অপরিচিত কাউকে সাহায্য করা, দাতব্য কাজে দান করা এবং কোনও সংগঠনে স্বেচ্ছায় কাজ করা-এই তিন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এই তালিকা করা হয়েছে। এতে মোট ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৩১। সবচেয়ে বেশি ৫৯ পয়েন্ট নিয়ে উদার দেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টানা চার বছর ধরে এক নম্বরে থাকার পর মিয়ানমার এবারের সূচকে আট ধাপ পিছিয়ে নবম স্থানে গেছে। আর ইন্দোনেশিয়া গতবারের দ্বিতীয় স্থান থেকে এই প্রথম শীর্ষে উঠে এসেছে। অপরিচিতকে সাহায্য করার দিক থেকে কোন দেশ কেমন, সেই তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে সাত নম্বরে। সিএএফের নতুন তালিকায় রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের সমালোচনা করা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের ভূমিকা ভালো নয়। এমনিতে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শক্রতা নয়; সে হিসেবে আমরা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে যে উদারতার পরিচয় দিয়েছি বা দিচ্ছি তা যে কোনও ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আবার ইন্দোনেশিয়া বা নেপালের ভূমিকম্পে, শ্রীলঙ্কার প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা দেশের বিপদে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যায় তার সত্যিই দৃষ্টান্ত। এছাড়া শান্তিরক্ষী মিশনে আমাদের ঐতিহ্য তো কয়েক দশকের। কিন্তু আমরা অভ্যন্তরে কতটা উদার হতে পেরেছি সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, ভারতের বিখ্যাত লেখক অরুন্ধতী রায় বাংলাদেশে এলেন। তার কথা শোনার জন্য প্রায় এক হাজার লোক রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন। কিন্তু তাকে কথা বলতে দেওয়া নিয়ে শুরু হলো নানা টালবাহানা। একবার এই ভেন্যু তো একবার ওই ভেন্যু। এতে কি সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হলো? মোটেই নয়। উনাকে হয়তো যে সংখ্যক লোক চিনতেন বা যারা তার বক্তব্য শুনতেন, এখন এই টানাহেঁচড়ার কারণে সেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং আরও বেশি লোকের কাছে বিষয়টি নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হয়। অথচ এমন না যে আমাদের দেশে বিদেশি লেখক শিল্পীরা আসছেন না। তাদের জন্য অবারিত দ্বার। কাজেই উদারতাকে দমিয়ে রাখতেও কিন্তু একটি পক্ষ তৈরি হয়ে আছে। এখন এদের বিরুদ্ধে অস্ত্র কী? অরুন্ধতীর ভাষায় ‘কাজ’। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কাজ আমাদের করে যেতে হবে। সেই কাজই আমাদের রক্ষা করবে। পৃথিবী বদলাবেই।’
একদিকে আমরা আমাদের আকাশ সংস্কৃতিকে অবারিত করে দিয়েছি। ইথারযোগে ধেয়ে আসছে পরদেশি গোলমাল। আমাদের অন্দরমহলকেও করে তুলছে অস্থির। সেই আমরাই আবার থার্টিফার্স্টকে বিদেশি সংস্কৃতি বলে সেদিন পুরো ঢাকা শহর বা বিভাগীয় শহরগুলোকে বানিয়ে ফেলছি চলমান কারাগার। সন্ধ্যার সময় মানুষজন যাতে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় সেই ব্যবস্থা করে ফেলছি। এমনকি আপনি কোনও ঘরোয়া অনুষ্ঠান করবেন সেখানেও নিতে হবে অনুমতি। অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়েও একই বক্তব্য। আপনি কী লিখবেন, কী লিখবেন না সেটি নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য লোকজন তৈরি হয়ে আছে। এখনও প্রতিবছর বইমেলার আগে বলা হয়, কোন ধরনের বই প্রকাশ করা যাবে, কোন ধরনের বই প্রকাশ করা যাবে না। এমনিতে আইন করে অনেক কিছুই লেখার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আর এখন রাষ্ট্রই নির্ধারণ করে দেবে কী করবেন, কী করবেন না। অনেক লেখক, কবি আর ব্লগার এখন নির্বাসিত। ‘অসির চেয়ে মসি শক্তিশালী’ এখন স্রেফ আপ্তবাক্য ছাড়া কিছুই নয়। অসিই এখন শক্তিশালী। অসির ভয়ে বই বদল হয়। অসির ভয়ে সব বদল হয়। সামনে আসছে পয়লা বৈশাখ। প্রতিবছর যা হয়, এখন আর বাঙালির প্রাণের উৎসব আগের মতো অবারিত নেই। কয়টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হবে, কোথায় কোন অনুষ্ঠান করতে পারবে, কোথায় পারবে না, সব ঠিক করে দেবে রাষ্ট্র। এমন উদাহরণ দেওয়া যায় ভূরি ভূরি।
ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামাজিক জীবনে সত্যিকার অর্থেই আমরা উদার নই। সামগ্রিক অর্থে হয়তো আমাদের উদারতা কিছুটা রয়েছে বলেই তালিকায় নাম আসা। নইলে আমরা এখনও রাস্তায় বিপদাপন্ন লোককে সহযোগিতার চেয়ে মোবাইলে ভিডিও করতে উৎসাহী বেশি। আগুন লাগলে নেভানোর চেয়ে সেলফিতে আগ্রহী বেশি। এসব মোটেই উদারতার লক্ষণ নয়।
কাজেই উদার দেশের তালিকায় আমরা এগিয়েছি, এটা একদিকে যেমন আনন্দের কথা তেমনি সেটিকে সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে বাঁকবদলের মতো করে উদারতা দেখানোও আমাদের উচিত এবং সেই চর্চাটাই করতে হবে। নারীর শিক্ষা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিজ্ঞান মনস্কতা, জন্মগত অধিকার, সামাজিক বৈষম্য দূর করা বা সামাজিক নিরাপত্তা যতদিন না নিশ্চিত হবে ততদিন উন্নয়নশীল দেশ হই আর উদার দেশ হই, সাধারণ মানুষের কিছুই যায় আসবে না। আমাদের প্রাত্যহিক চলাফেরা থেকে শুরু করে অভ্যাস আর আচরণে যদি উদারতার পরিচয় না মেলে তবে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র এগিয়ে গেলে তাতে মুষ্টিমেয় লোকের ভাগ্যের উন্নয়নই ঘটে। সাধারণ মানুষের ভাগ্যের শিঁকে ছিঁড়ে না।
সুইজারল্যান্ডের জুরিখের একটি পরীক্ষাগারে ৫০ জনের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, উদারতাপূর্ণ কোনও অভিজ্ঞতা অর্জনের পর মানুষের সুখের মাত্রা বাড়ে। একই সময়ে তাদের মস্তিষ্কের চৌম্বক অনুরণন চিত্র (এমআরআই) বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই সুখের প্রভাবে মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ উদ্দীপিত হয়, যা উদারতাপূর্ণ আচরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ বিষয়ে নেচার কমিউনিকেশনস সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা বলেন, তারা উদারতা ও সুখের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজতে গিয়ে তার সপক্ষে আচরণগত এবং স্নায়ুবিক প্রমাণ পেয়েছেন। উদারতা ও সুখ মানুষের ভালো থাকার মানোন্নয়ন এবং সামাজিক সাফল্যের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। উদারতার দিক দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলেও সুখের দিক দিয়ে যে আমরা পিছিয়ে সেটা গেলো বছর জাতিসংঘ প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গিয়েছিল। আমরা যেন সত্যিকার অর্থেই সবক্ষেত্রে উদার হতে পারি সেই কামনাই করি।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক