X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অবহেলিত এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের কথা জানে ক’জন!

চৌধুরী আকবর হোসেন
২০ অক্টোবর ২০২১, ১৯:৫৯আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২১, ২১:১৯

দেশে যদি হঠাৎ ছয়-সাত ঘণ্টার জন্য ট্রাফিক পুলিশ কাজ না করে তবে কী ঘটবে? মোড়ে মোড়ে যানজট লাগবে, অচল হবে শহরের বড় রাস্তা কিংবা অনেকে হয়তো গাড়ি নিয়েই বের হবেন না। কিন্তু উড়োজাহাজ চলাচল করা অবস্থায় যদি ঘণ্টাখানেকের জন্য এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা (এটিসি) কাজ না করেন তবে ঘটে যাবে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা। সীমা ছাড়িয়ে যাবে প্রাণহানি ও ক্ষতি। এ জন্য যে মাত্রার পেশাদারিত্ব একজন এটিসিকে দেখাতে হয়, সেই তুলনায় নেই তাদের স্বীকৃতি, নেই সুযোগ-সুবিধাও। উল্টো তাদের কাজ করতে হচ্ছে কঠিন এক পরিবেশে।

একটি ফ্লাইট ৮ ঘণ্টার বেশি হলেই তাতে অতিরিক্ত এক সেট পাইলট থাকেন। অথচ বাংলাদেশে সেই পাইলটদের যারা সার্বক্ষণিক সহায়তা করেন, তাদের ডিউটি করতে হয় টানা ১২ ঘণ্টা। মাত্র একজন কন্ট্রোলার থাকেন ওই সময়। কোনও কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই। জনবল, যন্ত্রপাতি সংকট, অনুপযুক্ত পরিবেশ—সব মিলিয়ে দারুণ মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করে চলেছেন বাংলাদেশের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা।

পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, প্রেষণা, ঝুঁকিভাতা, পৃথক বেতন কাঠামোসহ সুযোগ-সুবিধা না থাকায় অনেকই আগ্রহ হারাচ্ছেন এ পেশায় আসতে।

২০০১ সালের ১ আগস্ট। বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের এরিয়া কন্ট্রোল সেন্টারের দায়িত্বে ছিলেন কন্ট্রোলার এস এম ওহিদুর রহমান। রাত সাড়ে ১২টার দিকে বাসা থেকে ফোন এলো তার ৮ মাস বয়সী শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকেন ওহিদুর রহমান। একইসঙ্গে কন্ট্রোল সেন্টারে উড়োজাহাজগুলোকেও দিয়ে যাচ্ছিলেন নির্দেশনা। এদিকে বাসা থেকে ফোনের পর ফোন। শিশুর অবস্থা সংকটাপন্ন। দ্রুত হাসপাতালে নিতেই হবে। ওহিদুর রহমানকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলছেন তার পরিবারের সদস্যরা। টাওয়ার থেকে বাসার দূরত্ব ৫ মিনিটেরও কম। তবু কোনও স্ট্যান্ডবাই কন্ট্রোলার না থাকায় বের হতে পারছেন না ওহিদুর। ৪৫ মিনিট পর খবর এলো ওহিদুরের শিশুসন্তান মারা গেছে।

ওহিদুর রহমানের মতো অন্য এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদেরও দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বিপুল পেশাদারিত্বের সঙ্গে। কারণ, এ কাজে একচুল এদিক-ওদিক হলেই ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। তবু এর জন্য স্বীকৃতি পান না তারা। পান না পর্যাপ্ত জনবল ও সুযোগ-সুবিধা।

সম্প্রতি সিভিল এভিয়েশন ট্রেনিং সেন্টারের পরিচালক পদ থেকে অবসরে গেছেন ওহিদুর রহমান। দীর্ঘ ৩২ বছরের কর্মজীবনে নানা ঘটনার সাক্ষী তিনি। সন্তান হারানোর স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ওঠেন। বলেন, স্বীকৃতি তো দূরের কথা, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের কথাই জানেন না অনেকে। আকাশপথে অনেক মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটবে যদি কন্ট্রোলাররা দক্ষতার সঙ্গে সব সামলাতে না পারেন। তাদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বর্পূণ সেটা না জানলে সম্মাননার বিষয়ও আসবে না।

