নির্বাচন আসছে শঙ্কাও বাড়ছে জনমনে

মাসুদা ভাট্টিবাংলাদেশ নিয়ে যারা সামান্যও ভাবেন, তারা জানেন, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কখনোই বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে শঙ্কামুক্ত হতে পারেনি। বরং সব সময় এক ধরনের ভয় ও ভীতির মধ্য দিয়ে দেশটিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে ও হচ্ছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যখন বিশ্বের অন্যতম বিশাল ও সংকটপূর্ণ রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলা করছে, তখন এদেশের রাজনীতি যেন ক্রমশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে উত্তেজনা তৈরি হওয়া এদেশে নতুন কোনও ঘটনা নয়। কিন্তু তা যদি সহিংসতায় রূপ নেয়, তাহলে দেশের জন্য তা যে চরম বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। নিকট অতীতে আমরা দেখেছি, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এদেশে অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এও দেখেছি, তাতে দেশের রাজনীতির ক্ষতি ছাড়া খুব বেশি লাভ হয়নি।

২০১৪ সালে যে নির্বাচন হয়েছে দেশে, তা যে কোনও উদাহরণ হতে পারে না, সে কথা নতুন করে বলার কোনও অর্থ নেই। কিন্তু তার দায় কোনোভাবেই এককভাবে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার ওপর বর্তায় না। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনও রাজনৈতিক দল যদি সংবিধানে কোনও পরিবর্তন আনে, তা গণতান্ত্রিক রীতিতে বৈধ এবং পরবর্তী কোনও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সরকার ক্ষমতায় বসেই কেবল সেটি চাইলে বাদ দিতে পারে। তার আগে সেটি সম্ভব হলেও তা গণতান্ত্রিক রীতিবিরুদ্ধ বলেই বিবেচ্য হবে। সে বিচারে এদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে রীতিটি ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার সংবিধানভুক্ত করেছিল, তা কোনোভাবেই কি বৈধ ছিল? ছিল না। কারণ বিএনপি এককভাবে নির্বাচন করে সেই সংসদ গঠন করেছিল। কিন্তু তাকেই আমরা ধরে নিয়েছিলাম সেই সময়ের জন্য সবচেয়ে ভালো পথ হিসেবে, কারণ চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে এর চেয়ে ভালো কোনও পথ আমাদের সামনে ওই সময় খোলা ছিল না। কিন্তু এ কথাটি হয়তো বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, তবে তিক্ত সত্য বটে, বাংলাদেশে আমারা সব সময়ই সাময়িক সমাধানে খুশি থাকি। কখনও ভবিষ্যতে তার ফল কী হতে পারে, তা নিয়ে তেমন চিন্তা-ভাবনা করি না। ২০০১ সালে সংবিধান মেনে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বঙ্গভবন থেকে বেরুতে না বেরুতেই যে পদ্ধতিতে এই সরকার ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল, তা পরবর্তীতে ইয়াজুদ্দিন আহমদের হাতে এসে একেবার কাদায় পরিণত হয়েছিল। যে কারণে আজ হোক আর কাল হোক তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে এদেশের সংবিধান থেকে বাদ দিতেই হতো। কারণ এটি দীর্ঘকাল চলার মতো কোনও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হতে পারে না। হওয়া উচিতও নয়। কিন্তু ২০১৪ সালে এসে দেখা গেলো, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত মিলে যে জোট গঠন করেছে, সেই জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছে না। কিন্তু নির্বাচনে অংশ না নেওয়া এক কথা, নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। বিএনপি-জামায়াত সেই ভিন্ন কাজটিই করেছে, বিশেষ করে নির্বাচন কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা নাগরিকের ওপর হামলাসহ ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে ফেলার যে উদাহরণ এদেশে সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশে নির্বাচন এলেই এদেশের ভোটারদের আতঙ্কিত হয়ে ওঠার কথা। কারণ ভোট দিতে গিয়ে যদি জীবনটাও দিতে হয়? গণতন্ত্রের জন্য এদেশের মানুষ আর কত জীবন দেবে বলুন? আসলে এ কারণেই ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত অনুল্লেখযোগ্য এই নির্বাচনের জন্য সমালোচনা যতটা আওয়ামী লীগের প্রাপ্য, ঠিক ততটাই প্রাপ্য বিএনপি-জামায়াতেরও।


এই মুহূর্তে সবার মুখেই একটি মাত্র আলোচনা, তা হলো, নির্বাচন আসছে। ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন তাদের রুটিনওয়ার্কগুলো শুরু করে দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোসহ সংশ্লিষ্ট সবপক্ষের সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সংক্রান্ত আলোচনা অনুষ্ঠানও করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে যে শঙ্কা এ যাবত বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো তৈরি করে দিয়েছে, তাতে আগামী বছরের শেষ নাগাদ বা তার পরের বছরের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিতব্য একাদশ সংসদ নির্বাচন কতটা শঙ্কামুক্ত হবে, তা নিয়ে কেউই যে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এর পেছনে পূর্ববর্তী নির্বাচনে ঘটে যাওয়া সহিংসতার সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিও কম দায়ী নয়।
আগেই বলেছি যে, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতো একটি ভয়ঙ্কর ও আন্তর্জাতিক সমস্যা মোকাবিলা করছে। এ রকম প্রায় কোটিখানেক অন্য দেশের নাগরিককে নির্যাতনের মুখে এসে আশ্রয় দেওয়া ও তাদের ফিরিয়ে দেওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হলে পৃথিবীর অন্য যেকোনও দেশেই সরকারি দল, বিরোধী দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে নিয়ে দেশের ভেতর একটি রাজনৈতিক ঐক্য তৈরি হতো। কিন্তু বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সরকার ও বিরোধী দল রোহিঙ্গা ইস্যুতে একমত হলেও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি রোহিঙ্গা ইস্যুকে রাজনৈতিক চেহারা দিতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই এবং একে আগামী নির্বাচনে কিভাবে ব্যবহার করা যায়, তার প্রাথমিক উদ্বোধনও করেছে বেগম জিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনের মাধ্যমে।
ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ পথ তিনি পার হতে গিয়ে ইতোমধ্যেই সংঘর্ষের জন্ম দিয়েছেন এবং সে জন্য সরকারকে দায়ী করছেন। এই সংঘর্ষ এড়ানো যেতো, যদি তিনি সড়কপথে না গিয়ে এই দূরত্ব বিমানে যেতেন। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষ করে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার গাড়ি বহর কোনোদিন আক্রান্ত হয়নি, এমন ঘটনা কেউ স্মরণ করতে পারেন? শারীরিক অসুস্থতার কারণে আদালতে না যাওয়া যেতে পারে, কিংবা তিন মাসেরও বেশি সময় বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে আসা যেতে পারে কিন্তু সড়ক পথে এতটা দূরত্ব অতিক্রমে যখন সে রকম কোনও অসুবিধা হয় না, তখন প্রতিপক্ষ যদি তার ভেতর নতুন কোনও রাজনৈতিক সহিংসতা তৈরির ইঙ্গিত দেখেন, তাহলে তাদের দোষ দেওয়া যাবে কি? কিন্তু তাই বলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশের ভেতর তার গাড়িবহর নিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে না, এটাও কোনও নতুন ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের ইঙ্গিত বহন করে না। মোটকথা, খালেদা জিয়ার কক্সবাজার সফরকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষ যেভাবে মুখোমুখি হয়ে পড়লো, তাতে আগামী নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে শঙ্কা তৈরি হওয়াটা কোনোভাবেই অমূলক হবে না।
এখন এও নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, কক্সবাজার থেকে ফিরে এসে বিএনপির পক্ষ থেকে এ কথাই বলা হবে যে, যেহেতু খালেদা জিয়াকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে যেতেই বাধা দেওয়া হয়েছে, সেহেতু তিনি নির্বাচনি প্রচারণা চালাবেন কী করে? অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে তো ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে, এই হামলা বিএনপি নিজেরাই ঘটিয়েছে। ফলে পরিস্থিতি এখনই বেশ উত্তপ্ত, বাকি দিনগুলো তো পড়েই রয়েছে। আমরা জানি যে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনে যখন উন্মত্ত হয়ে ওঠে, তখন এদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতিই আক্রান্ত হয়। ভয়টা আসলে সেখানেই। পরিস্থিতিকে কি ক্রমশ সেদিকেই ঠেলে নেওয়া হচ্ছে? কিন্তু তাতে না হয় রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের ক্ষমতার প্রদর্শন হয়, বাংলাদেশের সার্বিক কোনও উপকার তাতে হয় কি? একটি দেশ যখন সব দিক থেকেই এগিয়ে চলছে সব বাধাবিঘ্নকে পেরিয়ে যেতে চায়, তখন কেবল রাজনৈতিক কারণে দেশটিকে আবার ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক গোলোযোগের ভেতর টেনে নিতে যারা কাজ করে যাচ্ছেন, তারা যে দেশের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী নন, সেটা বলাই বাহুল্য। ভরসার কথা হলো, বাংলাদেশের মানুষ যে নির্বাচন এলেই শঙ্কায় ভোগে তেমনই একথাও তারা এতদিনে বুঝতে পেরেছে যে, দেশের জন্য জরুরি ‘রাজনীতি’টি আসলে কী; তারা নিশ্চিত সেই রাজনীতির প্রতিই আকর্ষিত হবেন, কারণ একবার যারা একটু হলেও সফতার মুখ দেখেছেন, তারা কি আর কোনও রাজনৈতিক ভুলে ব্যর্থতার পথে হাঁটতে চাইবেন? মনে হয় না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি

 

masuda.bhatti@gmail.com