X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

একজন নিরীহ পথচারীর মৃত্যু ও গোলাপবাগে হতাশার চাষ

মাসুদা ভাট্টি
১১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৭:৪৩আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৭:৪৩

১০ ডিসেম্বরের পরে কী হবে? বিএনপির একজন সাবেক সংসদ সদস্য এবং এককালে সক্রিয় নেতাকে একটি টিভি চ্যানেলের সঞ্চালকের এই প্রশ্নে তিনি সহাস্যে বলেছিলেন, ‘কী আর হবে ১১ ডিসেম্বর আসবে!’ সত্যিই তাই, ১১ ডিসেম্বর এসেছে এবং দেশ যথারীতি তার পুরোনো ছন্দে ফিরে গেছে। অথচ এই ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে বিগত দুটি মাস কী ভয়ংকর আতঙ্কই না তৈরি করা হয়েছিল জনমনে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও এ দেশের রাজনীতি ও রাজনীতির ধরন যে একটুও বদলায়নি এবং এখনও যে রাজনীতির একমাত্র পুঁজি সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করা– তা আরও একবার প্রমাণিত হলো।

১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে আতঙ্ক সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল যখন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এলিট প্রতিষ্ঠান র‌্যাব-এর ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় এবং বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সরকার-বিরোধিতার একটি মওকা পেয়ে বসে। হয়েছিল তাই। সারা দেশে একগুচ্ছ দাবি নিয়ে বিএনপি সমাবেশ আয়োজন করে এবং সেখানে অভাবনীয় জনসমাবেশ ঘটতে শুরু করে। সে সময়ই ১০ ডিসেম্বরকে বেছে নেওয়া হয় সরকার পতনের জন্য চূড়ান্ত রূপরেখা ঘোষণার তারিখ হিসেবে। কিন্তু বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর নেতাকর্মীরা ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে যে গুজবটি সফলভাবে প্রচার করতে সক্ষম হয় তা হলো, ১০ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য কয়েকটি শক্তিশালী পশ্চিমা দেশ থেকে সরকারের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আসবে। যেহেতু ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস সেহেতু এই দিবসকেই বেছে নেওয়া হবে বাংলাদেশের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জন্য। আর বিএনপি নেতৃত্বের কার্যত মারমুখী অংশ এই দিনটিতে ঢাকা দখল, তারেক জিয়ার প্রত্যাবর্তন এবং সর্বোপরি দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ বদান্যতায় মুক্ত থাকা বেগম খালেদা জিয়াকে সমাবেশে হাজির করার ঘোষণা দিয়ে বসেন। বিএনপি নেতৃত্ব ক্রমাগত বলতে থাকেন যে ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে দেশ পরিচালিত হবে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার নির্দেশে।

ফলে সরকারও নড়েচড়ে বসে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে এই দিনটিকে নিয়ে সরকার তথা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও চরম উসকানিমূলক বক্তব্য আসতে থাকে। একথা সত্য যে সংসদে গুরুত্বহীন বিএনপিকে আওয়ামী লীগ সরকার কখনোই ‘গুরুত্বহীন’ হতে দেয়নি। বিগত ১৪ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতিকদের বক্তব্যে, বিরোধিতায় ও আচরণে বাঁচিয়ে ও টিকিয়ে রেখে আওয়ামী লীগ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে কী দেয়নি সে হিসাব সময় করবে কিন্তু এ কথাও সত্য যে বিএনপি ১০ জানুয়ারি নিয়ে এক পা এগোনোর বক্তব্য দিলে সরকারপক্ষ তিন পা এগিয়ে নিয়ে গেছে দিনটিকে ঘিরে উত্তেজনা তৈরিতে।

সর্বশেষ যখন সমাবেশের স্থান নিয়ে টানাপড়েন শুরু হলো তখন শুরুতেই সরকারের ছেড়ে দেওয়া চালে বিএনপি প্রথম ভুলটি করে বসে। তারা সরকারের দেওয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে বেছে না নিয়ে নয়া পল্টনেই সমাবেশ করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। কিন্তু এ কথা তো জানাই ছিল যে বিএনপির মতো সফল আন্দোলনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য না থাকা দলের পক্ষে নিজেদের জেদে অটল থাকা সম্ভব হবে না; এরকম কোনও নজির আমরা অতীতে দেখিনি যে গণ-আন্দোলনে বিএনপি বিরাট কোনও সফলতা দেখাতে পেরেছে। ৫ মে ২০১৩ সালে হেফাজতকে ঢাকায় এনে সরকার পতনের যে স্বপ্ন বেগম খালেদা জিয়া দেখিয়েছিলেন দেশবাসীকে সেই স্বপ্ন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়ার পর সরকারই বা কেন শাপলা চত্বরে গিয়ে শেষ হওয়া নয়া পল্টনকে বিএনপির জনসভার জন্য ছেড়ে দেবে সে প্রশ্ন তো তোলাই যায়। ফলে নয়া পল্টনে পুলিশ গিয়ে বোমা পেলো নাকি খিচুড়ি পেলো তা মুখ্য প্রশ্ন নয়, মূল প্রশ্ন হলো বিএনপি কেন হঠাৎ এত আশাবাদী হয়ে উঠেছিল?

ধরেই নিচ্ছি যে বিদেশি প্ররোচনায় বিএনপি স্থান নিয়ে এতটা অনড় অবস্থানে ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই অনড় অবস্থান তো ধরে রাখতে পারেনি বিএনপি। ফলে সমাবেশের স্থান নিয়ে রাজনৈতিক পরাজয় শুরুতেই হয়ে যাওয়ায় ১০ ডিসেম্বরের উত্তেজনা খানিকটা হলেও থিতিয়ে যায় এবং গোলাপবাগ মাঠের মতো একটি অখ্যাত ও অচেনা জায়গায় বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়, বিএনপি বাধ্য হয়ে মেনেও নেয়। ঢাকা শহরের বাসিন্দাদেরই কতজন গোলাপবাগ মাঠ চেনেন সে প্রশ্ন পাঠক নিজেই নিজেকে করে দেখতে পারেন। অথচ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া অনুমতি মেনে না নিয়ে ১০ ডিসেম্বর নয়া পল্টনে সমাবেশ নিয়ে অনড় থাকায় একজন পথচারীর মৃত্যুসহ যতটুকুই ক্ষতি হয়েছে তার সবটুকুই হয়েছে বিএনপিরই। বিএনপি মহাসচিব ও মির্জা আব্বাসসহ আরও ৫০০ নেতাকর্মীর গ্রেফতার তো অবশ্যই নিন্দনীয় এবং হতাশাজনক।

এ দেশের রাজনীতি এখনও এতটা সভ্য ও স্বস্তিদায়ক হয়ে উঠতে পারেনি যে যুযুধান দু’পক্ষের মধ্যে কে ন্যায্য আর কে অন্যায্য তা নির্ধারিত হয়ে যাবে রাতারাতি। ৫ মে ও শাপলা চত্বরের স্মৃতি জনমনে চাগাড় দিয়ে উঠেছে ১০ ডিসেম্বরকে ঘিরে, ফলে সরকারের অতিরিক্ত বাধাপ্রবণ হয়ে ওঠাকেও কেউ কেউ ন্যায্য মনে করেছেন। বিএনপি হয়তো আশা করেছিল যে তারপরও এ শহর ভেসে যাবে গণমানুষের প্রবল উপস্থিতিতে। অথচ নিরপেক্ষ বিশ্লেষক ও বিএনপি’র পক্ষে ক্রমাগত প্রচার চালানো গণমাধ্যমও স্বীকার করছে যে এযাবৎ যত বিভাগীয় সমাবেশ করেছে তারমধ্যে সবচেয়ে কম উপস্থিতি হয়েছে অতি-ঘোষণা ও অতি আশাবাদের গোলাপবাগে, অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর, রাজধানী ঢাকা শহরে। তারচেয়েও বড় কথা হলো, এই সমাবেশ থেকে বিএনপি কর্মী-সমর্থক ও দেশবাসীর জন্য যে কাঙ্ক্ষিত ঘোষণা আসার কথা ছিল তার কিছুই যে আসেনি বা হয়নি সে কথাও ‘জীবনবাজি’ রেখে সমাবেশে উপস্থিত হওয়া বিএনপি নেতাকর্মীরাই গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।

১০-দফা ঘোষণা সংবলিত একটি দাবিনামা এবং মেঠো সমাবেশে মেঠো ঘোষণা হিসেবে আসা বিএনপির সবে সাত নীলমণি সংসদ সদস্যদের সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা ছাড়া গোলাপবাগ আর কিছুই প্রসব করতে পারেনি। পর্বতের মূসিক প্রসব বলে একটি প্রবাদ বাংলায় রয়েছে কিন্তু গোলাপবাগে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ যেন সেই প্রবাদকেও হাস্যকর করে দিয়েছে। সরকার পক্ষ এখন আবারও সুযোগ পাবে বিএনপির আন্দোলন নিয়ে হাস্য-পরিহাসের এবং জনগণ তথা বিএনপির বিশাল সমর্থকগোষ্ঠীও ১০ ডিসেম্বরকে একটি ‘হতাশ’ দিন হিসেবে মনে করে নিয়ে ভবিষ্যতে এরকম কোনও আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিতে অনাগ্রহী হবে। নির্বাচনের আরও এক বছর বাকি, বিএনপিকে নিজেদের উত্থাপিত দাবি এবং লক্ষ্য অর্জনে আরও অনেকটা পথ যাবে কিন্তু গোলাপবাগের শুরুটা যে আসলেই চরম হতাশাজনক হলো তার সঙ্গে নিশ্চয়ই বিএনপি নেতাকর্মীরাও একমত হবেন।

