে রকম বর্ণনা থাকে। প্রথমে মনে হয়েছে আকাশের সফেদ মেঘ। চারদিকে খাড়া পাহাড়, পাহাড় আড়াল করে সূর্যের আলো, মেঘ আর কুয়াশা জড়িয়ে আছে নদীটাকে। চির শান্ত, ধ্যানমগ্ন, উদার; অবারিত। গোলপাতা, শাল আর বাঁশ বন নদীর পাড় ধরে এমন ভাবে উঠে এসেছে পাহাড়গুলোতে যেন পিকাসোর আঁকা বিখ্যাত কোনো পেন্টিং।

এত জীবন্ত, মনোমুগ্ধকর, স্নিগ্ধ, আবেদনময়ী প্রকৃতি এ প্রথম দেখলাম আমি। এখানে প্রতিদিনই বসন্ত! হলুদ আর ছাইরঙ পাখিরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ি উপত্যকায়। পাহাড়ি কলা, পেঁপে, আতা আর বেতফল নিয়ে রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে উপজাতি মেয়েরা। ওদের পরনে থাকে স্কার্ট আর টপস্। গাড়ি থামিয়ে টুরিস্টরা কিনে নেয় ওদের পাহাড়ি ফল।

কেউ কেউ আবার মুরগি আর হরিলয়াল পাখি বিক্রি করে। থানচি আসতে আমাদের তিন ঘণ্টা লেগেছিল গাড়িতে। গোটা পথই ছিল অদ্ভুত রোমাঞ্চকর। প্রকৃতি এক পাহাড়ের সাথে অন্য পাহাড় এমনভাবে জোড়া লাগিয়ে রেখেছে যেন মানুষের জন্য রাস্তা তৈরি করে রেখেছে।

সবুজ পাহাড় বেয়ে সূর্যের আলো নিচে নেমে আসে, অনেকটা কুয়াশার মতো তৈরি হয়। দেখা যায় গাছেরা মাটি থেকে পানি সংগ্রহ করে কিভাবে তার আকাশে ছড়িয়ে দেয়, আর রোদে তা বাস্প করে নিয়ে মেঘে রূপান্তর করে।

থানচি এসে আমাকে রেখে ওরা চলে গেল। আমি আবার একা। কিছুই ভাবছি না। মাথা পুরোপুরি ফাঁকা করে বসে আছি বাঙালি এক রেস্টুরেন্টে। গরম সিঙ্গাড়া আর চা খেয়ে একটি সিগারেট হাতে নিয়ে গোটা বাজারটা ঘুরে দেখছি। একটি বটগাছ আছে বাজারের মধ্যে। এখানে উপজাতি আর বাঙালিদের দোকান রয়েছে।

এখানে যে বহুদূর থেকে লোকজন আসে বাজার করতে তা বোঝা গেল। কিন্তু কত দূর? তা বুঝেছিলাম দুদিন পরে। থানচি গোটা অঞ্চলের কেন্দ্র। পাশেই বিজিবি ক্যাম্প। ক্যাম্পটি সাঙ্গু নদীর তীরে। গোটা থানচি বাজারটাই সাঙ্গু নদীর তীরে। কি করব কিছু বুঝতে পারছি না। বিজিবি ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে দেখলাম—সাঙ্গু নদী পাড়ে কাঠের শক্ত সামপান ভেড়ানো। সামপানগুলো চলছে স্পিডবোটের ইঞ্জিন নিয়ে। এ সাঙ্গু নদী ধরেই দূরে চলে যায় পর্যটক আর পাহাড়িরা।

কি করব ভাবছি। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম শান্ত নিরিবিলি একটি জায়গায়। একেবারেই সাঙ্গু নদীর পাড়ে। এখানে বেশ লম্বা একটি সিঁড়ি, এ সিঁড়ি বেয়েই নেমে যায় সাঙ্গু নদীতে। সিঁড়ির মুখেই একটি সরাইখানা। এখানেই উপজাতিরা বিশ্রাম নেয়। চারদিকে বাঁশের বেড়া, বেড়ার ফাঁক-ফোঁকর খুঁজে অবিরাম বাতাসের খেলা চলে। এখানে কারেন্ট নেই, নেই কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক।

সরাইখানা দেখে মনে হলো যেন সেলজুক সাম্রাজ্যের পথে হেঁটে ক্লান্ত কোনো তুর্কী যোদ্ধার গোপন বিশ্রামাগার। কোনো চেয়ার নেই। চাঁদের মতো গোল একটি টেবিল, যতটুকু উঁচু হলে কাঠের মেঝেতে বসে খাওয়া যায়। ওখানে বসে এক কাপ চা খেলাম। আমার পাশেই বসে আছে একটি মারমা মেয়ে আর একটি ছেলে। মেয়েটি দেখতে সুন্দরী। বারবার আমাকে দেখছে। ওরা ভালো বাংলা বলতে পারে।

