X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

ডা. ঈশিতার আকাশচুম্বী সাফল্য, ডিগ্রি, পুরস্কার ও খ্যাতি সবই ভুয়া

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
০১ আগস্ট ২০২১, ১৮:৫৫আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২১, ২০:০৬

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদ, ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন অ্যাওয়ার্ড, বছরের সেরা নারী বিজ্ঞানী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ভারতের টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড, থাইল্যান্ডের আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড রিসার্চার অ্যাওয়ার্ডসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন বলে প্রচার করতেন চিকিৎসক ইশরাত রফিক ঈশিতা (৩৪)। কিন্তু এর সবই ভুয়া। তিনি কোনও পুরস্কার অর্জন করেননি। সব সনদ নিজেই তৈরি করেছেন। মূলত প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ ও খ্যাতি অর্জনের জন্যই এসব করেছেন তিনি।

রবিবার (১ আগস্ট) বিকালে রাজধানীর কাওরান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য  জানান। এর আগে রবিবার সকালে মিরপুর থেকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চিকিৎসক ইশরাত রফিক ঈশিতা ও তার সহযোগী শহিদুল ইসলাম দিদারকে গ্রেফতার করে র‌্যাব ৪।

ডা. ঈশিতার আকাশচুম্বী সাফল্য, ডিগ্রি, পুরস্কার ও খ্যাতি সবই ভুয়া

ঈশিতা পেশায় চিকিৎসক। তিনি ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ২০১৩ সালে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। এরপর একটি সরকারি হাসপাতালে চুক্তি ভিত্তিতে কাজ করেন। তবে ৪ মাস পর অনৈতিক কাজ করার অভিযোগে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

র‍্যাবের মুখপাত্র আল মঈন বলেন, মূলত উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকেই ঈশিতা প্রতারণা শুরু করে। করোনাকালে তিনি বিভিন্ন চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। র‍্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ঈশিতাকে গ্রেফতার করা হয় বলেও জানান তিনি।

উদ্ধারকৃত ইউনিফর্ম

ঈশিতা নিজেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক, বিশিষ্ট আলোচক, ডিপ্লোম্যাট, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পিএইচডি হোল্ডারসহ বিভিন্ন পরিচয় দিতেন। আসলে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়া চিকিৎসা শাস্ত্রে তার উচ্চতর কোনও ডিগ্রি নেই। কিন্তু নামের পাশে চিকিৎসা শাস্ত্রের সব উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ট্যাগ বসিয়ে নিয়েছেন নিজেই।

মিরপুর-১ থেকে গ্রেফতারের পর তার বাসা থেকে ভুয়া আইডি কার্ড, ভুয়া ভিজিটিং কার্ড, ভুয়া সিল, ভুয়া সনদ, ভুয়া প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, ইয়াবা, বিদেশি মদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদের দুটি ইউনিফর্ম, র‌্যাংক ব্যাচ উদ্ধার করে র‌্যাব।

কী প্রতারণা করতেন ঈশিতা

গ্রেফতারকৃত ঈশিতা টকশো আলোচক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক, পিএইচডিধারী, মানবাধিকার কর্মী, সংগঠক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন বলে ভুয়া পরিচয় দিতেন। এসব পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভুয়া সনদও তৈরি করেছেন।

ডা. ঈশিতার আকাশচুম্বী সাফল্য, ডিগ্রি, পুরস্কার ও খ্যাতি সবই ভুয়া

চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে নিজেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে প্রচার করেন। কখনও নিজেকে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ হিসেবেও প্রচার করেন। এছাড়াও নিজেকে চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে পরিচয় দেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে  কোনও উচ্চতর ডিগ্রি না থাকলেও তিনি নিজেকে এমপিএইচ, এমডি, ডিও ইত্যাদি ডিগ্রিধারী হিসেবে পরিচয় দিতেন।

ক্যানসার বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন মতবাদ প্রচার করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও জার্নালে চিকিৎসা শাস্ত্রে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, আর্টিকেল, থিসিস পেপার প্রকাশনা করেছেন বলেও দাবি করতেন তিনি। নিজের ভুয়া সাফল্য স্বীকৃতির প্রচারণায় দেশের গণমাধ্যম সুকৌশলে ব্যবহার করতেন।

২০২০ সালে তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশে হোটেল পার্ক অ্যাসেন্টে অনুষ্ঠিত জিআইএসআর ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন অ্যাওয়ার্ড (আইআইডব্লিউ ২০২০) পেয়েছেন বলে প্রচার করেন, যা ৩৫ বছর বয়সী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে ‘বছরের সেরা নারী বিজ্ঞানী’ পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ভারতের ‘টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড ২০২০’, থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে অংশ নিয়ে ‘আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড’ ইত্যাদি পেয়েছেন বলেও দাবি তার। তবে এসবই ভুয়া।  এসব অনুষ্ঠানের ছবি এডিট করে নিজের ছবি বসিয়ে দিতেন তিনি।

ডা. ঈশিতার আকাশচুম্বী সাফল্য, ডিগ্রি, পুরস্কার ও খ্যাতি সবই ভুয়া

র‌্যাব জানায়, তিনি প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া নথি উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে জার্মানিতে ‘লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে’ অংশ নেন। পরে প্রচারণা চালান যে তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তবে ওই অনুষ্ঠানে তিনি কোনও পুরস্কার পাননি। তিনি সেখানে গিয়ে ছবি তুলেছেন। ঈশিতা বিশ্বের ৬০/৬৫টি দেশ ভ্রমণ করেছেন বলে দাবি করেন। তবে তিনি শুধু জার্মানিতে গিয়েছিলেন।

