‘গুম’ শব্দটি যেদিন থেকে ধার হারালো!

মাসুদা ভাট্টিবাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিবাদকারীদের মধ্যে নিজেকে অন্যতম মনে করি। কারণ আমি বিশ্বাস করি যে, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনও ভাবেই মূল সমস্যার সমাধান হতে পারে না। বরং বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ভেতর দিয়ে সমাজে ও রাষ্ট্রের শরীরে জন্ম নেওয়া সন্ত্রাস নামক ক্ষতকে ক্রমশ দূর করা যায় বলেই মনে করি। কিন্তু এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুম হয়ে যাওয়াও যে অনেক ক্ষেত্রেই ‘ফেইক’ বা ‘সাজানো’ হতে পারে সেটি কখনও ভেবে দেখিনি, অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাকে পুলিশ যদি প্রমাণ না করতো তাহলে আমার সে বিশ্বাসে কখনও চির ধরতো না।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো শুরু করে মূলত- র‌্যাবকে দিয়ে। যদিও আমরা দেখতে পাই যে, তখনকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরই ধরে ধরে ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়েছিল। কিংবা তারও আগে আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষদিকে যখন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে তখন পত্রপত্রিকার রিপোর্ট থেকেই জানা গিয়েছিল যে, অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে দেশে এই ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। তার মানে একথা তখনও বলিনি যে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একেবারে স্বচ্ছ ছিলেন বরং কখনও কখনও ছাত্রলীগের দৌরাত্ম নিয়ে তখনও আমার মতো অনেককেই কলম ধরতে হয়েছে। কিন্তু যখন র‌্যাব দিয়ে বেছে বেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে হত্যা করা শুরু হলো তখন আমার মতো অনেকেই একথা জোর দিয়েই বলেছেন যে, আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার নামে বিরোধী দলকে এভাবে দমন করা হলে দেশকে এক ভয়ঙ্কর অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতর ঠেলে দেওয়া হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, রাষ্ট্রীয় মদদে এভাবে আইনভঙ্গ করা হলে এক সময় এই প্রবণতা সাধারণ মানুষকেও পেয়ে বসবে, কে শোনে কার কথা? বরং একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেবকে হত্যা, আহসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যাসহ দেশব্যাপী সংখ্যালঘু হত্যা ও নির্যাতন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যেনো উল্কা গতিতে এগিয়ে চললো। আজকে যারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে হত্যাকারী বলে গলা ফাটিয়ে ফেলেন তারা তখন নীরব দর্শক কিংবা কখনও কখনও সমর্থকের ভূমিকা পালন করেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্বাস ও অবস্থানের কারণে তারা তখন প্রতিবাদ করতে হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন। একথা এখন জোর দিয়েই বলবো যে, আমাদের মতো যারা তখনও প্রতিবাদ করেছেন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কিংবা গুম-খুনের, এখনও যখন সেরকম কোনও ঘটনা ঘটে তারা কিন্তু নিজেদের অবস্থান বদলাননি, এখনও তারা সমান প্রতিবাদী। তারা প্রতিবাদ করেন এ কারণে যে, রাষ্ট্রের চরিত্রকে সন্ত্রাসী করে তোলা হলে তা রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেয়, সেই জায়গা থেকে, তা সে যে আমলেই হোক না কেন। কিন্তু এখন যারা প্রতিবাদ করেন এবং তখন যারা চুপ করে ছিলেন তারা আসলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ আছে বলেই প্রতিবাদটি করেন, বাকি সময় তারা নিজেদের প্রতিবাদী চরিত্রটি কোনও একটি বিশেষ ব্যাংকে বন্ধক রেখে থাকেন।

আওয়ামী লীগ কথায় কথায় জেল থেকে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ছেড়ে দেওয়ার অজুহাত দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে, আমরা অনেকেই সেটি বিশ্বাস করতে চাইনি, ভেবেছি যে, একটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে আরেকটি রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাই যে সঠিক ছিল সেকথা বোঝা গেলো দেশব্যাপী ঘটা নৈরাজ্য থেকে। প্রশ্ন তুলতে পারি যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর কি তা থেকে উত্তোরণে বিশেষ কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে? উত্তরে আওয়ামী লীগ বার বারই হয়তো বলবে যে, তারা পুলিশ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছে বা আরও অনেক কিছুই। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই বিডিআর বিদ্রোহ ও এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে রক্তপাত জাতি প্রত্যক্ষ করেছে সেটি আসলে ছিল ভয়াবহ। এবং এরপর থেকে সরকারকে সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রণ কঠোর না হয়ে হয়তো উপায় ছিল না। ধরে নিচ্ছি তারপর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলের রাজনৈতিক অপকাণ্ড দমনে কঠোর হয়ে কিছু নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে থাকবে। যদিও সেটাকে কখনওই যুক্তিসঙ্গত মনে করিনি। কিন্তু যে মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট এবং তাদের দেশি-বিদেশি দোসর বা সমর্থকগোষ্ঠী মিলে যে ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শুরু করেছিল তা দমন করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। বরং ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এক নতুন যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

মজার ব্যাপার হলো, এই যুদ্ধ যেমন ছিল একাত্তর সালের মতো সশস্ত্র, যা পুলিশকে করতে হয়েছে জামায়াত-বিএনপি’র গুণ্ডাদের সঙ্গে আর তেমনই ছিল মনস্তাত্ত্বিকও যার নেতৃত্ব দিয়েছে আমার দেশ, মাহমুদুর রহমান, ফরহাম মজহার গং এবং যা মোকাবিলা করেছে গণজাগরণ মঞ্চ, ব্লগার ও লেখক-সাংবাদিক-কবিগণ। ধর্মের ষাঁড়ের হাতে চাপাতি দিয়ে তাদেরকে দিয়ে ব্লগার-লেখকদের হত্যা করানো হয়েছে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য ধর্মকে নিয়ে যথেচ্ছ মিথ্যাচার করা হয়েছে। ঠিক একই সময়ে ‘গুম’ শব্দটিকে নিয়ে করা হয়েছে রাজনীতি।

প্রশ্ন তুলতে পারি যে, রাষ্ট্র এক্ষেত্রে কি শক্তিশালী কোনও ভূমিকা গ্রহণ করতে পেরেছে? উত্তর হলো, না পারেনি। পারেনি, শক্তহাতে একের পর এক চাপাতির কোপে নিহত ব্লগারদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে। পারেনি ‘গুম’ হওয়া ঠেকাতে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার রহস্য এখনও অজানাই রয়ে গেছে, যদিও আরেক বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনকে ভারতে অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যাওয়ায় সেটি আর ‘গুম’ হিসেবে থাকেনি। যেহেতু রাষ্ট্র ‘গুম’ হয়ে যাওয়া মানুষের হদিস দিতে পারেনি কিংবা পারেনি তাদের অবস্থান নির্ণয় করতে সেহেতু এর দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। কিন্তু এ প্রশ্ন যদি এখন তোলা হয় যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে জামায়াত-বিএনপি যদি তাদের নেতাকর্মীদেরই ‘বলির পাঠা’ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে, যার নজির আমাদের সামনে রয়েছে, তাহলে সে দায়ও কি রাষ্ট্রের? আমি বলবো হ্যাঁ রাষ্ট্রের, কারণ, ক্ষমতাসীন সরকারকে সেটা প্রমাণ করতে হবে যে, ‘গুম’ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটিকে আসলে বিরোধী পক্ষই নিজেদের প্রয়োজনে ‘গুম’ করেছে, যতোক্ষণ পর্যন্ত সেটি না পারছে ততোক্ষণ অবধি এর দায় রাষ্ট্রেরই।

