X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
সাক্ষাৎকার

দুর্গাপূজায় গণমানুষসংশ্লিষ্ট অসাম্প্রদায়িক চেতনাই বড় : যতীন সরকার

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শিশির রাজন
১৩ অক্টোবর ২০২১, ০২:৫৫আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২১, ০২:৫৯

[অধ্যাপক যতীন সরকার। প্রবন্ধসাহিত্যে পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর মার্ক্সীয় সাম্যবাদী মৌলিক চিন্তা ঋদ্ধ করেছে বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যকে। ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা চন্দপাড়া গ্রামে যতীন সরকারের জন্ম। দীর্ঘদিন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন তিনি। মোট প্রকাশিত বই প্রায় ৩৫টি। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে : সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা, পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন, পাকিস্তানের ভূত ভবিষ্যৎ, বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন ইত্যাদি। যতীন সরকারের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সেকাল-একালের শারদীয় দুর্গোৎসবের নানান প্রসঙ্গ।] 


শিশির রাজন : স্যার, শারদীয় শুভেচ্ছা। কেমন আছেন? আপনার ছেলেবেলার দুর্গাপূজার স্মরণীয় স্মৃতি যদি জানাতেন…

যতীন সরকার : তোমাকেও শুভেচ্ছা। ভালো থাকতে চেষ্টা করছি। আমার জন্ম এবং শৈশব কেটেছে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দপাড়া গ্রামে। চন্দপাড়া গ্রামটির অধিকাংশ মানুষই ছিল নিম্ন-মধ্যবিত্ত। কেবল চন্দ বাড়ি ধনী ছিলো। সেখানেই দুর্গাপূজা হতো, শাস্ত্রসম্মত ভাবেই। সেখানেই আমরা যেতাম। কিন্তু এ চন্দপাড়াতেই দুর্গাপূজায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন করলেন দেবেন্দ্র দাশ। তিনি কায়স্থ ছিলেন। একটু কথা এখানে বলে নেই, হিন্দুদের তো নানান বর্ণ। ফলে বর্ণবাদ প্রবল ছিল। রক্ষণশীল কায়স্থ, ব্রাহ্মণরা যেকোনো লোকের বানানো মূর্তি দিয়ে পূজা করতেন না। পালরা মূর্তি বানাতো। তবে, তাদের মূর্তি দিয়ে রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ-কায়স্থরা পূজা করতেন না। পূজা করতে হতো আচার্য ব্রাহ্মণ দ্বারা তৈরি মূর্তি দিয়ে। তো, দেবেন্দ্র দাশ একটা বৈপ্লবিক কাজ করলেন, তিনিসহ গ্রামের অন্য কায়স্থরা ব্রাহ্মণের মতো পৈতা নিলেন। এবং নিজেকে ব্রাহ্মণ হিসেবে ঘোষণা করলেন। এটা একটা অসাধারণ বৈপ্লবিক কাজ ছিল সেই সময়ে। তখন আমার শৈশব। আমার জন্ম ১৯৩৬ সালে; পাকিস্তান আমলের আগের কথা বলছি। এটা ১৯৪৬ সালের দিকে হবে। সেই দেবেন্দ্র দাশ শুধু পৈতা ধারণ করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি নিজের হাতেই মূর্তি তৈরি করে পূজা শুরু করলেন এবং প্রতি পূজায় আগের বছরের মূর্তিটাই নিজের পুকুরে বিসর্জন দিতেন। একারণে ব্রাহ্মণরা তাকে সমাজচ্যুত করলেন। দেবেন্দ্র দাশ এসবের ধার ধারলেন না। বরং, দেখা গেল অন্য কায়স্থরাও অনেকেই তার পথ অনুসরণ করল। আমরা তাকে ‘দাশ দাদা’ ডাকতাম। উনি আমার ঠাকুরদাদার সমসাময়িক। তো আমাদের চন্দপাড়া গ্রামের পাশের নন্দী গ্রামে কয়েকটা কায়স্থ পরিবারও দাশ দাদার মতো নিজেরাই সবকিছু করে পূজা করা আরম্ভ করে দিলো। এধরনের ঘটনা ছেলেবেলাতেই আমার মনে প্রভাব ফেলেছিলো। তারপর আস্তে আস্তে সর্বজনীন পূজা আরম্ভ হলো আমাদের এলাকায়। আমরা তখন বড়দের সাথে পূজা দেখতে যেতাম। এবং এসব পূজায় আর হিন্দু বর্ণবৈষম্য খুব ছিলো না। মোটামুটিভাবে সকল বর্ণের অংশগ্রহণ থাকত।

 

শিশির রাজন : ছেলেবেলার পূজা নিয়ে আপনার কোনো বিরূপ স্মৃতি আছে কি না?

যতীন সরকার : আসলে আমাদের ছেলেবেলায় দেখা পূজাগুলোতে পূজার জন্য পূজা হতে দেখেছি। শিষ্টাচার রক্ষা করা হতো। এবং গুরুগম্ভীর ভাব ছিলো। শহরে যখন সর্বজনীন পূজা আরম্ভ হলো তখন এসব পূজায় শিষ্টাচারের গণ্ডিটা অনেক ভেঙে গেল। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে আনুষঙ্গিক নানান বিষয়ের আধিপত্য দেখা দিলো। এই সর্বজনীনতা যে ভিন্ন মাত্রা সৃষ্টি করে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু এগুলো দেখে আমার খুব খারাপ লাগত।

শিশির রাজন : ছেলেবেলায় দেখা দুর্গাপূজা আর পরিণত বয়সে দেখা দুর্গাপূজার পার্থক্য কেমন?

যতীন সরকার : ছোটবেলা থেকেই আমি ইঁচড়েপাকা। যা আমি আমার পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শন বইতেও লিখেছি। পাকিস্তান আমলে হিন্দু মহাসভা হিন্দুদের একত্রিত করে সর্বজনীন পূজা ব্যাপকভাবে শুরু করেছিলো। কিন্তু সেই সর্বজনীন পূজাতেও বর্ণ প্রথা ছিলো। বিভেদ ছিলো। তো আমি ছোটবেলাতে একবার কালীবাড়িতে পূজায় যাব, প্রসাদ খাব―প্রচার করতে লাগলাম। আমার ঠাকুরমা বারণ করলেন : না, ওখানে প্রসাদ খাওয়া যাবে না। সেখানে নমঃশুদ্ররা প্রসাদ দেবে। আমি বললাম―আমি খাবই; খেলামও এবং তা বলে বেড়াতেও শুরু করলাম। ঠাকুরমা মাথায় হাত রেখে বললেন―খেয়ে যখন ফেলেছিস, বলে বেড়াতে হবে কেন! মানে খেলে জাত যায় না, বললে জাত যায়! সেসময়ে এ অবস্থা ছিল (হাসি)।

আমাদের ছেলাবেলায় পূজা হবে, পূজার দিকেই সবার নজর থাকত। পূজাটা যেন ভালোভাবে হয়, ভালো ব্রাহ্মণ এনে পূজা করা ইত্যাদি। মানে পূজা যেন শাস্ত্র মেনে সম্পন্ন করার একটা প্রচেষ্টা ছিলো। এখন যেটা হয়েছে, শাস্ত্রের সাথে পূজার সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। যেমন ধরো দুর্গাপূজায় চণ্ডী পাঠ করতে হবে। কিন্তু সেই চণ্ডী পাঠ ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না। যেমন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র তিনি আকাশবাণীতে প্রচারের জন্য চণ্ডী পাঠ করলেন। তিনি তো ব্রাহ্মণ ছিলেন না। তাই তার অনুষ্ঠান বহু বছর আটকে রাখা হলো, প্রচার হলো না। এখন তো তার চণ্ডী পাঠ শোনা ছাড়া যেন দুর্গাপূজা হয় না! (হাসি)। এসব বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। এখন কে কী পূজা করল এটা দেখার বিষয় না। এখনকার পূজার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমোদ-প্রমোদের। এটা একটা দিক। তবে এটাকে প্রধান না ধরে আমি এখনকার দুর্গাপূজার সর্বজনীন বৈপ্লবিক পরিবর্তনটাকেই বড় করে দেখি। ছেলেবেলায় যদিও আমার কাছে ধর্মীয় বিশ্বাসটা বড় ছিলো, এখন যেহেতু আমি বস্তুবাদী মানুষ, ধর্মীয় বিশ্বাস তো আমার নেই; দুর্গাপূজায় গণমানুষসংশ্লিষ্ট অসাম্প্রদায়িক চেতনাটাই আমার কাছে বড় বিষয়।

শিশির রাজন :  স্যার, বর্তমান দুর্গাপূজার অসম্প্রদায়িকতা আগের চেয়ে অনেকাংশে বেশি বলে মনে করেন?

যতীন সরকার : হ্যাঁ, অবশ্যই অনেকাংশে বেশি। তা তো হয়েছে আগে যা বলেছি সেসকল বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যদিয়েই। এখন ধরো, আমি নেত্রকোনাতে বিভিন্ন মণ্ডপে পূজা দেখতে যাই সেখানে পূজা কীভাবে কোন শাস্ত্রমতে হলো সেটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না, পূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সকল ধর্মের মানুষ মিলে উৎসবটা পালন করে। এমনকি আমি দেখেছি নেত্রকোনাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েরাও পূজা দেখার জন্য বের হয়। দুর্গাপূজা এখন ধর্মীয় রক্ষণশীল গণ্ডি ভেঙে প্রায় অসাম্প্রদায়িক উৎসবে পরিণত হয়েছে।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
রামরুর কর্মশালায় বক্তারাঅভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা