মহামারিতে বিশ্বে এখনও দাপট দেখাচ্ছে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এরই মধ্যে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শনাক্ত হয়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। ভবিষ্যতে কোন ভ্যারিয়েন্ট দাপট দেখাবে তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুক্তরাজ্য থেকে কিছু তথ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীদের ধারণা, দাপুটে হয়ে ওঠার এই লড়াইয়ে বিজয়ী হতে পারে ওমিক্রন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের নেতৃত্বে একটি গবেষণা কাজের জন্য করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন ড. জ্যাকব লেমিয়াক্স। তিনি বলেন, ‘এখনও অল্প কয়েক দিন হয়েছে, কিন্তু ক্রমাগত যেসব তথ্য আসছে তাতে দেখা যাচ্ছে ওমিক্রন সম্ভবত ডেল্টাকে পেছনে ফেলে দেবে, সব জায়গাতে না হলেও বহু জায়গায়।’
নভেম্বরের মাঝামাঝিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় দৈনিক সংক্রমণের মাত্রা ছিল দুইশ’র কাছাকাছি। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পর বর্তমানে দেশটিতে দৈনিক ১৬ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল গৌতেং প্রদেশে ৯০ শতাংশই ওমিক্রনে আক্রান্ত। অন্য আটটি প্রদেশেও দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়ছে এবং শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
আফ্রিকা হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক উইলিয়াম হ্যানিকম বলেন, ‘ভাইরাসটি অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার বিগত তিনটি ঢেউ থেকে বর্তমানে চলা সংক্রমণের ঢেউ বেশি তীব্র। এর মাধ্যমে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, এটি দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং এটি বেশি সংক্রামক ভাইরাস হতে পারে।’
ইতোমধ্যে বিশ্বের ৫৭টি দেশে ছড়িয়েছে ওমিক্রন। বিশ্বজুড়েই নানা শঙ্কার কারণে সীমান্ত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিভিন্ন দেশ। তবে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর এবং এটি ওমিক্রন সংক্রমণ থামাবে না বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে ডব্লিউএইচও বলছে, টিকা নেওয়া এবং মাস্ক পরা কোভিডের এই স্ট্রেইনটির অগ্রযাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের পাশের দেশ ভারতেও ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে, শনাক্ত হয়েছে শ্রীলংকা ও নেপালেও। আর এতে করে ওমিক্রন থেকে শঙ্কা মুক্ত নয় বাংলাদেশ। যার কারণে ওমিক্রন ঠেকাতে ১৫টি নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর, সুপারিশ দিয়েছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও। কিন্তু রাজধানীর কোথাও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেই নির্দেশনা কিংবা জাতীয় কমিটির সুপারিশের বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে বর্তমানে সংক্রমণের হার এখনও দুই শতাংশের নিচে এবং ১ শতাংশের সামান্য উপরে। কিন্তু এতে করে আমাদের কোনওভাবেই আত্মতুষ্টিতে ভুগার কোনও কারণ নেই। কারণ, ঘরের দরজাতেই ওমিক্রন কড়া নাড়ছে। কাজেই এই মুহূর্তে আমাদের সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে, জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ১৫ নির্দেশনার মধ্যে অন্যতম হলো—সকল ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য জনসমাগম নিরুৎসাহিত করা, প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়া প্রত্যেক ব্যক্তির সর্বদা সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করা, রেস্তোরাঁতে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম রাখা, সকল প্রকার জনসমাবেশ, পর্যটন স্থান, বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল বা থিয়েটার হল ও সামাজিক অনুষ্ঠানে (বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিন, পিকনিক পার্টি ইত্যাদি) ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম সংখ্যক লোকের অংশগ্রহণ, মসজিদসহ সকল উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করা এবং গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা।
গত ১ সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা, শপিং মল, কাঁচাবাজার, রেস্তোরাঁতে ঘুরে দেখা যায়, কোথাও এই নির্দেশনার কোনও বাস্তবায়ন নেই। মানুষের মুখে মাস্ক নেই, হয় গলায় নয়তো থুতনিতে। কারও আবার ব্যাগে বা পকেটে। মাস্ক পরায় নানা অজুহাত ছিল মানুষের শুরু থেকেই। প্রায় ২ বছর হতে চললেও এখনও মাস্কে অভ্যস্ত হতে দেখা যাচ্ছে না। বরং সাম্প্রতিক সময়ে করোনার প্রাদুর্ভাব কম হওয়াতে আরও অনীহা দেখা গিয়েছে।
জাতীয় কমিটির সুপারিশ কোথাও বাস্তবায়িত হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা বললাম, জনসমাগম সীমিত করতে হবে। অথচ কোথাও সমাবেশ বাদ যাচ্ছে না, সরকারিভাবেই বিভিন্ন সমাবেশ হচ্ছে।
কোর্টে আইনজীবীরা ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের সব মাস্ক খোলা। সচেতন সমাজ বলতে আমরা যা মনে করি, সচেতন সমাজের অংশ যারা—তারাই সচেতন নন। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষকে আমরা কিইবা বলতে পারি, প্রশ্ন করেন ইকবাল আর্সলান।
“আর দেশের ভেতরে মাস্ক পরা, সমাবেশ সীমিত করার নির্দেশনাগুলো মানাতে বাধ্য করার মতো দায়িত্ব সবার, একক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের নয়, এটা সকলে মিলে করতে হবে” জানিয়ে অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেন, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর দায়িত্ব এই সেক্টরের দায়িত্বরতদের, কোর্টে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর দায়িত্ব আইন মন্ত্রণালয়ের-এমন সবাইকে যার যার দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে, সরকারি-বেসরকারি সবাইকে।
সেই-সঙ্গে নির্বাচন হচ্ছে, নির্বাচন হবে-সেখানে দায়িত্ব পালন করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এ দায় তো সবার, কার উপর চাপাবো। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে আমরা যদি অসতর্ক, অসাবধান হই, তাহলে ভবিষ্যৎ খুব ভালো হবে না, বলেন অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল বলেন, সংক্রমণের হার এখনও বাংলাদেশে দুই শতাংশের নিচে ও ১ শতাংশের সামান্য উপরে। কিন্তু এতে করে আমাদের কোনওভাবেই আত্মতুষ্টিতে ভুগবার কোনও কারণ নেই। কারণ, ঘরের দরজাতেই ওমিক্রন কড়া নাড়ছে। কাজেই এই মুহূর্তে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে, করোনা প্রতিরোধে এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। টিকা নেওয়ার পাশাপাশি সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরতে হবে, নিরাপদ দূরত্ব মেনে যদি চলা হয় তাহলে এই অতিমারি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে যাবে।
আমরা মনে করি, সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। আতঙ্কিত না হয়ে সকলকে সচেতন হয়ে ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। ‘মাস্ক আমার, সুরক্ষা সবার’-এই কথা যেন আমরা কোনওভাবেই ভুলে না যাই, বলেন অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম।