X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ধারাবাহিক—তিন

ক্লিশিতে শান্ত দিন ।। হেনরি মিলার

ভাষান্তর : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়  
১৪ আগস্ট ২০২১, ১৫:৩৯আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২১, ১৫:৪১

পূর্বপ্রকাশের পর

একটা ইউরিনালের সামনে রাস্তায় যখন আমরা আলাদা হয়ে গেলাম তখন ডিনারের সময় হয়ে গেছে। ওর সাথে পুনর্সাক্ষাতের নির্দিষ্ট কোনও দিন আমি স্থির করিনি, ওর ঠিকানাও জানতে চাইনি। না বললেও এটা বোঝা যায় যে ওকে পেতে হলে কাফেতেই পাওয়া যাবে। ঠিক যখন আমরা একে অপরকে ছেড়ে যাচ্ছি তখনই হঠাৎ আমার মনে এল যে আমি তো ওর নামটাও জিগ্যেস করিনি। পেছন থেকে ওকে ডাকলাম আর ওর নাম জিগ্যেস করলাম। পুরো নাম নয়, শুধু নামটুকু। ‘‘এন – ওয়াই – এস,’’ ও বলল, একেবারে বানান করে। ‘‘নিস শহরের মতো।’’ বারবার নামটা নিজেকে বলতে বলতে আমি হাঁটতে থাকলাম। কোনও মেয়ের এরকম নাম আমি কখনও শুনিনি। শুনে মনে হয় একটা দামি পাথরের নাম।  
ক্লিশিতে পৌঁছে বুঝতে পারলাম আমি ভয়াবহ ক্ষুধার্ত। ক্লিশি অ্যাভেন্যুতে একটা মাছের রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে দোকানের বাইরে টাঙানো মেনুগুলো দেখছিলাম। মনে হল ক্ল্যাম, লবস্টার, অয়স্টার, স্নেইল, একটা ব্রয়েল্ড ব্লুফিশ, টম্যাটো অমলেট, অ্যাসপারাগাসের একটু পাতলা চমৎকার চাটনি, ভালো চীজ, একটা রুটি, আর এক বোতল ওয়াইন খেলে ভালো হয়। আমি পকেটে হাত দিলাম, কোনও রেস্তোরাঁয় ঢোকার আগে যা আমি সবসময়েই করে থাকি। আর একটা মাত্র স্যু[১৪] খুঁজে পেলাম। ‘‘ধ্যাৎ,’’ নিজেকেই বললাম, ‘‘মেয়েটা আমার জন্য কিছু ফ্রাঙ্ক অন্তত রেখে যেতে পারত।’’   ঘরে, মিটসেফে কিছু খাবার আছে কিনা দেখতে আমি জোর কদমে হাঁটা দিলাম। ক্লিশিতে আমরা যেখানে থাকতাম, গেট পার হয়ে সেটা মোটামুটি আধ ঘণ্টার হাঁটা পথ। কার্ল নিশ্চয়ই এতক্ষণে ডিনার সেরে ফেলেছে, তবু রুটির টুকরো-টাকরা কিছু আর টেবিলে দাঁড় করানো অল্প ওয়াইন হয়তো পেয়ে যাব। আমি জোরে আরও জোরে হাঁটতে থাকলাম, আমার খিদেও বাড়তে থাকল প্রত্যেক কদমে কদমে। 
যখন আমি রান্নাঘরে হামলে পড়লাম দেখি যে কার্ল তখনও খায়নি। সবজায়গায় খুঁজলাম আমি, কিন্তু একটু খুদকুঁড়োও পেলাম না। একটা খালি বোতলও কোথাও নেই যেটা দিয়ে আমি কিছু টাকা পেতে পারি। আমি ক্ষেপে গেলাম একেবারে। ছুটে বেরুলাম, ঠিক করলাম ক্লিশির কাছের ছোট রেস্তোরাঁটায়, যেখানে মাঝামাঝেই খাই, ওখানে ধার চাইব। রেস্তোরাঁর ঠিক সামনে পৌঁছে আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। ফিরে এলাম। দুম করে যদি চেনা কারুর সাথে দেখা হয়ে যাবার মতো মিরাকল কিছু ঘটে এই আশায় এদিক সেদিক ঘুরতে লাগলাম। এইভাবে অন্তত একঘণ্টা গোঁত্তা মেরেছি, যতক্ষণ না একেবারে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়াটাই মনস্থ করলাম। রাস্তায়, আমার এক রাশিয়ান বন্ধুর কথা মন পড়ল, বুলেভার ছাড়িয়ে এখান থেকে কাছেই থাকে। 
ওর সাথে শেষ দেখা হয়েছে তাও বেশ ক-বছর হয়ে গেল। এ্যাদ্দিন বাদে গিয়ে কীভাবে টাকা ধার চাওয়া যায়? 