কিন্তু অতি সম্প্রতি কবি ও কল্পনাবিদ, এনজিওকর্মী, এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নতুন স্বপ্নদ্রষ্টা, অধুনা ‘গুরুবাবা’ পরিচিতি লাভ করা ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার পর এদেশে ‘গুম’ শব্দটি যে আর আগের মতো শক্তিশালী থাকলো না সেকথা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে। এর আগে পর্যন্ত এই শব্দটি দেশে ও বিদেশে আওয়ামী লীগ সরকারকে ঘায়েল করার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ হয়ে এসেছে, এমনকি বিএনপি-জামায়াত আমলের গুমের ইতিহাসও মানুষ ভুলে গেছে। কিন্তু যেদিন সকালে দেশে ও বিদেশে সর্বত্র এই বার্তা রটে গেলো যে, ‘বাংলাদেশের ভিন্ন মতাবলম্বী কবি ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার গুম হয়েছেন’ সেদিন কিন্তু আমি বা আমার মতো অনেকেই এই ভেবে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলাম যে, আওয়ামী লীগ সরকার কেন নিজেদের কবর নিজেই খুঁড়ছে? হরে-দরে একথাও মনে হয়েছিল যে, এই ফরহাদ মজহারকে দিয়েই হয়তো হবে এ সরকারের ‘দ্য অ্যান্ড’, কারণ, আমরা যতোদূর জানি যে, এদেশে ফরহাদ মজহারের সমর্থকগোষ্ঠী বিপুল ও ব্যাপক, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে তাদেরকে আমরা একঝলক দেখেওছিলাম। কিন্তু কী ভয়ঙ্কর কথা, সেদিন দিনভর ফরহাদ মজহারের মুক্তি চেয়ে একটি মিছিলও বের হয়নি এদেশে অথচ তারাই কথায় কথায় বলে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কেন এদেশে কোনও মিছিল বেরুলো না? কিন্তু তারা চারদিকে রটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল যে, ফরহাদ মজহারকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাই ‘গুম’ করেছে কারণ ‘গুম’ হওয়ার একদিন আগেই তিনি ভারতে মুসলিম হত্যার প্রতিবাদে সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন।

কিন্তু ফরহাদ মজহার যে ‘গুম’ হননি তা জানা গেলো তাকে উদ্ধারের পর এবং তারপর থেকেই ‘গুম’ শব্দটি কেমন অরক্ষিত হয়ে গেলো। অথচ তার ‘গুম’ হওয়াকে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে হৈচৈ পড়ে গেলো, দেশ-দেশান্তর থেকে বাণী আসতে শুরু হলো, মানবাধিকার সংগঠনগুলো নড়েচড়ে বসলো, বিদেশিদের কাছে বাঙালি অ্যাকটিভিস্টদের আবেদন গেলো- দিনশেষে সবই পানিতে গেলো ফরহাদ মজহারের ‘গফুর’ হয়ে ফিরে আসায়। তারপর থেকে যেসব গল্পগাছা তার সম্পর্কে প্রকাশ হতে শুরু হলো তা নিয়ে আমার সত্যিই আগ্রহ কম, কারণ কারও ব্যক্তিগত বিষয়ে দখল দেওয়ার ইচ্ছে কোনোকালেই আমার ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু আমার দুঃখ সেখানে নয়, আমার কষ্টটা হলো, ফরহাদ মজহার ফিরে আসায় ‘গুম’ শব্দটি আর ‘তাদের অস্ত্র’ থাকলো না, আমাদেরও প্রতিবাদের জোর কমে গেলো, কারণ কে জানে, ‘গুম’ আসলেই হয় কিনা, নাকি সবই সাজানো ‘গুম’? কিন্তু অন্তে একথাও বলি যে, সত্য হোক আর সাজানো হোক, ‘গুম’ যে সত্য নয় সাজানো, এটি রাষ্ট্রকেই প্রমাণ করতে হবে ‘গুম’ হওয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে।

লেখক: সাংবাদিক কথাসাহিত্যিক

masuda.bhatti@gmail.com