বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাগানে গোলাপ চাষি সৈয়দ শামসুল হক

মাসুদা ভাট্টিসৈয়দ শামসুল হক চলে গেলেন নাকি আবার ফিরে এলেন—এ নিয়ে আরও বহুদিন পরে আবার লিখব। আজকে এই মর্ত্যলোক থেকে তার বিদায়পর্ব নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। যদিও এখন তাকে নিয়ে কথা বলার সময় নয়, এখন তাকে আরও পরিপূর্ণভাবে লক্ষ করার সময়। কারণ, তিনি এখন সশরীরে আমাদের মাঝে নেই কিন্তু রেখে গেছেন অফুরন্ত সৈয়দ শামসুল হককে। যে যেভাবে ইচ্ছে, সেভাবেই এই অফুরন্ত ভাণ্ডার উজাড় করতে পারেন চাইলে। গাল দিতে পারেন, ভালোবাসতে পারেন কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করতে পারবেন কি কেউ? কেউ কি পারছেন? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং প্রচলিত গণমাধ্যম প্রতিটি মাধ্যমেই সৈয়দ হককে নিয়ে যে যার মতো আলোচনা করছেন— এখানেই তিনি সৈয়দ শামসুল হক। বাংলা ভাষা-সাহিত্যকে যিনি অত্যন্ত যত্নে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। এই আলোচনা আরও চলবে এবং এক সময় থিতু হলে নতুন করে পাঠ হবে সৈয়দ শামসুল হকের, যেমনটি তারা করেছিলেন এক সময় রবীন্দ্রনাথকে, সেই পঞ্চাশের যুগে।
সৈয়দ হকের সঙ্গে আমাদের জানাশোনা শুরু হয় আশির দশকের অন্তে, যখন আমরা যারা একটু ‘ইঁচড়ে পাকা’ হিসেবে পড়ছি তার বিখ্যাত রচনা ‘খেলারাম খেলে যা’, যার সঙ্গে আমাদের পরিচিতি নিতান্তই শরীরবৃত্তীয় লেখা বলে, যেমন ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’, ‘রাতভর বৃষ্টি’ কিংবা ‘বিবর’। উঠতি সে বয়সের পাঠে সৈয়দ শামসুল হককে ধরতে পারা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি ইচ্ছে করেই ‘আমাদের’ কথা বলছি, কারণ, আমার মতো অনেকেরই সৈয়দ হক পাঠ শুরুর অভিজ্ঞতার মিল রয়েছে বলে আমি মনে করি। বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশে তখন পতনোন্মুখ মধ্যবিত্ত, দেদার কেনা-বেচা চলছে রাজনীতিতে, সমাজে, এমনকি পরিবারেও। মফস্বল থেকে ঢাকায় আসা কোনও তরুণ বা তরুণীর পক্ষে তখন ‘সচেতন’ হওয়া ছিল সত্যিকার ঝকমারি। ঠিক সে সময়ে সৈয়দ হকের ‘বাবর আলি’ চরিত্রকে বোঝার ক্ষমতা তৈরি হয়নি, হয়নি কারণ, এই বাবর আলিদের চেনা গিয়েছিল আরেকটু বড় হওয়ার পরে। মেয়েরা খুব সহজেই বাবর আলিদের চিনতে পারে—এ দাবি করতেই পারি।
কিন্তু টেলিভিশন উপস্থাপক এবং ছেঁড়া গেঞ্জি, স্যুটকেসতত্ত্বকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করার পেছনের কুশীলব হিসেবে বাবর আলিদের চিনতে আরও সময় লেগেছিল, সেকথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। কিন্তু সে সময় একটি প্রশ্ন মাথায় এসেছিল যে, বাবর আলি চরিত্রকে সৈয়দ হক এক ধরনের যৌক্তিকতা দিতে চেয়েছেন, হিন্দু ভারতের বর্ধমান থেকে মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তানের ঢাকায় এনে, যেখানে তিনি ফেলে এসেছেন হিন্দু যুবকের হাতে ধর্ষিতা  বোনের শরীর, চিৎকার আর সঙ্গে করে এনেছেন নারীর প্রতি বেদম ও বেপরোয়া এক আকর্ষণ (নাকি অসুস্থতা?)। যদিও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে এসে বাবর আলি যেসব নারীর সঙ্গে তার অসুস্থতাজনিত আকর্ষণকে ফলপ্রসূ করে। প্রশ্ন উঠেছিল ভেতরে ভেতরে, সৈয়দ কি তার কোনও লেখায় এই বাংলা থেকে ধর্ষণের শিকার হয়ে যাওয়া কোনও হিন্দু নারীর কথা লিখেছেন? আমার সৈয়দ হক-পাঠ এখনও সে প্রশ্ন নিয়ে চলমান। কিন্তু বাবর আলি পাঠে আরেক চমৎকার বিষয় আমাকে দেখালেন সৈয়দ শামসুল হকেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আরেক দিক্পাল লেখক, সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী। তিনি আমাকে বললেন, ‘‘লক্ষ করেছ কি ‘খেলারাম খেলে যা’কে সবাই যৌনতাড়িত উপন্যাস হিসেবে জানলেও ছয় দফাকে উপন্যাসে হকই প্রথম  তুলে এনেছেন’’। গাফ্ফার চৌধুরী প্রায়ই বলতেন যে, বাঙালি মধ্যবিত্তকে (অবশ্যই মুসলিম মধ্যবিত্ত) বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন দিয়েছেন সৈয়দ হক, তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘তাস’-এ, এর আগে কেউ এভাবে বাঙালি মধ্যবিত্তকে দেখেনি বা দেখায়নি।

সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ের বয়স নতুন শতকের দু’বছর আগে থেকে ধরলে মাত্রই দুই দশক। বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশে তার কন্যা শেখ হাসিনা সবেমাত্র সরকার গঠন করেছেন। যে বাঙালি চেতনার কথা আমাদের স্কুল-কলেজে পড়াকালে আমরা কোনও কোনও লেখায় সামান্য উল্লেখ হিসেবে পেয়েছি, সেই জাতীয়তাবোধ সামান্য হলেও সুযোগ পেয়েছে গণমাধ্যমে, আলোচনা-অনুষ্ঠানে। প্রথম স্বৈরাচার ও দ্বিতীয় স্বৈরাচার আমলে জাতীয় দিবসগুলো যখন চরম আনুষ্ঠানিকতায় অত্যন্ত কদর্য হয়ে উঠতো সেটাই কথিত গণতান্ত্রিক যুগের হাতে পড়ে অত্যন্ত নোংরা রাজনৈতিক আচারে পরিণত হয়েছিল। দুঃখজনক সত্য হলো, আমরা এর ভেতরেই বেড়ে উঠতে শুরু করেছিলাম। সুতরাং যখন ৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন তখন বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেহারাগুলো আমাদের সামনে উন্মুক্ত হতে শুরু করে, ততদিনে টেলিভিশনও অনেকটা সহজলভ্য হয়েছে, তাদের লেখনির সঙ্গে চেহারাটাও আমরা চিনতে শুরু করেছিলাম। সৈয়দ হককে আমি বা আমার মতো অনেকেই তখন কখনও রাজপথে, কখনও শিল্পকলায়, কখনও বাংলা একাডেমিতে কিংবা এমনতরো অনুষ্ঠানে দেখেছি। ততদিনে তার লেখনীর সঙ্গে আরও পরিচয় হয়েছে, ভাবাতে শুরু করেছে তার লেখক হিসেবে লেখক তৈরি করার উপদেশগুলো। কিন্তু তার চেয়েও বেশি শান্তি দিয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের জাতীয়তাবোধের সচেতন অবস্থানটি। যদিও তার লেখা পাঠে বারবারই আমার ভেতরে প্রশ্ন উঠেছে নতুন করে তার জাতীয়তাবোধ-এ ‘মুসলমানিত্ব’ কতটা গভীর সেটা নিয়ে। আর পরবর্তী সময়ে তার সমালোচকরাও যখন তাকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলতে শুরু করেছেন যে, কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যকে সৈয়দ হক ‘ঢাকাইয়া’ করায় অত্যন্ত সফল হয়েছেন, তখন প্রশ্নগুলো আরও ঘনীভূত হয়েছে। কিন্তু তাতে সৈয়দ হক পাঠে কোনও বিঘ্ন ঘটেনি কিংবা সাহিত্যরস আহরণে বাধা সৃষ্টি হয়নি। বরং সৈয়দ হকের শব্দচয়ন, ভাষা ব্যবহার পাঠক হিসেবে যেমন, তেমনই লেখক হিসেবে বারবার নিজের অক্ষমতাকেই স্পষ্ট করেছে, নিজেরই কাছে।

কিন্তু যে মুহূর্তে সৈয়দ হকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি ওপরে বলা অক্ষমতা আরও তীব্র হয়েছে। কারণ সৈয়দ হক পরিচিতজনদের কাছে ‘হক ভাই’ হলেও তিনি ঠিক সাধারণ নন, একথা তিনি তার আচারে-আচরণে, কথাবার্তায় সচেতন ভাবেই বুঝিয়ে দিতে চাইতেন কিনা বলতে পারব না, কিন্তু তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটি ঠিক বুঝে যেত। তিনি কথা বলেন কবিতার ভঙ্গিতে, প্রতিটি শব্দ ও বাক্যকে আলাদা করে বুঝিয়ে দেন শ্রোতাকে, যে কারণে তার কবিতা পাঠক কিংবা বক্তৃতা তার লেখার মতোই আকর্ষণীয়। তিনি প্রশ্ন করেন, উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে দেন উত্তর, হতে পারে অনুজ লেখক হিসেবে এটা তিনি আরেকজন লেখকের সঙ্গেই করেন কিন্তু অ-লেখকদের সঙ্গেও আলোচনায় সৈয়দ হককে দেখেছি তিনি নিজস্ব মতামতটি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবেই উপস্থাপন করছেন। লেখাপড়া, জানাশোনা এবং পরিচিতি যখন গভীর শেকড় পায়, তখন যে মানুষ হয়ে যায় বৃক্ষের মতো, কোনো ঝড়-ঝাপ্টা তাকে টলাতে পারে না। বিশ্ব সাহিত্য তো বটেই, তার সময়ের লেখকদের লেখা থেকে অনর্গল বলে যেতে পারতেন সৈয়দ হক, রবীন্দ্রনাথকে মনে হয় তিনি ও তার সময়ের অনেক লেখকই গুলে খেয়েছিলেন, কথায় কথায় তারা রবীন্দ্র কবিতা পাঠে সামনের মানুষটিকে অবাক করে দিতেন। কিন্তু সৈয়দ হক কেবল রবীন্দ্রনাথ নয়, তার সময়ের অখ্যাত দুই-একজন কবির কবিতা থেকে অহরহ আবৃত্তি করতেন, আগ্রহ তৈরি করে দিতেন তাদের কবিতা বা লেখা খুঁজে বের করে পাঠের। সৈয়দ হকের এই গুণটির কথা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন তার সমালোচকরা? না করুন, অসুবিধে নেই। আবারও বলি, কোনও কিছুই স্বীকার করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তাকে পাঠের প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন থাকবে।