তখুনই একটা দারুণ বুদ্ধি এল মাথায়: আমি ঘরে যাব, রেকর্ডগুলো নিয়ে আসব, ওর হাতে দেব। যেন একটা ছোট্ট উপহার। এভাবে করলে, কিছু কথাবার্তা উপক্রমণিকার পর, একটা স্যান্ডউইচ বা একটা কেকের কথা বলাটা সহজ। আমি হাঁটায় জোর লাগালাম, যদিও কুকুরের মতো ক্লান্ত, ঠ্যাং খুঁড়িয়ে চলেছি।  
বাড়ি ফিরে যখন দেখলাম প্রায় মাঝরাত হয়ে গেছে, আমি একেবারে গুঁড়িয়ে গেলাম। এত রাতে খোরাক খুঁজতে আবার বেরুনোর কোনও মানে হয় না। বরং শুয়েই পড়া যাক, আশা করা যাক সকালে কিছু একটা হবে। জামাকাপড় খুলতে খুলতে আরেকটা আইডিয়া এল, এবারে যদিও তেমন দারুণ কিছু নয়, কিন্তু তবু তো... সিঙ্কের কাছে গিয়ে আবর্জনা ফেলার বাক্সটা বের করলাম, ঢাকনাটা সরিয়ে ভেতরে তাকালাম। কয়েকটা হাড়গোড় আর পাঁউরুটির শক্ত দিকগুলো একেবারে নিচে পড়ে আছে। দেখে দেখে শুকনো টুকরোগুলো তুলে আনলাম, গায়ে লেগে থাকা নোংরাগুলো যতটা পারা যায় ঝেরে ট্যাপের জলে একটু ধুয়ে নিলাম। তারপর আস্তে কামড় বসিয়ে প্রত্যেকটা টুকরো থেকে যতটা বেশি করে সম্ভব রুটির অংশগুলো খেলাম। গিলে ফেলতেই একটা হাসি আমার মুখে ছড়িয়ে পড়ল। ক্রমশ সেটা বড় হল, আরও বড়। ভাবলাম, কালকে দোকানে গিয়ে বইগুলো হাফ দামে বেচে দেব। বা তিন ভাগ দামে, বা চার ভাগ। রেকর্ডগুলোও তা-ই করব। কম করে অন্তত দশ ফ্রাঙ্ক আনতে পারব। পেটভরে ভালো একটা ব্রেকফাস্ট হবে, তারপর... হ্যাঁ, তারপর যেকোনও কিছুই হতে পারে। সে না হয় দেখা যাবে। ভরপেট খেয়ে ওঠার মতো আমি আরও একটু হেসে নিলাম। দারুণ এক কৌতুক বোধ করছিলাম এটা ভেবে যে, নিস নিশ্চয়ই একেবারে গলা অবধি খাওয়াদাওয়া সেরেছে আজকে। হয়তো প্রেমিকের সাথেই। এ নিয়ে আমার সন্দেহের কোনও অবকাশই ছিল না যে ওর একজন প্রেমিক আছে। কীভাবে তার খাবার জোটাবে, কীভাবে তাকে কাপড়জামা বা যা সে চায় সেসব কিনে দেবে, নিঃসন্দেহে এটাই নিসের বিরাট সমস্যার জায়গা, তার উভয়-সঙ্কট। সে যাক্ গে, ব্যাপারটা খাসা হয়েছে, যদিও আমি নিজেই আমোদ করে গেছি পকেট ফাঁকা করে। 