ওহিদুর রহমান বলেন, ‘পাশের দেশগুলোতেও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের বেতন কাঠামো পাইলটদের মতো আলাদা। কন্ট্রোলারদের ওপরই নির্ভর করে আকাশের নিরাপদ যোগাযোগ। তাদের জন্য নানা সুবিধা থাকতেই হবে।’

জানা গেছে, তিনটি শিফটে কাজ করেন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা—সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ২টা, দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা এবং রাত ৮টা থেকে সকাল সাড়ে ৭টা। পুরনো রাডার, ত্রুটিপূর্ণ রেডিও—এসব নিয়েই কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে এটিসিদের।

পুরনো রাডার প্রায়ই কাজ করে না। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শনিবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হয় ওটা। যার কারণে ওই সময় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কাজ করতে হয় কন্ট্রোলারদের।

এ ছাড়া রেডিওর সমস্যায় পাইলটদের সঙ্গে এটিসি’র যোগাযোগেও সমস্যা হচ্ছে। জনবল কম থাকায় মাত্রাতিরিক্ত চাপ তো আছেই।

ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে টার্মিনাল ভবনের উত্তরে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার। সেখানকার কর্ম পরিবেশও উন্নত নয়। টয়লেটটাও অপরিচ্ছন্ন। নেই নিজস্ব খাবারের ব্যবস্থা। বেতন কাঠামো, ঝুঁকিভাতা, প্রশিক্ষণ নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে এটিসিদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার বলছেন, ‘আমরা তো চাইলেই বের হয়ে নাশতা করে আসতে পারি না। জনবল কম থাকায় কাউকে দায়িত্ব দিয়ে যে উঠবো সেই উপায়ও নেই। রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা থাকলে এ সমস্যা থাকে না। উন্নত দেশে টাওয়ারেই থাকে আধুনিক রেস্ট রুমসহ আরও অনেক সুবিধা। থাকে বিশেষ ভাতাও। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাইলটদের মতো আমাদের এটিসিদের বেতন কাঠামোও নেই। এককথায় আমরা অবহেলিত। যে কারণে দক্ষতা বাড়ার পরও অনেকে এ পেশা ছেড়ে চলে যান।’

বিশ্বে ২০ অক্টোবর পালন করা হয় ‘আন্তর্জাতিক এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারস’ দিবস। বাংলাদেশে ২০১৯ সাল থেকে সীমিত আকারে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

বেবিচকের এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (এটিএম) বিভাগের সদস্য এয়ার কমডোর মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশে সেই অর্থে তাদের স্বীকৃতি নেই। গত বছর সীমিত পরিসরে দিবসটি পালন করেছি। এবারও করছি। স্বীকৃতির বিষয়টি ধীরে ধীরে হবে। জনবল সংকট দূর করতে নিয়োগ চলছে। অপারেশনাল লোকজন তো রাতারাতি তৈরি করা যায় না। নিয়োগ, প্রশিক্ষণ মিলিয়ে ৪-৫ বছর লেগে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ৬৪ জন কন্ট্রোলার নিয়োগ দেবো। দ্রুত প্রশিক্ষণ শেষ করতে পাশের দেশ থেকেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবো।’

বেতন কাঠামো প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কন্ট্রোলারদের আলাদা বেতন কাঠামো করা কঠিন। যেহেতু তাদের সরকার নির্ধারিত বিভিন্ন গ্রেডে নিয়োগ করা হচ্ছে, সেই কাঠামোতেই রাখতে হয়। তবে বাকি বিশ্বে এটিসি প্রফেশন খুব ভালোভাবে পুনর্গঠন করা হয়। তাদের বেতনও সম্মানজনক। সামনে বাংলাদেশেও হয়তো পরিবর্তন আসবে।’

 

 

 

/এফএ/আপ-এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা