X
মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
২৯ বৈশাখ ১৪৩২

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনও উদ্যোগই কাজে আসেনি

শফিকুল ইসলাম
২৪ জুলাই ২০২১, ০৯:০০আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২১, ০৯:০০

সদ্যবিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরেও বোরোর বাম্পার ফলন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় এ পর্যন্ত বোরো ধানের সংগ্রহ পরিস্থিতিও সন্তোষজনক। করোনা মহামারির মধ্যেও ধান ও চালের সরবরাহ স্বাভাবিক। চাহিদা মিটিয়ে এখনও ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত। তারপরও ৪৮ টাকার কমে বাজারে কোনও চাল নেই। এমন পরিস্থিতিতে আবার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত। চালের মুল্য ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে মনিটরিং কমিটি করা হয়েছে। সাত অতিরিক্ত সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া দেওয়া হয়েছে।  বাজারে ধান ও চালের দর ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের নেওয়া এসব উদ্যোগ কোনও কাজে আসেনি। চালের বাজার অনিয়ন্ত্রিতই রয়েছে।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিলার ও ব্যবসায়ীদের কঠিন যোগসাজশ ও কারসাজিতে বাজারে বেড়েছে চালের দাম। সরকারের খাদ্যমন্ত্রী নিজে সরাসরি গণমাধ্যমে একাধিকবার এই অভিযোগ করেছেন। অভিযুক্ত মিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। কারসাজি করা মিলারদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। এ ধরনের হুমকিও তিনি দিয়েছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই কারসাজির অভিযোগে কোনও মিলার বা চাতাল মালিকের লাইসেন্স বাতিল হয়েছে বা কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বা কাউকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে-  এ ধরনের কোনও সংবাদ পাওয়া যায়নি।

দেশে চালের উৎপাদন, সরবরাহ, আমদানি ও মজুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার পরও বাড়ছে চালের দাম। কারণে অকারণেই সুযোগ পেয়েই চালের দাম বাড়িয়ে অনৈতিক মুনাফা করছেন চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। কোনওভাবেই চালের বাজারের এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। আমদানি করা হলেও চালের বাজার স্থিতিশীল করা যায়নি। আগামীতে চাল নিয়ে যাতে কোনও প্রকার বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয় সেজন্যই সরকার আবারও চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এদিকে বিদ্যমান করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আগামী আমন ও পরে আউশ মৌসুমে বিশেষ করে ধান উৎপাদন ও প্রণোদনা বিতরণসহ সার্বিক কৃষি কার্যক্রম সমন্বয় ও তদারকির জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৭ জন অতিরিক্ত সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি করাই হয়েছে, আমন ও আউশ উৎপাদনে যাতে চালের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন কোনও পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়।

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের নির্দেশে কৃষি উৎপাদন আরও বেগবান করতেই এসব সিনিয়র কর্মকর্তাদেরকে মাঠ পর্যায়ে তদারকি ও সমন্বয়ের এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক অতিরিক্ত সচিবকে ২টি করে সারা দেশের মোট ১৪টি কৃষি অঞ্চলের কার্যক্রম সমন্বয় ও তদারকির দায়িত্ব দিয়ে গত ৬ জুলাই কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে- দায়িত্বপ্রাপ্ত সাত কর্মকর্তা হলেন- পরিকল্পনা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রৌফ চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি অঞ্চল, গবেষণা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কমলা রঞ্জন দাস রাজশাহী ও বগুড়া অঞ্চল, সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাহবুবুল ইসলাম দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চল, সম্প্রসারণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাসানুজ্জামান কল্লোল সিলেট ও কুমিল্লাহ অঞ্চল, এছাড়া যশোর ও খুলনা অঞ্চলের দায়িত্বে বীজ বিভাগের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) বলাই কৃষ্ণ হাজরা, ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের দায়িত্বে পিপিসি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব রুহুল আমিন তালুকদার এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের দায়িত্বে প্রশাসন বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ওয়াহিদা আক্তার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম সব অঞ্চলের সার্বিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করবেন। সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকবেন অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল।

অপরদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চলতি বছরের শুরুতেই কারসাজির মাধ্যমে কেউ যাতে চালের মূল্য বাড়াতে না পারে সেজন্য বিশেষ মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ সংক্রান্ত  নির্দেশনায় বলা হয়েছে- ধানের দামের সঙ্গে চালের দামের সামঞ্জস্য রাখতে হবে। কোনোভাবেই যেন মিল মালিক এবং ব্যবসায়ীরা বাড়তি সুবিধা না নিতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানিয়েছেন, ভোক্তারা যাতে সহনীয় দামে চাল কিনে খেতে পারেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে। চালের বাজার অস্থির করতে কেউ যদি কারসাজির চেষ্টা করে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তিনি কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পাওয়া বিষয়টিও নিশ্চিত করার কথা বলেছেন।  

জানা গেছে, চালের দাম সহনীয় করতে খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং খাদ্য অধিদফতরের নেতৃত্বে আলাদা বাজার মনিটরিং টিম গঠন করা হয়। কৃষি বিপনন অধিদফতর চালের দরও নির্ধারণ করে দিয়েছিলো। নির্ধারণ করে দেওয়া দরের অতিরিক্ত দামে কেউ চাল বিক্রি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও তা কার্যকর করা যায়নি। চালসহ খাদ্যশস্যের বাজার মূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রবণতা রোধ, নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে সহায়তা এবং বাজার দর স্থিতিশীল রাখা, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার স্বার্থে খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং খাদ্য অধিদফতরের অধীনে মোট ৭টি বাজার মনিটরিং টিম গঠন করা হয়।

এর মধ্যে চালের বাজার দরে ঊর্ধ্বগতি প্রবণতা রোধে ঢাকা মহানগরের বড় বড় পাইকারি বাজার সরেজমিন তদারকির জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৪টি এবং খাদ্য অধিদফতরের অধীনে ৩টি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়। এসব কমিটিকে বাজার দর সংগ্রহ করে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতরে প্রতিবেদন দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কমিটি ঢাকা মহানগরের বড় বড় পাইকারি বাজার সরেজমিন তদারকি করে বাজার দর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন দাখিল, বাজার পরিদর্শনে দিনের বাজার দর ও আগের দুই দিনের বাজার দর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত এবং বাজারে চাল ও আটার বিক্রয়মূল্য ও ক্রয়মূল্যের তথ্য সংগ্রহ করবে। বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা কমিটিগুলো প্রতিদিন বাজার মনিটরিং করবে। কিন্তু বাজারে এসব মনিটরিং কমিটির কোনও হদিস পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, এরও আগে গত ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর চালের মূল্য সহনীয় রাখতে একটি কন্ট্রোল রুম এবং বিশেষ মনিটরিং টিম গঠন করেছিল সরকার। যা বর্তমানেও খোলা রয়েছে। বাজার পরিস্থিতি নিয়ে যে কেউ উল্লিখিত কন্ট্রোলরুমে অভিযোগ জানানোর সুযোগ রয়েছে।

মিলাররা চালের বাজারের এই অস্থিরতার জন্য ধানের মূল্য বৃদ্ধিকে দায়ি করলেও মুলত ভারত থেকে চাল আমদানির সংবাদ পাওয়া মাত্র এবং আমদানি করা চালের শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্তে  কমতে শুরু করে ধানের দাম। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে বাজারে কমতে থাকে ধানের দাম। এ বছরের জানুয়ারিতেও বাজারে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজির বস্তা) ধানের দাম কমেছে ১৫০-২০০ টাকা। কিন্ত কমেনি চালের দাম। ২ হাজার একশ ৮০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া গুটি স্বর্ণা ধান এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকার নিচে। বিআর-৫১ ধান ২ হাজার ৩০০ টাকা থেকে নেমে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ১০০ টাকায়। আর সুমন স্বর্ণা ধান ২ হাজার ৩৫০ থেকে নেমে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ১৫০ টাকা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জয়পুরহাটের কৃষক হেমায়েত উদ্দিন জানিয়েছেন, ধানের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন মিল মালিকরা। তারা ইচ্ছামতো ধানের দাম নির্ধারণ করেন, বাধ্য হয়ে তাদের নির্ধারিত দামেই ধান বিক্রি করতে হয়।

মাঠ পর্যায়ে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার গোবিন্দপুরের কৃষকরা জানিয়েছেন, মিলাররাই কারসাজি করে ধান কেনা কমিয়ে দিয়ে কৃষকদের উপর দায় চাপাচ্ছেন। অনেক মিলার আড়তদারদের জানিয়ে দিয়েছেন, তারা আগে যেখানে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ গাড়ি ধান কিনতেন, এখন সেখানে এক থেকে দুই গাড়ি ধান কিনবেন। বিভিন্ন অজুহাতে তারা ধান কেনা কমিয়ে দেন। অথচ দায়ী করেন কৃষকদের।

জয়পুরহাটের মিলার লায়েক আলী জানিয়েছেন, কৃষকের ধান বেশি দামের আশায় রেখে দেওয়ার কারণে আমাদের বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছে বিধায় চালের দাম বেশি। এর জন্য মিলার নয়, কৃষকরা দায়ী।

/এফএএন/
সম্পর্কিত
মানহীন চালে বাজার সয়লাব
ভারত থেকে আরও ৫০ হাজার টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত
আমদানি বন্ধের খবরে বেড়ে গেছে চালের দাম
সর্বশেষ খবর
থাইল্যান্ডে গেছেন মির্জা ফখরুল
থাইল্যান্ডে গেছেন মির্জা ফখরুল
লিবিয়ায় নিরাপত্তা সংকট: প্রবাসী বাংলাদেশিদের সতর্ক থাকার নির্দেশ
লিবিয়ায় নিরাপত্তা সংকট: প্রবাসী বাংলাদেশিদের সতর্ক থাকার নির্দেশ
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আমরণ অনশনে শিক্ষার্থীরা
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আমরণ অনশনে শিক্ষার্থীরা
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনকে ঘিরে বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের প্রতিবাদে ১১০ নাগরিকের বিবৃতি
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনকে ঘিরে বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের প্রতিবাদে ১১০ নাগরিকের বিবৃতি
সর্বাধিক পঠিত
পররাষ্ট্র সচিবের অফিসার্স ক্লাবের সদস্য পদ স্থগিত
পররাষ্ট্র সচিবের অফিসার্স ক্লাবের সদস্য পদ স্থগিত
আসন্ন বাজেটে নতুন কী থাকছে
আসন্ন বাজেটে নতুন কী থাকছে
রংপুরের হাসপাতাল নেপাল ও ভুটানের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে: প্রধান উপদেষ্টা
রংপুরের হাসপাতাল নেপাল ও ভুটানের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে: প্রধান উপদেষ্টা
আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতার আত্মসমর্পণ
আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতার আত্মসমর্পণ
একাত্তরে গণহত্যায় সহযোগিতায় অভিযুক্তদের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যার আহ্বান এনসিপি’র
একাত্তরে গণহত্যায় সহযোগিতায় অভিযুক্তদের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যার আহ্বান এনসিপি’র