কত কথা মনে পড়ে, সব কথা লেখার সময় আজ নয়। প্রায়ই সৈয়দ হকের কাছে আমার প্রশ্ন থাকতো, বাংলা সাহিত্য কি ক্রমশ মারা যাচ্ছে? বিশেষ করে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য কি একটি মৃতপ্রায় প্রপঞ্চের নাম? ধমক খেতাম, কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যেত। এখন আশ্চর্য হই, সৈয়দ হক কি কখনও এই প্রশ্নের সোজাসাপ্টা কোনও উত্তর আমাকে দিয়েছেন? বলেছেন কি দৃঢ়ভাবে, কী বলো এসব? যে ভাষায় নিজে লিখছ, সে ভাষার সাহিত্য নিয়ে এতটা নেতিবাচক হও কী করে? না, সৈয়দ হক এমন কিছু বলেননি কখনও। কিন্তু বলেছেন, বিশাল বাংলার কথা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা, শেখ হাসিনার কথা, জনকের কথা। তিনি কখনও ‘সামনে’ বলতেন না, বলতে ‘সমুখে’, তিনি সমুখে দেখতে পেতেন বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে জাতীয়তাবাদী চেতনায়। কথায় এবং লেখনীতে, তিনি আশাবাদের কথাই বলেছেন। যখন তার ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ পড়ে মুগ্ধতায় ভেসে গিয়ে কলকল করে তার সামনে গিয়ে কথা বলতে শুরু করেছি, তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, ‘পড়েছ তো, বুঝেছো কিছু?’ রাগ হয়েছে সৈয়দ হকের ওপর, কী মনে করেন তিনি নিজেকে? কেন বুঝব না? তিনি এই ব-দ্বীপের ইতিহাস বলেছেন তার সুশীল ও কাব্যময় ভাষায়। কিন্তু এই উত্তর দেওয়ার আগেই বলেছেন, ‘এই উপন্যাস বুঝতে হলে এ মাটির ধরনকে বুঝতে হবে আগে, বুঝলে?’ ব্যক্তিগতভাবে আমি সব সময় বিশ্বাস করি যে, মাটিকে তা সে যে কোনও দেশের মাটিই হোক না কেন, পুরুষের তুলনায় মেয়েরা বোঝে সবার আগে, কিন্তু সৈয়দ হককে সেকথা বলা হয় না। আবার পাতা ওল্টাই ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’-এর, টের পাই, এক অনন্য জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন সৈয়দ হক, যেখানে ধর্ম আছে, যে ধর্মের নাম ইসলাম, কিন্তু এ এক নিজস্ব ইসলাম, আরবভূমি থেকে যা সম্পূর্ণই ভিন্ন, লোকায়ত বাংলাকে তিনি চিত্রিত করেন, পড়তে পড়তে সৈয়দ হককেই দেখতে পাই, জানতে পারি তার পূর্বপুরুষের কথাও, যারা এসেছিল এই বাংলায়, আর ফিরে যায়নি কোনও দিন, সহজিয়া ধর্মকে এখানেই শেকড় দিয়ে গেছেন তারা, সৈয়দ হক সেই সহজিয়া ধর্মের কথা বলেছেন, নতুন জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন, মেনে নিয়েই সেই অমোঘ সত্য যে, ধর্মেই ভাগ করে দিয়েছে এই ব-দ্বীপের মানুষকে, দুধের নহরের মতো নদী বয়ে গেছে এই চরাচরে কিন্তু তা সমুষ্টি হলেও ভাগ করেছে মানুষকে। সৈয়দ হককে সেদিক দিয়ে আমার শেষ জাতীয়তাবাদী লেখক মনে হয়, মনে হয় তিনি যা সৃষ্টি করে গেছেন, এরপর যারা লিখবেন, তাদের শুরু করতে হবে সেখান থেকেই, যেখানে তিনি শেষ করেছেন; নাকি শুরু করেছেন? ধর্মের ভাগে মেনে নেওয়া জাতীয়তাবাদ এবং তার পরেই বুঝতে পারা ভুলের ভেতরে নতুন বোধের জন্ম নেওয়া পাহাড় এবং তার সংলগ্ন সমতলে ধর্মের ক্ষেতে লোকায়ত ও সহজিয়া গোলাপের চাষ, মাজারের পাশে গোলাপগন্ধী আগরবাত্তি—না সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে আমার আরও কথা বলার আছে, আরও আছে সৈয়দ হককে জানার ও বোঝার বিষয়।

লেখক: কলামিস্ট

masuda.bhatti@gmail.com