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, ওর অর্ডার করা চিকেন থেকে লেগে যাওয়া সস মুছতে নিজের টসটসে ঠোঁটের দিকে ও রুমাল নিয়ে আসছে। কীভাবে ওয়াইনের ভেতর ওর স্বাদ ঘুরে বেড়াচ্ছিল দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। ইশ, যদি আমরা তুরিন যেতে পারতাম! কিন্তু তার জন্য তো প্রচুর টাকার দরকার। অত টাকা আমার কখনও হয়নি। কোনওদিনও না। 
তবে একইভাবে, এ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে কোনও ক্ষতি নেই। আরেক গ্লাস জল খেলাম। গ্লাসটা রাখতে গিয়ে কাবার্ডের কোণায় চোখে পড়ল একটুকরো রকফোর্ত।[১৫] রুটির আরও একটা টুকরোও যদি ওখানে থাকত! নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি কোনও জায়গাই খুঁজতে বাকি রাখিনি, নোংরার বাক্সটা আবার খুললাম। ছ্যাতলা পড়া চর্বির থকথকে তরল গাদের ওপরে কয়েকটা হাড়ের টুকরো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। 
আমি আরেক টুকরো রুটি চাই এবং ভীষণভাবে চাই। আচ্ছা, পাশের ভাড়াটের ঘর থেকেও তো আমি একটা বড় রুটি পেতে পারি। বাইরের ঘরের দরজা খুলে আমি গোড়ালি উঁচু করে পা টিপে টিপে গেলাম। কবরখানার নিস্তব্ধতা বইছে সেখানে। 
একটা দরজায় আমি কান পেতে শুনলাম।
একটা বাচ্চা খুব চাপা স্বরে কাশছে। প্রশ্নই ওঠে না। যদি কেউ জেগেও থাকে তাও সম্ভব না। অন্তত ফ্রান্সে তো নয়। 
কে কবে শুনেছে একজন ফরাসি ভদ্রলোক রাতদুপুরে তার প্রতিবেশীর দরজায় টোকা দিচ্ছে, কী না, একটুকরো রুটির জন্য? ‘‘ধুর!’’ গজগজ করতে করতে বললাম, ‘‘শালা নোংরার ডাব্বায় ফেলে দেয়া আমাদের রুটিগুলোর কথা ভেবেই খারাপ লাগছে।’’ রকফোর্তের টুকরোটায় অনেক কষ্টে নিদারুণভাবে আমি কামড় দিলাম। অনেকদিনের পুরনো এটা, টোকে গেছে একেবারে; পেচ্ছাপে ভেজা পলেস্তারার মতো, কামড়াতে গেলেই ঝুরঝুর করে ভেঙে যাচ্ছে। ধুর্ ওই নিস মেয়েটা! ঠিকানা জানলে আমি গিয়ে কিছু ফ্রাঙ্ক নিয়ে আসতাম হাত পেতে। 
নির্ঘাৎ আমি একেবারে অন্যমনস্ক ছিলাম যে কিছু খুচরো রাখার কথাও মাথায় আসেনি। বণিতাকে টাকা দেওয়া মানে নর্দমায় টাকা ফেলে দেওয়ার মতো ব্যাপার। আহারে, তার বিরাট প্রয়োজন! আরও একটা শেমিজ, বা হয়তো রাস্তায় যেতে যেতে দোকানে টাঙানো দেখেছে খাঁটি সিল্কের একজোড়া ফুলমোজা। 