কথায় কথায় জানা হলো ওরা স্বামী-স্ত্রী। ওদের সামপানে আমাকে নিয়ে যেতে পারবে রেমাক্কি পর্যন্ত। ওদের ঘরেই থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। এখান থেকে যারাই দুর্গম এলাকায় যাবে, তাদের থাকতে হবে মারমা বা খিয়াংদের ঘরে, এছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। কিন্তু ওদের সাথে গেলে আমাকে পালিয়ে যেতে হবে। বিজিবির হাতে ধরা খেয়ে অনেক রকম সমস্যা হতে পারে। এখানে নাম-ধাম এন্ট্রি করতে হবে, সাথে গাইড নেবার নিয়ম আছে। এটা নিরাপত্তার জন্যও।

আমার আর ওদের সাথে যাওয়া হলো না। আমি নিজেই সাহস করলাম না। সরাইখানা থেকে বেরিয়ে এসে মনমরা হয়ে থানচি বাজারে ঘুরছি। এরই মধ্যে একটি দল আমার চোখে পড়ল, তারা ফর্ম পূরণ করছে। আমি কাছে গিয়ে বল্লাম—ভাই আমি একা, আপনাদের গ্রুপের সাথে নিতে পারেন।

আপনি কোথায় যাবেন? আমাকে প্রশ্ন করে ওদের মধ্যে একজন।

বললাম—জানি না। আপনারা যেখানে যাবেন সেখানেই যাব।

একটু হেসে তারা আমাকে বলল—আমাদের একজনই কম হচ্ছে। আমরা ন’ জন। আপনি হলে আমাদের দশজন হয়। দু’টি বোট নিতে হবে।

আমাদের নাম, বাড়ির ঠিকানা ও বাড়ির একটি ফোন নাম্বার, ন্যাশনাল আইডিসহ কাজগপত্র খুবই দ্রুত করে নিতে থাকে গাইড। তারপর থানচি থানায় (পাশের পাহাড়ের ওপর) গিয়ে পুলিশ আমাদের সবার ছবি তুলে সব রিপোর্ট রেখে বিদায় দিলো। বর্ডার গার্ড থেকে বিদায় নিয়ে আমরা নৌকায় উঠে পড়লাম।

অদ্ভুত এ অভিজ্ঞতা। নৌকাটা দেড় ফুট চওড়া, কিন্তু লম্বা। মোটা কাঠ, যেন পাথরের ধাক্কা খেয়ে ফেটে না যায়। সাঙ্গু নদী হচ্ছে পাথুরে নদী। শুকনো মৌসুমে পানি থাকে মাত্র এক ফুট থেকে দুফুট। নৌকার পিছনে একটি লোহার লম্বা হাতল, তাতেই ইঞ্জিনের পাখা লাগানো। নৌকা ঠেলে নিয়ে যাবার জন্য শক্তিশালী স্পিড বোটের ইঞ্জিন। প্রচণ্ড রকম শব্দ করে চলছে বোট। দুপাশে উঁচু পাথরের পাহাড়। নদীর তলায় পাথর। পাহাড়ের গায়ে কোটি বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নাম না জানা হরেক রকমের গাছ।

এখানে কোনো নেটওয়ার্ক নেই, পাহাড়ি এ নদীতে চলছি—আমরা যেন কোনো আদিম সময়ের হাত ধরে হাঁটছি। সবচেয়ে আসল কথা হলো এটি হচ্ছে পাহাড়ি লোকদের পথ। অন্য কোনো পথ নেই। বোট চলছে, দানবের মত পাহাড় আর পুরনো সব গাছ, যেন দানবের নখ বা প্রাচীন গ্রিক দেবতাদের বসবাসের জায়গা।

মনে পড়ছে লিয়াকতের কথা। লিয়াকত কোনো দিনই বুঝতে পারেনি, আমি ছেলে। ওর পাগলামি, বিষণ্নতা, ভালোবাসার উন্মাদনা দেখে এক সময় থিয়েটারের সবাই ওকে বোঝাতে চেষ্টা করাতে থাকে—আমি সীমা নই, আমার নাম সুজন। আমি মেয়ে সেজে অভিনয় করি।

কিন্তু কিছুতেই কারো কথা বিশ্বাস করতে চায় না লিয়াকত, সে বলত—ও ছেলে হলেও আমি ওকে বিয়ে করব। আপনারা বুঝতেছেন না, ওকে ছাড়া আমি বাঁচি না।

ওর চোখে পানি ঝরত সরু ঝরনার মতো। ওকে দেখে আমি নিজেও খুব কষ্টে পড়ে গেলাম। কোনো মেয়ের সাথে আমার প্রেম হয়নি সত্যি, কিন্তু আমার জন্য কারো এত ভালোবাসা—সে ভালোবাসার ঢেউ আমাকে প্লাবিত করে দিচ্ছিল প্রতিমুহূর্তে। আমার চোখের পানি শেষ হতো না। শো-তে খুবই কষ্ট করে মুখে হাসি ধরে রাখতে হত। কান্নার রোল হলে এমনভাবে কাঁদতাম, আমার সাথে দর্শকরাও কাঁদত। তখন আমার (সীমার) সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এবার সিনেমায় ডাক আসে। নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করতে হবে।

টানা চার ঘণ্টা বোট চলার পর আমরা চলে এলাম রেমাক্কি। এবার নৌকা ছেড়ে দিলাম। হাঁটার পালা। রেমাক্কি বাজারে বসে আমরা কলা, রুটি, কেক আর চা খেয়ে সিগারেট ধরালাম। এর মধ্যে ওদের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছে। ওদের মধ্যে ছ’জন ডাক্তার, আরিফ নামে একটি ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। আর দুজন অন্য একটি ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছে। ওদের মধ্যে একজন নিপু পাহাড়ি মদ খেয়ে নিলো কয়েক ঢোক। এখানে মদ মুদি দোকানে পাওয়া যায়।

রেমাক্কি ছোট একটি নগরের মতো, প্রাচীন নগর সভ্যতার মতো এখানকার জীবন। চারদিকেই উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় মানুষের বসতি। বিজিবির ক্যাম্প, দোকানপাট। আমি ভেবেছিলাম এ পর্যন্তই আমাদের শেষ গন্তব্য। কারণ তার পর কোনো যানবাহন নেই। যেখানেই যাব হেঁটে যেতে হবে।

রেমাক্কিতে সামান্য কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, পাথরের পাহাড়ি পথে! এবার ঠিকঠিক হাজার বছর পিছনে ফিরে গেলাম। একটি ইংরেজি ছবি দেখেছিলাম—আদিম মানুষদের নিয়ে। আমার মনে হতে থাকল আমি সেই মুভিটির ভিতরে আছি।

আমার কলম কি করে এ পথের বিবরণ দেবে, তা বুঝতে পারছি না। এই সৌন্দর্য, প্রকৃতি, সূর্যের আলো আর গাছের ছায়া, ভয়ংকর, রোমাঞ্চকর অবস্থার কোনোভাবেই বিবরণ দেওয়া যায় না। দুপাশে আকাশচুম্বি পাথরের পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে জড়ানো সবুজ বন। আমাদের পথ সেই দুপাহাড়ের উপত্যকা, ঠিক উপত্যকাও নয়—অনেকটা নদীর মতো। তবে পানি নেই। নীচে বিশাল বিশাল পাথর। এক একটি পাথর যেন এক একটি কালো-সাদা মেঘের চাকা। এ পাথর বেয়ে, আবার পাথরের ফাঁকে সরু পথ বেয়ে হাঁটতে থাকি আমরা। সামনে গাইড ইমন। একটি মানুষও নেই। গা ছমছম করছে, মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে পাখি। লম্বা কালো লেজের পাখিরা বসে থাকে নীরবে।

মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছি পানির স্রোতে, ঝরনার পানি এসে ভেসে যাচ্ছে। ওটাকে ওরা ঝিরি বলে। সেই সব ঝিরি থেকে পানি খেয়ে আবার হাঁটতে থাকি আমরা। এভাবে সাড়ে তিন ঘণ্টা এসে যখন নাফাখুম এসে দাঁড়ালাম তখন সন্ধ্যা। খুমের’র বিশাল জলরাশি আর উঁচু পাহাড় দেখে বিহ্বলতায় ঘিরে রাখল আমাদের অনেকক্ষণ। এদিকে নিজের ব্যাগ কখনো মাথায় আবার কখনো হাতে নিচ্ছি, ক্লান্ত শরীর।

সেখান থেকে পানি খেয়ে, সিগারেট টেনে দেখলাম সূর্য পশ্চিম আকাশের একেবারেই শেষের দিকে। অজু করে একটি পাথরের উপর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে নিলাম। কবলামুখী হয় আমার সাথে সিজদা করে একটি পাখি। ভাবলাম, এ রাতে কোথায় যাব আমরা? এ দুগর্ম পথ! এখানে থাকবই-বা কোথায়? হঠাৎ চোখে পড়ল—পাহাড়ের ওপর কয়েকটি বাঁশের তৈরি ঘর, দোকান। উপজাতিদের একজন এসে জানাল ইচ্ছে করলে এখানে তোমরা থাকতে পারো। কিছুটা অবাক হয়েছিলাম, কিভাবে?

