৭০ অনুচ্ছেদের ‘ভীতি’ ও বাস্তবতা

আমীন আল রশীদসংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের বাকস্বাধীনতা ও তাদের সত্যের পক্ষে থাকার পথে একটা বড় বাধা বলে মনে করা হয়। ফলে এটি নিয়ে এক ধরনের 'ভীতি' রয়েছে। সবশেষ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে আপিল বিভাগও ৭০ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের বেদনাহত এবং অসংগতভাবে তাঁদের অধিকারকে শৃঙ্খলিত করেছে।’
আমরা ৭০ অনুচ্ছেদের 'ভীতি' নিয়ে যতটা অ্যাকাডেমিক অথবা পপুলার আলোচনা করি, এর বাস্তবতা নিয়ে ততটা ভাবিত নই। এই নিবন্ধে আমরা ৭০ অনুচ্ছেদের ভীতির পাশাপাশি এর বাস্তবতা মিলিয়ে দেখা এবং এর বিকল্প কী হতে পারে––সে বিষয়েও আলোকপাতের চেষ্টা করব।
এখন ৭০ অনুচ্ছেদ যেমন আছে, সেখানে বলা আছে, কোনও সংসদ সদস্য তার দল থেকে পদত্যাগ করলে অথবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার সদস্য পদ বাতিল হবে। বাহাত্তরের মূল সংবিধানে এরকমই বিধান ছিল এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধানটি ফিরিয়ে আনা হয়। দেখা যাচ্ছে, মাত্র দুটি কারণে সংসদ সদস্যপদ বাতিল হতে পারে। এক. দল থেকে পদত্যাগ (বহিষ্কার নয়) এবং দুই. সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া। প্রথম পয়েন্ট নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই। তবে গোল বাঁধে এই দুই নম্বর পয়েন্টে, অর্থাৎ দলের বিপক্ষে ভোট। বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের যে বিধান ছিল, পরবর্তীকালে দু দফায় তাতে সংশোধনী আনা হয়। পরে পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় সেগুলো বাতিল করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের বিধান প্রতিস্থাপিত করা হয়।

এই অনুচ্ছেদটি নিয়ে বারবারই আলোচনা হয় এ কারণে যে, বলা হয় এটি সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত করে। দলের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের চুপ থাকতে বাধ্য করে। কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হচ্ছে যে, কেউ দলের বিপক্ষে ভোট দিলেই তার সদস্যপদ বাতিল হবে। কথা হচ্ছে, কোনও সদস্য যদি কোনও বিলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলেও কি সদস্য পদ যাবে? কেননা, বিলের বিপক্ষে অবস্থান মানেই সেটা দলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নয়। দলের বিরুদ্ধে বা বিপক্ষে ভোট দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে কেবল যখন ওই দলের, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে যদি ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের ওপরে ভোটের প্রশ্ন ওঠে। অর্থাৎ এরকম পরিস্থিতিতে, অর্থাৎ সরকারের বাঁচামরার প্রশ্নেই কেবল বিপক্ষে ভোটের প্রসঙ্গ আসবে। কেননা, অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে গেলে সরকারের পতন হবে। যাতে করে বারবার সরকার বদল না হয় এবং সংসদে অস্থিরতার সৃষ্টি না হয় সে কারণে এই বিধানটি রাখা অন্যায্য নয়। কিন্তু কোনও বিলের বিরুদ্ধে, এমনকি বিচারক অপসারণের প্রশ্নেও যদি ভোটাভুটি হয় তখনও সংসদ সদস্যদের নিজের পছন্দ মতো পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিতে বাধা থাকার কথা নয়। যদিও ষোড়শ সংশোধনীর পরে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেই।

সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা থাকলে সেখানে এমপিরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন কী না, এমন প্রশ্নে ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং আইন কমিশনের চেয়ারম্যান খায়রুল হকও সাংবাদিকের বলেছিলেন,অসদাচরণের জন্য উচ্চ আদালতের কোনও বিচারককে অপসারণের ক্ষেত্রে সংসদে দলীয় মতের বিপক্ষে ভোট দিতে ৭০ অনুচ্ছেদ কোনও বাধা নয়। বরং ৭০ অনুচ্ছেদের বিধান প্রযোজ্য হবে কেবল সংসদে ওই দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে। কিন্তু সমস্যা হলো, বছরের পর বছর ধরে আমাদের এটিই গেলানো হচ্ছে যে, ৭০ অনুচ্ছেদ মানে সংসদে দলের সব সিদ্ধান্তের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে। আমি মনে করি, এটি ৭০ অনুচ্ছেদের একধরনের অপব্যাখ্যা।

৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বছরের বছর ধরে এই ভীতি জারি থাকার আরেকটি কারণ, এই অনুচ্ছেদটি পরীক্ষিত নয়। অর্থাৎ কোনও বিলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ায় কারো সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়েছে এমন কোনও উদাহরণ আমাদের সামনে নেই। আবার কোনও এমপি সাহস করে বিপক্ষে ভোট দিয়ে দৃষ্টান্তও স্থাপন করেননি। যদি কেউ এরকম একটি সাহস করতেন এবং যদি সত্যিই তার সদস্যপদ বাতিল হতো, তখন তিনি আদালতের কাছে এর প্রতিকার চাইতে পারতেন। তখন আদালত নিশ্চয়ই একটা ফয়সালা করতেন এবং মনে হয় ৭০ অনুচ্ছেদের মূল স্পিরিট বিশ্লেষণ করলে আদালত কেবল বিলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার কারণে সংসদ সদস্যপদ বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করতেন। কিন্তু তারপরও এমপিরা সদস্যপদ হারানোর ভয়ে এরকম ঝুঁকি নিতে চান না।

সংসদীয় কার্যক্রমে সংসদ সদস্যরা যদি স্বাধীনভাবে অংশ নিতে না পারেন, যদি তারা বিলের ব্যাপারে নিজেদের স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ না পান, তাহলে সরকার গণবিরোধী আইনও পাস করিয়ে নিতে পারে। এখন হচ্ছেও তাই। বিলের অনেক বিধানের বিপক্ষে মানসিকভাবে অবস্থান নিলেও ৭০ অনুচ্ছেদের ভয়ে এমপিরা অপছন্দের বিষয়ের সঙ্গেও ‘হ্যাঁ’ বলেন। কিন্তু এরকম ভীতি না থাকলে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আরও বেশি আলোচনা ও বিতর্ক হতো। সংসদ আরও বেশি প্রাণবন্ত হতো বলে মনে করা হয়।

তবে এরকমটিও মনে করা হয় যে, বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ৭০ অনুচ্ছেদের মতো একটি বিধান থাকা প্রয়োজন। কেননা দল বদল ঠেকাতেই এই বিধান সংবিধানে যুক্ত করেছিলেন আমাদের সংবিধান প্রণেতারাই। এরকম বিধান না থাকলে এমপিরা যেকোনও সময় দল বদল করে সরকারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারেন। ঘন ঘন সরকার বদল বা এরকম বড় রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করা হয়। কেননা আমাদের দেশে রাজনীতি এখনও ওই অর্থে আদর্শনির্ভর নয়; বরং ‘সুবিধানির্ভর’। অর্থাৎ দেখা যাবে দেশের যেকোনও সংকটকালে বা অন্য দলের কাছ থেকে বড় সুবিধা পেয়ে বা ভবিষ্যতে বড় কোনও পদের লোভে পড়ে অনেক এমপি দল বদল করে ফেলবেন এবং তাতে সরকারের ভিত নড়ে যাবে। তাই এরকম দলবদল ঠেকাতে ৭০ অনুচ্ছেদের যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করা হয়। তবে ৭০ অনুচ্ছেদে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া মানে কেবল অনাস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করে সংবিধানে আরেকটু সংশোধনী আনা প্রয়োজন।