অ্যাম্বাসেডর হিসেবে আমেরিকান সেক্সুয়াল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল সার্ভিকাল ক্যানসার কোয়ালিশনে কাজ করছেন বলেও দাবি করতেন ঈশিতা। তবে এগুলোর সবই ভুয়া।

ডা. ঈশিতার আকাশচুম্বী সাফল্য, ডিগ্রি, পুরস্কার ও খ্যাতি সবই ভুয়া

কেন এমন ভুয়া অর্জন প্রচার করতেন ঈশিতা

গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা করোনা মহামারিকে পুঁজি করে ভার্চুয়াল জগতে প্রতারণায় সক্রিয় ছিলেন। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচক ও প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি অনলাইনে করোনা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন ও সার্টিফিকেট প্রদান করে প্রচার-প্রচারণা করেছেন। মূলত খ্যাতি ও অর্থ আত্মসাতের জন্য এসব করতেন তিনি।

গড়ে তুলেছিলেন আন্তর্জাতিক সংগঠন:

গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা ‘ইয়াং ওয়ার্ল্ড লিডারস ফর হিউম্যানিটি’ নামে একটি অনিবন্ধনকৃত ও অননুমোদিত সংগঠন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যার ফেসবুক পেজ ও লিংকইন আইডি রয়েছে। সংস্থাটির সদর দফতর নিউ ইয়র্কে অবস্থিত বলে প্রচারণা করা হয়েছে। বর্ণিত ফেসবুক পেজের কো-অ্যাডমিন গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা। এই ফেসবুক পেজের মাধ্যমে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতারণা নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বুরুন্ডি, আমেরিকা, নাইজেরিয়া, ওমান, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশে অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও উক্ত দেশগুলোতে এই সংগঠনের ব্যানারে সেমিনার, অ্যাওয়ার্ড প্রদান ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি আয়োজন করা হয়ে থাকে। যেখানে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ভুয়া অ্যাওয়ার্ড বিতরণের বিনিময়ে অর্জিত অর্থের সিংহভাগ গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা ও তার প্রধান সহযোগী গ্রহণ করে থাকেন বলে জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে বুরুন্ডি ও আফগানিস্তানে এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া সংগঠনের ব্যানারে গত এপ্রিল ২০১৯-এ রাজধানীর একটি অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ৩০ জন বাংলাদেশিকেও ‘ইয়াং ওয়ার্ল্ড লিডার্স ফর হিউম্যানিটি’ সম্মাননা জানানো হয়। ওই অনুষ্ঠানে ইশরাত রফিক ঈশিতা সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন।

৪০০ ডলারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদ

গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা প্রতারণার কৌশল হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর র‌্যাংক ব্যাজ ও পদ অর্জনের চেষ্টা চালান। তিনি ফিলিপাইনে পরিচালিত একটি ওয়েবসাইট থেকে ৪০০ ডলারের বিনিময়ে সামরিক বাহিনীর ন্যায় ‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল’ পদটি নেন বলে জানান। তবে এই সংগঠনের কোনও অস্তিত্ব পায়নি র‌্যাব। এছাড়াও তিনি ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন ইত্যাদি সদস্য পদের ভুয়া সনদ তৈরি করে প্রচারণা চালিয়ে থাকেন।

ডা. ঈশিতার আকাশচুম্বী সাফল্য, ডিগ্রি, পুরস্কার ও খ্যাতি সবই ভুয়া

প্রধান সহযোগী দিদার

বিভিন্ন স্থানে পরিচয় প্রদানের ক্ষেত্রে বাধা এড়াতে ‘বস’ হিসেবে গ্রেফতারকৃত শহিদুল ইসলাম দিদার ভূমিকা রাখতেন। তিনি টেলিফোন/অনলাইনে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সশরীরে উপস্থিত হয়ে গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতার পরিচয় বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করতেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনলাইনে তিনি এ ভূমিকা পালন করতেন।

দিদার ২০১২ সালে একটি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা (ইঞ্জিনিয়ার) সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমাও সম্পন্ন করেন। বর্তমানে একটি গার্মেন্ট কারখানায় কমার্শিয়াল ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। তারা দুজনই বিভিন্ন সংস্থার ভুয়া সদস্য, কর্ণধার বা দূত হিসেবে দেশে/বিদেশে প্রতারণা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অপরাধ কার্যক্রমে যুক্ত। তাদের আরও বেশ কয়েকজন সহযোগীর তথ্য পেয়েছে র‌্যাব।

/এআরআর/এমআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (৪ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৪ জুলাই, ২০২৫)
হাসপাতালের বারান্দায় দুই প্রসূতির সন্তান প্রসব, এক নবজাতকের মৃত্যু
হাসপাতালের বারান্দায় দুই প্রসূতির সন্তান প্রসব, এক নবজাতকের মৃত্যু
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীসা কারখানায় অভিযান, তিন চীনা নাগরিকসহ ৬ জনকে কারাদণ্ড
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীসা কারখানায় অভিযান, তিন চীনা নাগরিকসহ ৬ জনকে কারাদণ্ড
পাবনায় দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে যুবক গ্রেফতার
পাবনায় দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে যুবক গ্রেফতার
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
বাংলাদেশের মেয়েদের সামনে রয়েছে বিশ্বকাপে খেলার হাতছানিও!
বাংলাদেশের মেয়েদের সামনে রয়েছে বিশ্বকাপে খেলার হাতছানিও!