পরে অবশ্য জেনেছিলাম এ সব অঞ্চলে যারাই ঘুরতে আসুক, তাদের থাকতে হবে এ সব উপজাতিদের ঘরেই। একটি বড় রুমের মধ্যে ঢালাই বিছানায় আট, নয় বা দশ জন। মশারি নেই, বিছানার চাদর নেই, নামে মাত্র বালিশ।

নাফাখুম থেকে আমরা হাঁটতে থাকলাম। তখন আকাশে চাঁদ উঠেছে। শুনেছি পাহাড়ে মানুষ খুন হতো আগে। আমরা যেখানে এসেছি এখানে যদি খুন করে কেউ আমাদের দেহ রোদে শুকাতে দেয়, কেউ টেরও পাবে না।

হঠাৎ শুনতে পেলাম একটি পাখির ডাকের শব্দ আর টর্চের আলো। গাইড ওর ছোট্ট স্পিকারে গান বাজাতে থাকলো ফুল ভলিউমে। ভয়ে আমাদের বুকের ভেতর দুরুদুরু করছে। যা ভেবেছিলাম তাই সামনে কয়েকজন পাহাড়ি অস্ত্রধারী।

শেষের দিকে খুবই পাগলামি করতে থাকে লিয়াকত। আমাকে না দেখে সে থাকতে চায় না। ইচ্ছামতো টাকা খরচ করে, আর অনেকেই আমার সাথে দেখা করিয়ে দেবার নাম করে ওর কাছ থেকে টাকা নিত। কি করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। আর বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে আলোচনাও করা যাচ্ছিল না।

এ যেন রোমান গ্লাডিয়েটরের মতো। গ্লাডিয়েটরদের খেলতে হতো বাঘ বা সিংহের সাথে। হয় বাঁচো, না নয় হিংস্র পশুটাকে মারো। রোমানরা খুব মজা করে সে খেলা দেখত, আর উল্লাস করত।

রাতের সৌন্দর্য আর ভয় নিয়ে আমরা আবারও হাঁটলাম প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা। আমরা গিয়ে উঠলাম পাহাড়ের চূড়ায় একটি গ্রামে। গ্রামের নাম- থুইচা পাড়া। পাহাড়ের উপর প্রায় দশটি ঘর, তিনটি মুদি দোকান নিয়ে এ পাড়া। পাশেই আরও উঁচু পাহাড়ে বিজিবি ক্যাম্প। ওটা জিন্না পাড়া। এখানে এসে দম ছাড়লাম আমরা। একটি কাজুবাদাম গাছের নিচে বাঁশের মাচাং করা, সেখানে গিয়ে বসলাম। শরীরের প্রতিটি কোষ যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে।

এখানে পানির ব্যবস্থা দেখে খুব ভালো লাগল, কয়েল পাইপ দিয়ে পানি আনা হয়েছে ঝরনা থেকে। অনবরত পানি আসছে। ঠান্ডা প্রকৃতির পানি। এ পানিতেই ওদের নাওয়া-খাওয়া সব চলে।

সেরাতে গোসল করে ঘুমুতে গেলাম আমরা। রাতের খাবার হলো জুম চালের ভাত, পাহাড়ি মুরগির মাংস আর আলুভর্তা। ও রান্না মুখে তোলার মতো নয়। কিন্তু আমরা খেলাম, আগ্রহ নিয়েই খেতে হলো। সেদিন আর রাত জাগল না কেউ। কাঠের দোতলা ঘর। আমি শুয়েছি একেবারেই বেড়ার কাছে।

রাত বাড়ছে। গাঢ় নীরবতা আমাদের গ্রাস করছে, অদ্ভুত গাঢ় নীরবতা। রাতজাগা পাখিরা ডাকছে সহসা।

লিয়াকতের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল এক সন্ধ্যায়। আমি সীমা সেজেছিলাম। তারপর আমি এক এক করে আমার শরীরের সব পোশাক খুলতে থাকি ওর সামনেই। তাতেও ওর বিশ্বাস করছে না লিয়াকত। এক সময় আমি আমার গায়ের সবটুকু পোশাক খুলে দিলাম, আর লিয়াকত আমার নগ্ন শরীর দেখে শিশুর মতো চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ওর কান্নায় জড়িয়ে ছিল মায়া আর ভালোবাসা। স্বপ্ন ভেঙে যাবার কষ্ট। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। ওর কান্না দেখে আমিও যেন কখন কাঁদতে থাকি। অনেকক্ষণ পর বুঝতে পেরেছিলাম আমার শরীর সম্পূর্ণ অনাবৃত। চোখের পানিতে আমার বুক ভেসে যাচ্ছে। মেঝেতে গড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে লিয়াকত।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