X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থী কমছে, টিউশন ফি ছাড় দিয়ে অস্তিত্ব সংকটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

এস এম আববাস
২৯ আগস্ট ২০২১, ২০:৩১আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২১, ১৫:৪৭

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ করছিলেন সোহেল রানা। সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু গত বছরের শুরুতে করোনা অতিমারি শুরুর পরই সব ওলট-পালট হয়ে যায়। লেখাপড়াটা বিলাসিতা মনে হতে থাকে তার কাছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নিজের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন সোহেল রানা। পরিস্থিতি বিবেচনা করে টিউশন ফি বাকি রেখেই রানার লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনকে সোহেল রানা এসব কথা বলেন। সোহেল রানা বলেন, ‘প্রতিমাসে টিউশন ফি-তে প্রায় ৫০ শতাংশ ছাড় পেয়ে আসছি। তাতে ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনায় সংসারের আয় কমে যায় অর্ধেক। ন্যূনতম খরচ করেও লেখাপড়া চালানোর পরিস্থিতি আমার নেই। তবে টিউশন ফি বকেয়া রেখে পড়া চালানোর সুযোগ দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।’

একই কথা জানান স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের সহায়তা না পেলে আমার মতো অনেকে পড়ালেখা চালিয়ে নিতে পারতো না। ’

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপ-রেজিস্ট্রার কামরুল হোসাইন বলেন, ‘করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অবস্থা এমনিতেই করুণ। তারপরও শিক্ষার্থীরা যাতে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে সে জন্য  সামর্থ্য অনুযায়ী বেতন নিচ্ছি। কখনও ৬০ শতাংশ, কখনও ৪০ শতাংশ নিচ্ছি। অনেকেই টিউশন ফি দিতে পারছে না। তাই বলে ওদের লেখাপড়া বন্ধ করিনি।’

কামরুল হোসাইন আরও বলেন, ‘ছাড়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় আরও বেশি আর্থিক সমস্যায় পড়েছে। বেতন কমে যাওয়ায় শিক্ষকদের অনেকে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। শিক্ষকরা তা মেনে নিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সরকারিভাবে আমাদের জন্য কোনও সহায়তা নেই। করোনা দুর্যোগে এ সহায়তা খুব জরুরি।’

বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানান, টিউশন ফি কমিয়ে, স্কলারশিপ দিয়ে কিংবা বকেয়া রেখেই রাজধানীর বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী পড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কম বেতন নিয়েও শিক্ষকতা করছেন।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অনুষদের ডিন অধ্যাপক জামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যতটা ছাড় দেওয়া সম্ভব ততটা দিয়েই শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছি। কেউ টিউশন ফি না দিতে পারলে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়নি। আমরা শিক্ষকরাও কম বেতন নিচ্ছি। এখন পর্যন্ত জুন মাসের বেতন নিয়েছি। তবু চাই শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন নির্বিঘ্ন থাক।’

এশিয়ান ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. এম. আনিছুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনা দুর্যোগে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দুই থেকে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে বিনা বেতনে ছুটি দেওয়া হয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম বলবো না। ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের বলা হয়েছে—পরিস্থিতি ভালো হলে চাকরিতে ফিরতে পারবেন তারা। অর্থাৎ তাদের চাকরি আছে বেতন নেই।’

ড. সরদার এম আনিছুর রহমান আরও বলেন, ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি শিক্ষক-কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ বেতন দিচ্ছে। তবে যে হারে শিক্ষার্থী কমছে তাতে কতদিন এভাবে দেওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষাবিদ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক বলেছেন, ‘করোনা অতিমারির পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিকে থাকতে অনেক সমস্যা দেখা দেবে। শুধু টিউশন ফির ওপর নির্ভর না করে টিকে থাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তহবিলের বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। তহবিল সংগ্রহ গবেষণা আয় থেকে হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে, গবেষণার আয় কার্যকর বিকল্প হতে পারে না। কারণ, আমাদের এই খাত এতটা উচ্চতায় যায়নি। তাই বিকল্প উৎস হতে পারে ব্যাংক ঋণ। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি হওয়ায় ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে চায় না। ’

এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ল এবং বিপিপি ইউনিভার্সিটি পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত। তারা সেখান থেকে তহবিল সংগ্রহ করে। তাদের মতো আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও স্টক এক্সচেঞ্জের অধীনে নিবন্ধিত হতে পারে। পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। এই অর্থ গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতনের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল গঠনে সহায়ক হবে।  শিক্ষার্থীদের ফি’র ওপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্ভরতা তাতে কমবে। ’

 

ভর্তি কমেছে সর্বোচ্চ ৮৮.৯ শতাংশ

দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিগত সময়ের শিক্ষার্থী ভর্তির চিত্রে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে ভর্তি কমেছে ব্যাপক হারে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২০ সালের সামার সেমিস্টারে ২৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ ভর্তি কমেছে।

বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালে সামার সেশনে ভর্তি হয়েছে ৬২৩ জন শিক্ষার্থী এবং ২০১৯ সালে ভর্তি হয়েছে ৭৪১ জন। কিন্তু করোনার ছোবলে ২০২০ সালের সামার সেশনে ভর্তি হয়েছে মাত্র ৮২ জন। এই হিসাবে শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালে সামার সেশনে ভর্তি হয়েছিল ১৮৯ জন। ২০১৯ সালে ভর্তি হয়েছিল ১৯৪ জন। কিন্তু ২০২০ সালে সামার সেশনে ভর্তি হয়েছে মাত্র ৪৮ জন।  কমেছে ৭৫ দশমিক ৩ শতাংশ।

ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ২০১৮ সালে সামার সেশনে ভর্তি হয়েছিল এক হাজার ৮৬২ জন। ২০১৯ সালে এক হাজার ৬৪৮ জন। ২০২০ সালে সামার সেশনে ভর্তি হয়েছে মাত্র ৪৩৮ জন। ভর্তি কমেছে ৭৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালের সামার সেশনে ভর্তি হয়েছিল এক হাজার ৪১৮ জন। ২০১৯ সালে ভর্তি হয়েছিল এক হাজার ৩০৬ জন, কিন্তু ২০২০ সালে সামার সেশনে ভর্তি হয় মাত্র ৪৮৩ জন। কমেছে ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ।

মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটিতে ২০২০ সালের সামার সেশনে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে মাত্র ২২ জন। 

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে ২৩ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত।

শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি আদায় করে অ্যাকাডেমিক খরচ, পরীক্ষার খরচ, শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খরচ মেটানো হয়। করোনার কারণে ভর্তি কমে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় যেমন কমেছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের টিউশন ফিও ঠিকমতো আদায় হচ্ছে না। অপরদিকে টিউশন ফি’তে ছাড় দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে।

/এমআর/এফএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
আইএসইউর উপাচার্য পদে পুনরায় নিয়োগ পেলেন ড. আব্দুল আউয়াল খান
সিআইইউতে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক কোর্স চালু
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর আদায়ের ওপর আদালতের স্থিতাবস্থা
সর্বশেষ খবর
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