নিজের ওপরেই রাগে কাঁপতে থাকলাম। কারণ একটাই, বাড়িতে রুটির একটা বাড়তি টুকরো অবধি নেই। 
গাধা! একেবারে গাধা! ঘোরের মধ্যে আমি মল্টেড মিল্ক শেক নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম, আমেরিকায় কী সুন্দর বাড়তি একগ্লাস মল্টেড দুধ সবসময়েই শেকারে অপেক্ষা করে থাকে। টইটম্বুর ওই একটা গ্লাসের জন্য বড় কষ্ট হচ্ছে। আমেরিকায় প্রয়োজনের থেকে বেশিটাই সবসময় থাকে, কম কখনও নয়। জামাটা সরালে আমার পাঁজরের হাড়গুলো আমি টের পাই। অ্যাকর্ডিয়ানের রিডের মতো উঁচু হয়ে আছে। নিস, শালা ওই থলথলে কুত্তীটা নিশ্চয়ই কখনও অপুষ্টিতে ভোগেনি। 
আরেকবার দূর ছাই বলে শুয়ে পড়লাম। 
এবারে কোনওমতে নিজেকে চাদরমুড়ি দিতে হল যখন আবার আমি হো হো করে হাসতে শুরু করেছি। এইবারের হাসিটা ভয়ঙ্কর ছিল। 
আমি এমন হিস্টিরিয়া রুগির মতো হাসছিলাম যে থামতেও পারছিলাম না। যেন হাজারখানা রোমান মোমবাতি এক ঝটকায় নিবে গেল। আমি যা-ই চিন্তা করি না কেন, দুঃখের ঘটনাও মনে করতে চেষ্টা করলাম, এমনকী ভয়ানক কিছুও, হাসি চলতেই থাকল। শুধুমাত্র রুটির একটা ছোট্ট টুকরোর কারণে। ওই একটা শব্দ যা আপনা আপনিই একটু বাদে বাদে ফিরে ফিরে আসছিল আর আমাকে নতুন করে হাসির দমকে ফেলছিল।  
মোটামুটি একঘণ্টা মতো শুয়েছি বোধহয়, যখন শব্দ পেলাম কার্ল দরজা খুলছে। ঢুকেই ও সোজা নিজের ঘরে চলে গেল আর দরজা বন্ধ করে দিল। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল ওকে গিয়ে বলি যে, যাও আমার জন্য একটা স্যান্ডউইচ আর এক বোতল ওয়াইন নিয়ে এসো। তারপরেই মাথায় একটা ভালো বুদ্ধি এল। আমি একটু সকাল সকাল উঠে পড়ব, যখন ও নাক ডেকে ঘুমুবে, তখন চুপ করে ওর পকেট হাতিয়ে নেব। এটা ভাবতে ভাবতেই শুনতে পেলাম কার্ল ওর ঘরের দরজা খুলে বাথরুমে চলে গেল। মুখ চেপে হাসছে আর ফিসফিস করছে — কোনও একটা মেয়ের সাথে, খুব সম্ভব, ফেরার পথে যাকে ও নিয়ে এসছে।
বাথরুম থেকে বেরুলে আমি ডাকলাম ওকে।
‘‘ওহ্, তুমি জেগে আছ তাহলে?’’ বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলল। 
‘‘কী ব্যাপার, শরীর খারাপ নাকি?’’  
আমি ওকে পরিষ্কারভাবেই বললাম, আমার খিদে পেয়েছে, ভয়ঙ্কর খিদে পেয়েছে। ওর কাছে কিছু খুচরো আছে কি? 
