আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক সমর্থকদের কী হবে?

মাসুদা ভাট্টিযারা আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন ও বিশ্বাস করেন যে, বাংলাদেশের কল্পিত অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সঙ্গে দলটির রাজনীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ, তারা এখন কী করবেন? এই প্রশ্ন এতদিন আড়ালে-আবডালে উঠলেও এখন তা প্রকাশ্য রূপ নেবে বলে আমার ধারণা। এটি এ কারণে যে, রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা হয়তো দেখতে ও বুঝতে পেরেছেন, বাংলাদেশের একটি বিশাল ভোট ব্যাংককে কোনোভাবে চটিয়ে বা ক্ষমতাবলয় থেকে দূরে রেখে কোনোভাবেই এদেশে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিটি শক্তিই এমনকি বামপন্থী দলগুলোও একথা জোর দিয়েই বুঝেছে যে, এদেশে ধর্মকে বাদ দিয়ে রাজনীতি করা যাবে না বা রাজনীতিতে টিকে থাকা যাবে না। কেন সেটা সম্ভব নয়, তা নিয়ে বেশি কথা না বলে শুধু এটুকুই বলা যায় যে, পাকিস্তানের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার ভেতরই এর উত্তর নিহিত। বাঙালি মুসলমান ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে চেয়েছিল এবং তারপর রাতারাতি তারা নিজেদের অবস্থান বদলে ধর্মনিরপেক্ষ সেজে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিল। এ কারণেই তারা এখন মনে করেন, তারা আসলে ভুল করেন কিংবা কল্পনার রাজ্যে বসবাস করেন। যে কল্পনায় তারা বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান। এই চাওয়াদের সংখ্যা ক্রমাগত কমে আসছে বলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে আবার একটি গোষ্ঠী বাঙালির ধর্মীয় অবস্থানটি বুঝতে পেরে আগে থেকেই অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান ত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিববিদ্বেষী হয়েছেন এবং তাকে সপরিবারে হত্যার প্লট তৈরিতে সহায়তা করেছেন। এখন এই পক্ষটি এদেশের বিশাল তরুণ সমাজকে সশস্ত্র ইসলামি-বিপ্লবের পথে টেনে এনে কখনও আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী কিংবা কখনও তাদের হাতে চাপাতি তুলে দিচ্ছেন। তার মানে হচ্ছে, এই বাংলাদেশের একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে এবং এই মৌলিক পরিবর্তন কোনোভাবেই ভালো কোনও ইঙ্গিত আমাদের দিচ্ছে না ভবিষ্যতের।
ফিরে আসি আওয়ামী লীগের কথায়। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ও তার অনুসারী জাতীয় চার নেতার মৃত্যু অবধি অসাম্প্রদায়িক থেকে তাদের বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বস্ততা দেখিয়েছেন। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর যে ঘাত ও প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে হয়েছে, তাতে দলটি যে এখনও টিকে আছে, তা নিয়ে অনেকেরই বিস্মিত হওয়ার কথা। এই টিকে থাকার ইতিহাসে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হয়েছে পাকিস্তানি স্বৈরাচারের বাংলাদেশি ভার্সনকে দুই দু’বার। আবার এই স্বৈরাচারী শাসকরা যে রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, তাদের তারা দীক্ষিত করেছেন অর্থ, ধর্ম ও অস্ত্রের মন্ত্রে, অর্থাৎ যেকোনও প্রকারে অর্থ উপার্জন (দেশের স্বার্থ বিকিয়ে হলেও), ধর্মকে রাজনীতিতে যথেচ্ছ ব্যবহার করা (তাতে প্রয়োজনে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াও যায়েজ, যেমন বার বার ভারতের কাছে বাংলাদেশকে বিক্রি করে দেওয়া ধুয়া তোলা) এবং অস্ত্রের ভাষায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা যা ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান করেছেন। ২০০৪ সালে তার স্ত্রী ও ছেলে করেছেন। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগকে টিকে থাকার রাজনীতি করতে গিয়ে যে সব আপস করতে হয়েছে, ক্ষমতায় গিয়েও দলটি সেই আপসের রাজনীতি থেকে সরতে পারেনি। তারা যেমন পারেনি দেশের ভেতর অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে, ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা করতে, অর্থ ও অস্ত্রের রাজনীতিও তারা সেই অর্থে কমাতে সক্ষম হয়নি। এর ফলে দেশের মানুষের সামনে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আলাদা কোনও প্রতিকৃতি সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন দলটি দেশের অর্থনীতিকে বদলে দেওয়ার লক্ষ্যে যে কাজ করে যাচ্ছে, তা মানুষ আপাত মেনে নিলেও মনোজাগতিক প্রয়োজনে যে সব বদল প্রয়োজন, যেমন জঙ্গিবাদের বিপক্ষে দাঁড়ানোর জন্য যে কার্যকর পদক্ষেপ একটি রাজনৈতিক শক্তির কাছ থেকে আসা প্রয়োজন ছিল, আওয়ামী লীগ সেটা দিতে কার্যত সক্ষম হচ্ছে না। ফলে ভোটের রাজনীতির দোহাই দিয়ে তারা হেফাজতের সঙ্গে গিয়ে আপস করছে, কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিতে হচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত দেশের ধর্মাশ্রয়ী শক্তিটিকে ডেকে এনে তাদের সামনে স্বীকার করতে হচ্ছে যে, হাইকোর্টের সামনে কোনও গ্রিক দেবীর ভাস্কর্যকে তিনি নিজেও সমর্থন করেন না। মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে যে মৌলিক একটি পার্থক্য রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করারও এখন আর প্রয়োজন থাকছে না। দেশের সর্বোচ্চ জায়গাটি থেকেই যেহেতু এর বিরোধিতা এসেছে, সেহেতু এই জায়গা থেকে এই ভাস্কর্যকে সরিয়ে ফেলতেই হবে, আজ হোক কি কাল হোক। প্রশ্ন হলো, এত ছাড় দিয়েও কি এই ধর্মাশ্রয়ী শক্তির সমর্থন আওয়ামী লীগ পাবে? সে উত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় এসেছে, সেটা বলেই আজকের লেখার ইতি টানব।
আগেই বলেছি যে, আওয়ামী লীগ একটি মাল্টিক্লাস সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল। তাদের সমর্থন দেয় দেশের প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষ, কখনও ভালোবেসে, কখনও স্বার্থে। কিন্তু একদল মানুষ আছে যারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয় এটা ভেবে যে, এই দলটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কথা বলে। তারা এটা জেনে ও বুঝেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয় যে, ভোটের রাজনীতির কাছে আওয়ামী লীগ বার বারই তাদের সমর্থনকে পাশ কাটিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মবিশ্বাসী ভোটারদের পক্ষ নেবে। একটু আগে একথাও বলেছি যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাদের আওয়ামী লীগ একথা বোঝাতে চরম ব্যর্থ হয়েছে যে, একইসঙ্গে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ হয়েও ধর্ম পালন করা সম্ভব এবং এদেশকে একটি বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। মজার ব্যাপার হলো, একেবারেই সংখ্যালঘু অথচ সমাজে প্রতিষ্ঠিত সেক্যুলার শক্তিটি এই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছে এটা ভেবে যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাঙালির এই ধর্মাশ্রয়ী শক্তিটিকেও রাজনীতি থেকে বিদায় দিয়ে একটি বহুত্ববাদী রাজনীতির জায়গা তৈরি করবে, যেখানে মানুষ তাদের পছন্দকে বেছে নিতে সক্ষম হবে ২০১৯ সালে।
কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ যে কাজটি করে ফেললো বা যে পথে আগাচ্ছে, তাতে এই সংখ্যালঘু ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী-সমর্থকদের অবস্থানটি আসলে কী দাঁড়ালো? তারা যে ‘না থাকলো ঘরে, না থাকলো দুয়ারে, না থাকলো ঘাটে’- অবস্থার ভেতর পড়লো, তা হয়তো আওয়ামী লীগ বুঝতেও পারছে না বা বুঝতে চাইছে না। কারণ ভোটের রাজনীতিতে তাদের মূল্য সামান্যই। কিন্তু তাদের শক্তি যে আছে, সেকথাও আওয়ামী লীগ দ্রুতই বুঝতে শুরু করবে বলে আমার বিশ্বাস।
মজার ব্যাপার হলো, সেদিনের পর থেকে আওয়ামী লীগের এই সমর্থকদের বিভিন্ন ভাবে খোঁচা দেওয়া শুরু হয়েছে। লক্ষ করা যাচ্ছে যে, খোঁচা দেওয়ার কাজটি তারাই মূলত করছেন, যারা এক সময় বাম রাজনীতি করতো কিন্তু এখন তারা হেঁজে-মজে-পঁচে গেছেন, ধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন কিংবা নিও-লিবারেল সেজে তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনকেও ‘স্পেস’ দেওয়ার পক্ষে ওকালতি করে চলেছে অনবরত। আরও মজার ব্যাপার হলো, আওয়ামী লীগ যখন ২০১৩ সালে হেফাজতকে ঢাকা থেকে বের করে দিয়েছিল, তখনও তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেছেন, আবার যখন আওয়ামী লীগ হেফাজতকে গণভবনে ডেকে ভালোমন্দ খাইয়ে তাদের হাতে বাংলাদেশকেই তুলে দিচ্ছে, তখনও তারা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করছেন। এই কাজটি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার করার কথা ছিল আসলে, কেন শেখ হাসিনা করে ফেললেন, তাতেই তারা বিরক্ত। বোধ করি আর সে কারণেই তারা আওয়ামী সমর্থকদের এই দুর্বল অংশকে টার্গেট করে হাসিঠাট্টা করছেন। হয়তো আর কিছুদিন পরেই এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সমর্থকদের গলায় ছুরি বসাতেও তারা দ্বিধাবোধ করবেন না। কেউই করবে কি? হয়তো সেদিন গণভবনে যা ঘটলো তার অভিঘাত বাংলাদেশে ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরও গভীরভাবে পড়তে শুরু করবে, হয়তো আওয়ামী লীগ তাদের হাত করে আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পারও হয়ে যাবে, হাইকোর্ট থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে আওয়ামী লীগ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলামনের মনে তাদের প্রতি পুষে রাখা বিদ্বেষ কিছুটা হলেও হয়তো কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হবে কিন্তু আওয়ামী লীগের এই ক্ষুদ্র সমর্থকগোষ্ঠীটির কী হবে?
আওয়ামী লীগের ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে পাই যে, আওয়ামী লীগকে সবসময়ই এরকম একটি উদার, গণতন্ত্রমনা, কাজে ও চিন্তায় অসাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সমর্থন দিয়ে এসেছে। তারা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, দলটির দুঃসময়ে- যেমন ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার পর শেখ হাসিনার পাশে যারা ছুটে গিয়েছিলেন, দেশে-বিদেশে যারা আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিলেন, তারা আসলে এই ক্ষুদ্র সমর্থকরাই। আজ তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও অপাঙ্‌ক্তেয়। যারা ইতিহাস ভুলে যায়, তাদের প্রতি ইতিহাসও খুব নির্মম আচরণ করে।
লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক।

masuda.bhatti@gmail.com