২০০২ সালে বিএনপির সাবেক এমপি আব্দুল মান্নান ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের জন্য একটি বেসরকারি বিল এনেছিলেন সংসদে। যদিও সেটি পাস হয়নি। ওই বিলে প্রস্তাব করা হয়েছিল কেবল পদত্যাগ এবং সংসদে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাবে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলেই কেবল সংসদে তার আসন শূন্য হবে। ওই প্রস্তাবিত বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, ফ্লোর ক্রসিংয়ের ব্যাপক বিধানকে কেবল মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে সীমিত করলে সরকারের স্থায়ীত্ব যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি সংসদ সদস্যরা অনেকটা স্বাধীনভাবে সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন।

অনেকের আশঙ্কা, ৭০ অনুচ্ছেদ আরও সহজ এবং তুলনামূলক গণতান্ত্রিক করলেও যে সংসদে এমপিরা নিজের দলের বিপক্ষে যায় এমন বিষয়ে কথা বলবেন––তার সম্ভাবনা কম। কেননা, ১৯৯১ সাল থেকে আমরা একধরনের সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা করলেও এখানে ব্যক্তিস্তুতি একটাই প্রকট ও প্রয়োজনীয় যে, ‍সুযোগ থাকার পরও ঠিক কতজন সংসদ সদস্য নিজের দলের বা দলীয় প্রধানের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা  করবেন বা করতে পারবেন– তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে।

‘৭০ অনুচ্ছেদের অবাক ব্যাখ্যা’  শীর্ষক নিবন্ধে অধ্যাপক আলী রীয়াজ (প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০১৭) প্রশ্ন তুলেছেন, ‘পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে সংসদে কি এমন কোনো উদাহরণ তৈরি হয়েছে, যেখানে সরকারি দল, এমনকি সরকারি জোটের সাংসদেরা ক্ষমতাসীন দলের উত্থাপিত বিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ভোট দিয়েছেন? এমনকি যেসব সদস্য বিতর্কে অংশ নিয়ে বিভিন্ন বিলে সংশোধনীর প্রস্তাব করেছেন কিন্তু তা গ্রাহ্য হয়নি, তাঁরাও কি ওই সব বিলে সম্মতিসূচক ভোট দেননি? দ্বিতীয়ত,  যে সংসদের সংসদ নেতা, দলের সংসদীয় দলের প্রধান, দলের নেতা ও সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি এবং যাঁর হাতে সাংবিধানিকভাবেই ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ ঘটেছে, তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের সম্ভাবনা কতটুকু? তৃতীয়ত, যে দেশের প্রধান প্রধান দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা, ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ অনুপস্থিত, সেখানে কেবল একটি সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ কোনো সাংসদকে তাঁর দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সাহস জোগাবে, এমন মনে করার পেছনে যুক্তি পাওয়া অসম্ভব।’

গেলো এপ্রিলে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট করেন সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী। এতে ৭০ অনুচ্ছেদ কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারির আবেদন করা হয়। এরইমধ্যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে আপিল বিভাগও বিষয়টি নিয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তবে হাইকোর্টে বলেছেন, ৭০ অনুচ্ছেদের ব্যাপারে আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ মানা হাইকোর্টের জন্য বাধ্যতামূলক। তবে বিষয়টির শুনানি শেষ হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের ছুটির পর এ রিটের পরবর্তী শুনানি হবার কথা রয়েছে। আশা করা যায়, ওই শুনানিতে বিষয়টির উপরে বিস্তারিত আলোচনা হবে এবং ষোড়শ সংশোধনীর শুনানিতে আপিল বিভাগ যেমন দেশের বিজ্ঞ আইনজীবীদের মতামত শুনেছেন, ৭০ অনুচ্ছেদের শুনানিতেও চাইলে এরকম অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য শুনতে পারেন।

 

লেখক: সাংবাদিক