‘‘পুরো সাফা হয়ে গেছি,’’ ও বলল। খুব আনন্দেই বলল, এটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারই নয় যেন। 
‘‘একটা ফ্রাঙ্কও নেই নাকি?’’ আমি জেদ ধরে রাখলাম। 
‘‘আরে ও নিয়ে ভেবো না,’’ খুব জরুরি একটা গোপন খবর বলার মতো করে বিছানার কোণে বসতে বসতে বলল। 
‘‘বড় একটা সমস্যায় পড়েছি। আমি একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছি সাথে করে — ঘরবাড়ি নেই মেয়েটার। বছর চোদ্দর বেশি হবে না। আমি জাস্ট একবার...। তুমি কি শুনছ আমার কথা? মনে তো হয় প্রেগন্যাণ্ট হবে না। 
মেয়েটা কুমারী।’’
‘‘মানে, কুমারী ছিল,’’ আমি... দিলাম।
‘‘শোনো, জো,’’ কথাটাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করতে গলা নামিয়ে বলল, ‘‘ওর জন্য কিছু করাটা আমাদের কর্তব্য। ওর কোনও থাকার জায়গা নেই... বাড়ি থেকে পালিয়ে এসছে। আমি যখন ওকে খুঁজে পাই, একটা ঘোরের মধ্যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, আধপেটা খাওয়া, কেমন একটা মাথাখারাপ, প্রথমে আমার তা-ই মনে হয়েছিল। তবে তুমি চিন্তা কোরো না। ও একদম ঠিক আছে। মাথাটা খুব শার্প নয়, কিন্তু এমনিতে ভালো। ভালো বাড়ির মেয়ে মনে হয়। তুমি দেখবে... বাচ্চা একেবারে। একটু বড় হলে আমি হয়তো ওকে বিয়ে করে নেব। যাক্ গে, পয়সাকড়ি কিছুই নেই। যা ছিল সব ওর খাবার কিনতেই খরচা করে ফেলেছি। তোমাকে না খেয়েই শুতে হচ্ছে এটা খুব বাজে হল। তুমি আমাদের সাথে থাকলে ভালো করতে.. 
আমরা অয়স্টার খেলাম, লবস্টার খেলাম, শ্রিম্প খেলাম। আর একটা দারুণ ওয়াইন। শাবলি... ওহ্...’’
‘‘ধুর ছাই!’’ আমি চেঁচিয়ে বললাম। ‘‘তোমরা কী কী খেয়ে এসেছ সেসব আমাকে বলতে এসো না। আমি এখানে ভুখা পেটে মরছি।
এখন খাবারের জন্য আমাদের তিন তিনটে পেট, আর একটা টাকা নেই। একটা কানাকড়িও নেই।’’ 
‘‘টেক ইট ইজি, জো,’’ কার্ল হাসতে হাসতে বলল। ‘‘তুমি তো জানো, আপদ বিপদের জন্য আমি সবসময় পকেটে কিছু ফ্রাঙ্ক রেখে দি।’’ ও পকেটের ভেতরে হাত ডুবিয়ে দিল, আর সেখান থেকে বের করে আনল খুচরোগুলো। কুল্যে দাঁড়াল তিন ফ্রাঙ্ক ষাট সেন্ট। ‘‘এতে তোমার ব্রেকফাস্টটা হয়ে যাবে,’’ ও বলল। ‘‘কাল অন্য আরেকটা দিন।’’    
মেয়েটা এইসময় দরজা দিয়ে মাথা বের করল। কার্ল লাফিয়ে উঠে ওকে নিয়ে এল বিছানার কাছে। ‘‘কোলেৎ,’’ ওকে স্বাগত জানাবার জন্য আমি হাত বাড়াতেই কার্ল বলল। ‘‘তো, কী ভাবনাচিন্তা করলে ওর ব্যাপারে?’’ 
উত্তর দেবার জন্য আমি সময়টুকু পাবার আগেই, মেয়েটা কার্লের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, আর প্রায় যেন আতঙ্কিত মুখে জিগ্যেস করল, আমরা কী ভাষায় কথা বলছি। 
আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে, যার মানে আমি তোমাকে বলেইছিলাম মাথাটা খুব পরিষ্কার নয়, কার্ল বলল, ‘‘তুমি ইংরিজি শুনে বুঝতে পারো না?’’ 