গোলাপবাগে ঘোষিত ১০-দফা নিয়ে আলোচনার নতুন কিছু নেই। কারণ এসব সবই বিএনপি বিগত বছরগুলোতে দলীয় সভা থেকে টকশো সর্বত্র বলে আসছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে কার্যত বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবির  (যেভাবেই হোক, ভরাডুবি যে হয়েছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই) পর বিএনপির আট জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য শপথ গ্রহণ করবেন কী করবেন না তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চললো কিছু দিন। শেষ পর্যন্ত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া বাকি সাত জন শপথ নিলেন। ঐক্যফ্রন্টের হয়ে বাকি যারা বিজয়ী হয়েছিলেন তারা প্রথম চোটেই শপথ গ্রহণ করেছিলেন। ফলে বিএনপির পক্ষে সংসদের বাইরে থাকাটা হাস্যকরই হতো, মির্জা ফখরুলের শপথ গ্রহণ না করাটা যেমন হাস্যকর ছিল এ কারণে যে দলীয় সদস্যদের তিনি সংসদের বাইরে রাখতে পারেননি, তারা লন্ডনের নির্দেশেই সংসদে যোগ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। দীর্ঘ চার বছর পার হলো। সংসদ সদস্য হিসেবে বিপুল ভাতাদিসহ বরাদ্দকৃত অর্থ নিয়েছেন এবং শুল্কমুক্ত গাড়ি-সুবিধা বিএনপির কোনও সদস্য গ্রহণ করেননি বলে জানা যায়নি। কেউ কেউ সরকারি প্লট-সুবিধা নিতে গিয়ে সংবাদ-শিরোনাম হয়েছেন এবং এও এখনও জানা যায়নি যে এই সদস্যরা সরকারি প্লট নিয়েছেন কী নেননি। নিশ্চয়ই সরকারপক্ষ এখন সেসব খুঁজে বের করবে। ফলে নির্বাচনের একবছর আগে ৩০০ আসনের সংসদ থেকে সাত জন সদস্য চার বছর সুবিধাদি নেওয়ার পর পদত্যাগ করলে জনগণের কোন উপকারটি হবে সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলাও আসলে অর্থহীন। আগামী এক বছর সংসদ আরও একটু নিষ্প্রভ হওয়া ছাড়া।

প্রশ্ন তোলায় এবং সরকারপক্ষকে খানিকটা ‘এলোমেলো’ করায় বিএনপি সদস্যদের কৃতিত্বের প্রশংসা যদিও করতেই হয়।

এছাড়া গোলাপবাগে ঘোষিত ১০-দফায় আর যে প্রশ্নটি আলোচনার দাবি রাখে তাহলো হঠাৎ কেন বিএনপি সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯-এর বাতিল চাইলো। এই সময় বিএনপি তথা দেশের বিরোধী-রাজনীতির সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সঙ্গে সংহতির খাতিরে বিশ্বের দেশে দেশে সন্ত্রাস দমন আইন করতে বাধ্য হয় সরকারগুলো। বাংলাদেশে ভয়ংকর জঙ্গিবাদের উত্থানে ও দমনে এই আইনের প্রয়োজনও ছিল সন্দেহাতীতভাবে। অথচ আজ এত বছর পর বিএনপি তাদের সরকার-পতনের দাবিতে উত্থাপিত দফাসমূহে এই আইনের বিলুপ্তি চেয়েছে দেখে অবাকই লাগছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নিশ্চয়ই বিষয়টি ভালোভাবে নেবে না। এমনিতেই ১০ তারিখ বিএনপি-কাঙ্ক্ষিত নিষেধাজ্ঞার তালিকায় বাংলাদেশ না থাকায় বিএনপির হতাশা ছিল লক্ষণীয়। এমনকি যুক্তরাজ্যেও র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আনতে জামায়াতের লবিস্ট ও আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তাদের ‘নিজস্ব সংবাদমাধ্যম’ আল-জাজিরায় বিস্তর কান্নাকাটি চলছে। ফলে সত্যিকার অর্থেই যে ১০ ডিসেম্বরের পর ১১ ডিসেম্বর কেবল এসেছে এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ একটি ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন জনিত আতঙ্ক থেকে নতুন একটি সকালে শ্বাস নিতে পেরেছে তার জন্য নিঃসন্দেহে জনগণ সৃষ্টিকর্তাকে আজ ধন্যবাদ জানাচ্ছে।

শুধু একজন নিরীহ পথচারীর মৃত্যুতে তার পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি ছাড়া গোলাপবাগের অর্জন সত্যিই কিছু নেই। এখন রাষ্ট্রের উচিত নিহত পথচারীর পরিবারকে সর্বোচ্চ পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

লেখক: এডিটর ইনচার্জ, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রিমিয়ার ব্যাংকের নতুন এমডি মোহাম্মদ আবু জাফর
প্রিমিয়ার ব্যাংকের নতুন এমডি মোহাম্মদ আবু জাফর
দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী
দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী
উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে কাজ করার আহ্বান
উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে কাজ করার আহ্বান
কোড সামুরাই হ্যাকাথনের দ্বিতীয় পর্বের ফল প্রকাশ, ৪৬ দল নির্বাচিত
কোড সামুরাই হ্যাকাথনের দ্বিতীয় পর্বের ফল প্রকাশ, ৪৬ দল নির্বাচিত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