তাহলে ভারত কী দোষ করলো?

মাসুদা ভাট্টিবাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ পুরনো ঘটনা, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে এদেশের রাজনীতিতে যখন সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণ শুরু করে তখন থেকেই বাংলাদেশ কী করবে, কীভাবে করবে সব নির্দেশনাই আসতে থাকে বিদেশ থেকে। পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে তখন রাজনীতির জন্য অর্থের জোগান হলেও রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হতো মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার গোয়েন্দা তৎপরতার ভিত্তিতে। ভারত ও চীন তখনও রাজনীতিতে এতটা পটু হয়ে ওঠেনি। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নও এদেশের রাজনীতিতে সরাসরি নাক গলিয়েছে বলে প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সোভিয়েতের এই নাক গলানিকে কখনও খারাপ চোখে দেখেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন ছিল, কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন-বিরোধিতা, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ফুড-পলিটিক্সের শিকার হিসেবে বাংলাদেশকে একটি দুর্ভিক্ষের কবলে ফেলে দেওয়া এবং দেশে দেশে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে জনপ্রিয় নেতাদের হত্যার মাধ্যমে সামরিক শাসন জারি করার কর্মকাণ্ড থেকে বাংলাদেশকেও মুক্তি না দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের মানুষের মনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা তৈরি হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অবজ্ঞার বিষয়টি তো বহুল চর্চিত।

এসবের মাঝেই ইউরোপকে একটু আলাদাভাবেই দেখতো বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজনীতি থেকে ইউরোপের দেশগুলো নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার চর্চা করেছে দীর্ঘকাল, অন্তত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধাক্কা সামলে নেওয়া পর্যন্ত তাই দেশে দেশে ষাট ও সত্তর দশকের স্বাধীনতা আন্দোলনগুলোতে ইউরোপের ভূমিকাকে আমরা ঠিক জোরালো বলে বুঝতে পারি না। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঠেকাতে যখন নতুন করে এনজিও-কর্মকাণ্ড শুরু হলো তখন ইউরোপও তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল এবং বাংলাদেশেও এনজিও-তৎপরতায় ইউরোপীয় হস্তক্ষেপ লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশ সামরিক শাসনোত্তর নতুন যুগে প্রবেশের পর সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজকে রাজনীতিতে ‘ওয়াচ ডগ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি ইউরোপ ও আমেরিকা একযোগেই করেছে এবং এই সুশীল সমাজকে ‘রাজনৈতিকায়নেও’ তাদের ভূমিকা রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ বা তৎপরতা বিষয়ে যারা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন তারা মূলত এই যুক্তিই দিয়ে থাকেন, বাংলাদেশ মূলত চালিত হয় বিদেশি সাহায্যে। ফলে যে দেশ বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেয় তাদের ‘হক’ বা অধিকার রয়েছে বাংলাদেশ বিষয়ে কথা বলার। খুব খোঁড়া যুক্তি তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কারণ, ‘ভাত’ খাওয়ালেই ‘ভাতার’ হতে হবে এটা যুক্তি নয়, কু-যুক্তি। কোনও দেশই অন্য কোনও দেশকে বিনা কারণে, বিনা মুনাফায় অর্থ সাহায্য করে বলে কোনও নজির নেই। ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ বহুবিধ কারণ রয়েছে বিদেশি সাহায্যের। কিন্তু এই ছুঁতোয় কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের ঘটনা দেশে দেশে কমতে শুরু করেছে সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও সামরিক শাসকদের গড়া রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর প্রশাসনের প্রভাব এবং দুর্বল ভোটের রাজনীতিতে জনগণকে বোকা বানানোর বহুবিধ চেষ্টার ফলে রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

এ বছরের জুন মাসে জার্মানিতে নবনিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রিচার্ড গ্রেনেল, যিনি কিনা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খুব ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, তিনিই একটি কট্টরপন্থি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, তিনি চাইছেন ইউরোপের কট্টর ডানপন্থি শক্তিগুলোকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে এবং এ জন্য তাদের সহযোগিতা দিতে। সাক্ষাৎকারে তিনি ইউরোপজুড়ে উদারপন্থি রাজনীতির ‘ব্যর্থতা’কে কাজে লাগিয়ে কট্টরপন্থিদের আরো শক্তিশালী করার পক্ষে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। শুধু জার্মানিতেই নয়, তার এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পর গোটা ইউরোপেই তার বক্তব্যের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে এবং রাজনৈতিক দলসমূহ, সুশীল সমাজ থেকে দাবি উঠেছে তাকে বহিষ্কারের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কট্টরপন্থির রাজনীতিকে ইউরোপে অভিবাসন দেওয়ার এই পরিকল্পনাকে তারা ‘ভয়ঙ্কর’ ও ‘বিপজ্জনক’ বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন এই নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে। জার্মানির জনপ্রিয় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের এক নেতা স্পষ্ট করেই বলেছেন, রাষ্ট্রদূতের কাজ কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা নয়, কিংবা কোনও রাজনৈতিক পক্ষকে ‘শক্তিশালী’ করাও নয়, তিনি একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন, কোনও রাজনৈতিক দলের নয়। একই বক্তব্য রেখেছেন মার্কিন সিনেটর ক্রিস মার্ফিও। ২০১৩ সালে জার্মানি মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ডেকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে, কেন যুক্তরাষ্ট্র জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের মোবাইল ফোনে আড়ি পেতেছিল। এ ঘটনার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যকার সম্পর্কে একটা শীতলতা বিরাজ করছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯৪৫ সালের মে মাসে, কিন্তু তখন থেকে আজ অবধি জার্মানিতে ২৫ হাজার মার্কিন সৈন্য অবস্থান করছে। নিন্দুকেরা বলে থাকে, মার্কিনিরা এখনও জার্মানিকে বিশ্বাস করে না, নব্য হিটলারের উত্থানকে ঠেকানোর জন্যই এই বিপুল সংখ্যক সৈন্য সেখানে অবস্থান করছে বলেও কেউ বলে থাকেন। ট্রাম্প নিজেও অবাক হয়েছেন যে এত সংখ্যক মার্কিন সৈন্য জার্মানিতে অবস্থান করছে। এখন তিনি সৈন্যসংখ্যা সেখান থেকে কমানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। আমরা ভুলে যাই যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র আড়াই মাসের মাথায় বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্যদের সরিয়ে নিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে। কোনও যুদ্ধে সহযোগিতা শেষে বিজয়ী দেশ থেকে অন্য রাষ্ট্রের সৈন্যদের এরকম স্বল্পতম সময়ে সরিয়ে নেওয়ার নজির খুব কমই আছে। জার্মানির মতো দেশও সেটা নিশ্চিত করতে পারেনি। ইউরোপ এখন কম শক্তিশালী নয়, তবু তাদের পক্ষে ঘরের মধ্যে অপর রাষ্ট্রের সৈন্যদের রেখে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে– মুখে কিন্তু ইউরোপ সারাক্ষণ অপর রাষ্ট্রকে গণতন্ত্র বা দখলদারিত্ব নিয়ে সবক দিয়ে চলেছে।

যদিও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে মার্কিন হস্তক্ষেপ নিয়ে বেশ অনেক দিন ধরেই বিরূপ সমালোচনা চলছে। তুরস্কে তো মার্কিন হস্তক্ষেপের একটি সমুচিত জবাব দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে পুনর্নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের হাত ধরে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে এখনও মার্কিন রাষ্ট্রদূত দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কেন নাক গলান কিংবা প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখেন সে প্রশ্ন ইতোমধ্যে উঠেছে। কিন্তু এদেশের রাজনীতিবিদরা যখনই সরকারের বাইরে থাকেন তখনই ‘নালিশ’ নিয়ে গিয়ে হাজির হন বিদেশিদের কাছে। এটা এখানকার রাজনৈতিক বাস্তবতা। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলে তারা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের রাজনৈতিক বক্তব্যে চটেছেন আর বিএনপি-জামায়াতসহ নতুন করে বিএনপি’র সঙ্গে জোট গড়তে আগ্রহী ‘ওয়ান ম্যান পার্টি’-গুলো মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে বেজায় খুশি হয়েছেন। কারণ, তারা মনে করছেন জনগণ বুঝে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আর নেই। যদিও তারা কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ‘হস্তক্ষেপকে’ মেনে নেবেন না।

ধরা যাক, গাজীপুর নির্বাচনের পর ভারতীয় হাইকমিশনার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মতোই একটি সংবাদ সম্মেলন করে বক্তব্য দিলেন, কী হতো তখন অবস্থাটা? প্রথমেই সমস্বরে যে কথাটি বলা শুরু হতো তা হলো, ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। সকলে একযোগে এই কথাটিই বলতে শুরু করতেন যে ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলছে, যদি ভারত নির্বাচনের সমালোচনাও করতো তাতেও কাজ হতো বলে মনে হয় না। যারা বলছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অর্থ-সাহায্য দিয়ে থাকে ফলে তারা বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলতেই পারেন। একথা তো ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, ভারতও এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রেখে চলেছে। শুধু তাই-ই নয়, অবকাঠামো উন্নয়নসহ আপৎকালীন সহযোগিতাতেও ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশকে অর্থ সহযোগিতা একটু বেশিই করে থাকে। যদি সাহায্য দিলেই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কথা বলার অধিকারকে স্বীকার করে নিই, তাহলে ভারত কেন সে অধিকার পাবে না? আর যদি ভারতকে সে অধিকার না দেওয়া হয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা অন্য যেকোনও দেশেরই অধিকার নেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কথা বলার। একটি দেশ কথা বললে বগল বাজাবেন আর আরেকটি দেশ কথা বললে ঘৃণা ছড়াবেন বা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনবেন, এক যাত্রায় এই দুই ফল কেন হবে? ভারত এখন স্পষ্ট করেই বলছে, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা নির্বাচন নিয়ে কোনও কথা বলবে না, বা কোনও ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। দেখা গেলো দেশের অনেক বিবেকবান ব্যক্তিও ভারতের এই বক্তব্যকে নিয়ে কটাক্ষ করছেন। কিন্তু প্রকাশ্যেই যখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য দিলেন তখন তারা যেন এই সংবাদটি পড়েনইনি, সেরকম একটা ভাব দেখালেন। বাংলাদেশের রাজনীতির সমস্যা এখানেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করলে সেটা বৈধ আর প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত করলেই সেটা অবৈধ বা পক্ষপাতমূলক বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা। রাজনীতিতে এই সমস্যা যতদিন থাকবে ততদিন যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সাবালক হবে না সেটা বলাই বাহুল্য। এই সাবালকত্ব অর্জনে দেশের সকল রাজনৈতিক পক্ষকে, এমনকি সুশীল সমাজকেও একমত হতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত, কেউই যেন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে না পারেন, তা যত যুক্তিপূর্ণ বা রাজনৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য বক্তব্য হোক না কেন। নিজেদের ভুল, নিজেদের অপকর্ম এসবের দায় ও দায়িত্ব যেমন নিজেদের, তেমনই এসব শুধরানোর দায়িত্বও আমাদেরই। এ নিয়ে কাউকে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার অর্থই হচ্ছে বাইরের কারও কাছে কোনও না কোনোভাবে ‘আত্মাকে বন্ধক’ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তাই নয়?

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি

masuda.bhatti@gmail.com