রাজস্ব আদায়ে এবার কতটা পিছিয়ে পড়লো এনবিআর

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এবার বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ দিন পর্যন্ত এনবিআরের প্রাথমিক আদায় ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯২২ কোটি টাকায় পৌঁছালেও লক্ষ্যমাত্রা থেকে তা প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা কম। ফলে রাজস্ব ঘাটতির দিক দিয়ে এবার এক নতুন রেকর্ডের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সোমবার (৩০ জুন) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব তথ্য জানান এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।

তিনি বলেন, ‘গতবারের তুলনায় রাজস্ব আদায় বেশি হবে, এটা নিশ্চিত। তবে যেরকম আশা করেছিলাম, সাম্প্রতিক আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডে কিছুটা হোঁচট খেয়েছি। ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘ্নিত হওয়ায় রাজস্ব সংগ্রহেও প্রভাব পড়েছে।’

উল্লেখ্য, গত বছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব আদায় করেছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা।

ঘাটতি এক লাখ কোটি টাকার আশঙ্কা

২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে এনবিআরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা সংশোধন করে নামিয়ে আনা হয় ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়। কিন্তু অর্থবছরের শেষ দিনে (৩০ জুন) সকাল ১০টা পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, শেষ দিনের সরকারি বিল ও ভ্যাট জমা যুক্ত হলে রাজস্বের পরিমাণ কিছুটা বাড়তে পারে, তবে তা ৪ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছিই থাকবে।

বিশ্লেষকদের মতে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঘাটতির পরিমাণ ৬২ হাজার কোটি টাকার বেশি হতে পারে, যা এনবিআরের ইতিহাসে অন্যতম বড় ঘাটতি। বাস্তবতা হলো, সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায়ও ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ১৪ শতাংশ।

আন্দোলন ও প্রশাসনিক অচলাবস্থার প্রভাব

গত দেড় মাস ধরে এনবিআরের একটি অংশ ‘সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ ব্যানারে শাটডাউন ও কর্মবিরতি চালিয়ে আসছিল। এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণসহ প্রশাসনিক সংস্কারের দাবিতে চলা এই আন্দোলনে রাজস্ব সংগ্রহ কার্যত থমকে দাঁড়ায়। কাস্টমস হাউজ, ভ্যাট ও কর অফিসের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত সমাধানের দাবি জানায়।

শেষ পর্যন্ত রবিবার (২৯ জুন) রাতে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’। এরপর রাত থেকেই কর্মকর্তারা কাজে ফিরতে শুরু করেন। সোমবার (৩০ জুন) সকাল থেকে রাজধানীসহ সারা দেশের কাস্টমস, ভ্যাট ও কর দফতরগুলোতে কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে আসে।

এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “চলমান অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার পর আজ সোমবার সকাল থেকেই রাজস্ব অফিসগুলোতে পূর্ণ কর্মচাঞ্চল্য দেখা গেছে। আটকে থাকা বিল, ফাইল ও জরুরি কার্যক্রম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে।”

বড় লক্ষ্য সামনে

২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা—এর মধ্যে এনবিআরের ওপরই নির্ভর করছে ৮৮ শতাংশের বেশি আদায়। অর্থাৎ, বর্তমান কর্মদক্ষতা, অবকাঠামো ও নীতির ভিত্তিতে এ উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এনবিআরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন, করজাল সম্প্রসারণ, কর অব্যাহতি সীমিতকরণ এবং একক ভ্যাট হার প্রবর্তনের মতো উদ্যোগ বিবেচনায় রয়েছে। এছাড়া এনবিআরকে শক্তিশালী করতে জনবল বাড়ানো এবং মধ্যমেয়াদি রাজস্ব কাঠামো (এমটিআরসি) বাস্তবায়নের পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।

চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

বিশ্লেষকদের মতে, এনবিআরের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে বড় বাধা হলো—অব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ঘাটতি। অনেক জায়গায় এখনও কর আদায়ে ম্যানুয়াল প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, যা স্বচ্ছতা ও দক্ষতা দুক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ।

এনবিআর চেয়ারম্যান অবশ্য জানিয়েছেন, “বর্তমানে আমাদের রেভিনিউ রিপোর্টিং সিস্টেমেটিক। ম্যানুয়াল রিপোর্ট করি না। আইবাসে রিপোর্ট হয়, যেখানে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিগার এক। রিকনসিলিয়েশনের প্রয়োজন পড়ে না।”

তিনি আরও বলেন, “আজকের (৩০ জুন) ট্রেজারিতে যে পরিমাণ জমা হবে, তার রিপোর্ট আগামীকাল পাওয়া যাবে। তবে প্রকল্প বিল ও মূসকের সমন্বয় করতে ২-৩ সপ্তাহ সময় লাগবে।”

এনবিআর কর্মকর্তারা আশা করছেন, জুলাই মাসেও কর আদায়ের জন্য বিশেষ ড্রাইভ চালানো হবে, যাতে ট্রেজারিতে আরও অর্থপ্রবাহ নিশ্চিত করা যায়।

ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা

বিশ্লেষকরা বলছেন, এনবিআরের চলমান অচলাবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্রুত প্রশাসনিক সংস্কার ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা জরুরি। ডিজিটাল সেবা, করদাতাবান্ধব পরিবেশ এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে পরবর্তী অর্থবছরের উচ্চ লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব হয়ে উঠবে।

দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও একই কথা বলছেন। চেম্বার নেতারা এনবিআর ও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন—সংকট মোকাবিলায় সহানুভূতিশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার।