একদল ‘দানবের’ হাতে রাষ্ট্রও জিম্মি!

আমীন আল রশীদ‘দানব’ শব্দটি সচেতনভাবেই ব্যবহার করছি। কারণ গণপরিবহনের চালকদের (কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে) মধ্যে মানবিকতা বলে কিছু আর অবশিষ্ট আছে কিনা, তা আপনি শুধু ঢাকা শহরের অভ্যন্তরীণ রুটের বাসে নিয়মিত কিংবা মাঝেমধ্যে চলাচল করলেই টের পাবেন।
একই রুটের বিভিন্ন কোম্পানির গাড়ির মধ্যে এমনকি একই একই রুটে অভিন্ন কোম্পানির গাড়ির চালকরাও যেভাবে আগে যাওয়া কিংবা পেছনের গাড়িকে সাইড না দেওয়ার অসুস্থ খেলায় মাতে, তা কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা যেভাবে জ্যামের ভেতরেও অব্যাহতভাবে হর্ন বাজাতে থাকে, তাতে সুস্থ-সবল মানুষও আর সুস্থ থাকে না। আবার এ নিয়ে তাদের প্রশ্ন করলে তারা যে ভাষায় উত্তর দেয়, তাতে অনেক সময়ই খটকা লাগে যে, আমি আসলে কোনও মানুষের সাথে কথা বলছি কিনা!
তারা যখন এরকম রেসে নামে, তখন তাদের বিবেচনায় একবারও এটি আসে না যে, গাড়ির ভেতরে বসে বা দাঁড়িয়ে অন্তত ৫০জন মানুষ, যাদের মধ্যে বৃদ্ধ, নারী, শিশু এমনকি অসুস্থ মানুষও থাকতে পারে। তারা যখন আরেকটা গাড়িকে পাশ দিয়ে ঘসা দিয়ে চলে যায় তখন ঝরঝর করে জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ে কোনও যাত্রীর শরীরে।  যাত্রীরা তখন সমস্বরে ‘…রের বাচ্চা’ বলে তাদের গালি দেয়, কিন্তু তাতে তারা কর্ণপাত করে না। তাদের লজ্জা লাগে না।
প্রশ্ন হলো, অনেক সংগঠন যাত্রী নিরাপত্তার কথা বলে বিভিন্ন মানববন্ধন বা আন্দোলন-সংগ্রাম অথবা সংবাদ সম্মেলন করলেও গণপরিবহনের শ্রমিকদের তারা কি কখনও মানবিক করার উদ্যোগ নিয়েছে? তারা কি কখনও চালকদের এই বার্তাটি দিয়েছে যে, আপনার সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে গাড়ির ভেতরে থাকা এতগুলো মানুষের জীবন। আপনি যদি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামেন, তাহলে এতগুলো লোকের প্রাণসংহার হতে পারে। আপনার কোনও বন্ধু বা আত্মীয়ই হয়তো অন্য কোনও গাড়িতে থাকতে পারে এবং এরকম অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে সেও নিহত হতে পারে? রাষ্ট্র কি কখনও এই চালক-হেলপার বা সুপারভাইজারদের কখনও মোটিভেট করার কোনও উদ্যোগ নিয়েছে? আমরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফ্লাইওভার বানাই, হাজার কোটির পদ্মা সেতুর অপেক্ষায় থাকি, জাপান-চীন-ভারত থেকে ঝকঝকে গাড়ি আমদানি করি, কিন্তু সেই ফ্লাইওভার কিংবা সেই পদ্মা সেতুতে ওই গাড়িগুলো যারা চালাবেন, অর্থাৎ যাদের হাতে আমরা স্টিয়ারিং তুলে দেব, তারা কারা? তারা কতটা মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ, তারা মানুষের জীবনের মূল্য কতটুকু বোঝে, সেই পরীক্ষা কি রাষ্ট্র কখনও নিয়েছে?

মানবিক গুণাবলি কী জিনিস, কেন এটি প্রয়োজন-এটি আমারা মনে হয় সবার আগে শেখানো দরকার পাবলিক পরিবহনের শ্রমিকদের। বিশেষ করে লোকাল বাসের শ্রমিকদের। কারণ দূরপাল্লার বড় বড় কোম্পানির চালক হতে গেলে ন্যূনতম তাকে রাস্তার নিয়ম-কানুন জানতে হয়। বৈধ লাইসেন্স থাকতে হয়। একটা মিনিমাম ওরিয়েন্টেশন তাদের রয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু লোকাল রুটের চালকদের একটা বড় অংশই হেলপার থেকে ড্রাইভার। কোনও ধরনের বৈধ লাইসেন্স নেই। গাড়ি চালাতে চালাতে সে ড্রাইভার। রাস্তায় গরু-ছাগল চিনলেই অর্ধশত মানুষ নামের মুরগি গাড়ির ভেতরে তুলে নিয়ে রাজপথে ছুট দিতে পারে। ঢাকার বিভিন্ন রুটে যেসব লেগুনা চলে, তার একটা বড় অংশের চালকই বয়সে কিশোর। ড্রাইভিং লাইসেন্স তো দূরে থাক, গাড়ি চালানোর ন্যূনতম জ্ঞানও তাদের নেই। অথচ তারা গাড়ির ভেতরে ১২/১৪জন লোক নিয়ে তারা সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে। আর মানুষও বিকল্প না থাকায় বা কম খরচে গন্তব্যে যেতে পারায় উঠে পড়ে এইসব চলন্ত অ্যাটম বোমায়।  

অনুসন্ধানে দেখা যাবে, সড়কে মৃত্যুর যে মহামারী তার পেছনে প্রধানত দায়ী এইসব অদক্ষ এবং অমানবিক চালক; যারা কোনও ধরনের নিয়ম-কানুন জানে না বা জানলেও তার ধার ধারে না। তারা নিজেদের রাস্তার রাজা মনে করে। যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে আদালত কোনও চালককে যাবজ্জীবন সাজা দিলে তারা এর বিরুদ্ধে রাজপথে নামে। তারা আদালতের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। তারা সারা দেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, তারা অ্যাম্বুলেন্সও ভাঙে। তারা মোটর সাইকেল থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। তাদের সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের বৈঠকে বসতে হয়। তাদের দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়।

আদালতের রায় পছন্দ না হলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার বিধান রয়েছে। সেখানে তারা যদি নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে কিংবা যুক্তি-তর্ক দিয়ে আদালতকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, এটি যে মাপের অপরাধ, তাতে এটি যাবজ্জীবন হয় না, তাহলে সেই রায় বদলে দেওয়ার এখতিয়ারও উচ্চ আদালতের রয়েছে। কিন্তু দানবেরা সেই পথে না গিয়ে সারা দেশের মানুষকে জিম্মি করে, আদালতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে থোড়াই কেয়ার করে সব যানবাহন বন্ধ করে দিতে পারে।

যোগাযোগের এই দুনিয়ায় মানুষের পক্ষে একদিনও ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়। আবার সবার ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। থাকলে তারা সেটিও চালাতে দেয় না। ভাংচুর করে। অর্থাৎ তারা আদালতের সিদ্ধান্ত বদলাতে চায় সহিংসতার মাধ্যমে; আইনি পথে না গিয়ে। এটি সুস্পষ্টভাবেই আদালত অবমাননা এবং এর জন্য তাদের কী শাস্তি হবে অথবা আদৌ হবে কি না, তা আমরা জানি না। তবে এটুকু জানি, সড়কে মৃত্যুর মহামারী থামাতে হলে এই দানবদের আগে মানুষ বানাতে হবে। দানবেরা কখনও মানুষের জীবনের মূল্য বোঝে না। তারা বোঝে অন্যের আগে যেতে হবে। তারা বোঝে পেছনের গাড়িকে সাইড না দিলে দশজন যাত্রী আগে পাওয়া যাবে। তারা পয়সাটা বোঝে। কিন্তু তার গাড়ির ভেতরে যে সম্ভাবনাময় তরুণ বসে আছে, যে গর্ভবতী মা তার অনাগত সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে, যে বৃদ্ধ বহুদিন পর তার  প্রিয় সন্তানের কাছে যাচ্ছে, সেই লোকগুলোর কথা ওই চালকের মাথায় থাকে না। ফলে তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা কিংবা নিয়ম না মানা অথবা তার অবহেলায় ওই তরুণের, ওই গর্ভবতী নারীর কিংবা ওই বৃদ্ধের স্বপ্নের অপমৃত্যু হয় সড়কেই। লাল রক্তে ভেসে যায় তার সবুজ স্বপ্ন।

জীবনের এমন অপচয়ের জন্য যে দানবেরা দায়ী-তারা বোধ হয় এখন রাষ্ট্রেরও ঊর্ধ্বে। তাদের পেছনে থাকে রাষ্ট্রেরই কিছু খান সাহেব, যারা নিজেদের ব্যবসা আর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে দানবদের ব্যবহার করে। ফলে তারা যখন খোদ বিচারব্যবস্থার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ করে, তখন আমরা দেখতে পাই, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় কালো পিচের ওপরে পড়ে থাকা রক্তাক্ত তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীর আমাদের ডেকে বলেন, সড়কে হত্যার বিচার চেয়ে কোনও লাভ নেই।

লেখক: সাংবাদিক