কতকটা বিব্রত হয়ে অপ্রতিভ অবস্থায়, মেয়েটা ঝটপট বোঝাল যে শুনে প্রথমে মনে হচ্ছে জার্মান, বা হয়তো বেলজিয়ান। 
বিরক্ত হয়ে নাক দিয়ে একটা ফোঁৎ শব্দ করে কার্ল বলল, ‘‘এখানে কেউ বেলজিয়ান নয়।’’ তারপর আমাকে বলল: ‘‘বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু নেই। কিন্তু ...দুটো দ্যাখো! চোদ্দ বছরের হিসেবে একদম ঠিক আছে, কী? আমাকে আবার কসম খেয়ে বলেছে ওর নাকি সতেরো, আমি বিশ্বাস করি না।’’
কোলেৎ ওখানে দাঁড়িয়ে শুনে যাচ্ছিল এই অবাক করা ভাষা, তাও সে এই প্রকৃত সত্যিটা ধরতে পারছে না যে কার্ল আর যে ভাষাই বলুক না কেন ফ্রেঞ্চ সে জানে না। শেষমেশ সে একেবারে জোর করেই জানতে চাইল যে কার্ল সত্যি সত্যিই ফরাসি কিনা। 
মনে হচ্ছিল এটা তার কাছে খুব জরুরি একটা ব্যাপার।
‘‘হ্যাঁ, আমি ফরাসিই তো,’’ কার্ল একেবারে উল্লাসে জানাল। ‘‘তুমি কি আমার কথার সাথে কথা বলতে পারছ না? আমি কি জার্মানদের[১৬] মতো করে বলছি?
পাসপোর্ট দেখবে আমার?’’ 
‘‘ওটা ওকে না দেখানোই ভালো,’’ কার্ল যে চেকশ্লোভাকিয়ার পাসপোর্ট নিয়ে ঘোরে সেটা মনে করে আমি বললাম।
‘‘তুমি কি ভেতরে আসবে একবার, বিছানার চাদরগুলো দেখবে?’’ কোলেতের কোমরে একটা হাত রেখে কার্ল বলল। ‘‘মনে হয় ওগুলো আমাদের ফেলেই দিতে হবে। লন্ড্রিতে আমি নিতে পারব না ওসব; ওরা ভাববে আমি কোনও ক্রাইম করেছি।’’  
আমি মজা করে বললাম, ‘‘ওকে ধুতে দাও ওগুলো।’’ 
‘‘যদি ও আমাদের সাথে থাকতে চায় তাহলে ও করতে পারে এমন অনেক কাজ এখানে আছে।’’ 
‘‘মানে তুমি ওকে এখানে রাখতে চাইছ? তুমি জানো এটা বেআইনি, জানো না? জেলে যেতে পারি আমরা এজন্য।’’ 
‘‘ভালো হয় যদি ওকে একজোড়া পায়জামা বা নাইটগাউন দিতে পারো।’’
আমি বললাম, ‘‘কারণ তোমার এই উদ্ভট পোশাকে ও যদি রাতে এখানে ঘোরাঘুরি করে আমি হয়ত নিজেকে ঠিক রাখতে পারব না, বলপ্রয়োগ করে ফেলতে পারি।’’  
কার্ল কোলেতের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে ফেলল একেবারে। 
‘‘কী হচ্ছে?’’ কোলেৎ চেঁচিয়ে উঠল জোরসে। ‘‘তোমরা কি মজা করছ নাকি আমাকে নিয়ে? আর তোমার বন্ধু কেন ফ্রেঞ্চে কথা বলছে না?’’ 
‘‘একদম ঠিক,’’ আমি বললাম। ‘‘এখন থেকে আমরা ফ্রেঞ্চেই কথা বলব আর ফ্রেঞ্চ ছাড়া কিচ্ছু নয়।
ওকে?’’ 
একটা শিশুসুলভ হাসি ছড়িয়ে পড়ল ওর মুখে। ও ঝুঁকে এসে আমার দু গালে চুমু দিল। তখনই শরীর বুলিয়ে গেল আলতো করে। 
কোনওমতে জড়ানো ওর আলুথালু কাপড়টা খসে নিচ অবধি সব মেলে ধরল, উন্মুক্ত করে দিল ওর অপূর্ব শরীর। 
‘‘যিশাস!’’ আমি বললাম, ‘‘আরে নিয়ে যাও ওকে, বন্ধ করে রাখো তোমার ঘরে। তুমি যখন থাকবে না তখন এরকম পোশাকে ও যদি ঘোরাঘুরি করে, কিছু ঘটলে আমি কিন্তু দায়ী থাকব না তার জন্য।’’ 
কার্ল ওকে ঝটপট তুলে নিজের ঘরে নিয়ে গেল, ফিরে এসে আবার বসল বিছানার কোণের দিকে। ‘‘আমরা হাতে একটা বড় সমস্যা নিয়ে ফেলেছি, জো,’’ কার্ল শুরু করল, ‘‘আর তোমার উচিত এতে আমাকে সাহায্য করা। আমার পেছনে তুমি ওর সাথে কী করছ তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তুমি জানো, আমি ঈর্ষাপরায়ণ নই। কিন্তু তুমি কখনওই ওকে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে দেবে না। পুলিশ ধরলে ওকে আর এখানে রাখবে না, পাঠিয়ে দেবে — এমনকী হয়তো আমাদেরকেও। এখন ব্যাপার হল, বাড়িঅলাকে কী বলা যায়? 
কুকুরের মতো আমি ওকে আটকে রাখতে পারব না। এটা বলা যেতে পারে, আমার কোনও তুতো বোন, বেড়াতে এসেছে। 
রাতে, আমি কাজে বেরিয়ে গেলে, তুমি ওকে নিয়ে সিনেমায় যাও। একটু হেঁটে এসো ওকে নিয়ে। ও খুব মজা করতে পারে। ওকে আশপাশের ভূগোল বা কিছু একটা শেখাও — একেবারেই কিছু জানে না। তোমার জন্য এটা ভালোই হবে। তোমার ফ্রেঞ্চটাও আগের চেয়ে আরও ভালো হবে। আর হ্যাঁ, পেট বড় করে দিও না, এই সাহায্যটা যদি করতে পারো। এখন ক্লিনিকের জন্য টাকার কথা আমি ভাবতেই পারছি না। তাছাড়া, আমার সেই হাঙ্গেরিয়ান ডাক্তার যে এখন কোথায় থাকে তাও জানি না।’’
আমি চুপ করে শুনছিলাম ওর কথা। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে জড়িয়ে পড়তে কার্ল বরাবরের ওস্তাদ। মুশকিল হল, বা হয়তো এটাই ওর ধর্ম যে ও কখনও ‘না’ বলতে পারে না। বেশিরভাগ লোকই তাদের সহজাত প্রবৃত্তিতে চট করে না বলে দেয়। চলবে

পরিশিষ্ট
১৪. স্যু (Sou) : পূর্বতন ফরাসি মুদ্রা।    
১৫. রকফোর্ত (Roquefort) : ভেড়ার দুধ দিয়ে তৈরি একপ্রকার নীলরঙের চীজ। 
১৬. মিলার এখানে ‘বশ্‌’ (Boche) শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। যা একসময় ফরাসি সৈন্যরা ব্যবহার করত স্ল্যাং হিসেবে, ‘rascal’ অর্থে। পরে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ‘একজন জার্মান সৈনিক’ বা ‘জার্মান’ বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। 

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী