X
শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫
৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিভ্রান্তিমূলক তথ্য কীভাবে বৈশ্বিক উত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলছে

মেহেদী হাসান
১১ জুন ২০২৫, ২০:৫৯আপডেট : ১১ জুন ২০২৫, ২০:৫৯

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ২০২৫ সালের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট অনুসারে, টানা দ্বিতীয় বছরের মতো মিস-ইনফরমেশন ও ডিস-ইনফরমেশন ছড়ানোর ক্ষেত্রে ভারত শীর্ষে। সংক্রামক রোগ, জলবায়ু পরিবর্তন বা অর্থনৈতিক অসমতার চেয়েও বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এই সংকট। সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম, যেমন- হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক এবং এক্স-এর মাধ্যমে উসকানিমূলক বার্তা ও মিথ্যা খবর ছড়িয়ে বাস্তব জীবনে সহিংসতা, সামাজিক বিভাজন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবনতি ঘটছে। দ্য গার্ডিয়ানের মতে, ‘এই প্রবণতা শুধু ভারতে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি।‘

২০২৫-এর মে মাস: যুদ্ধক্ষেত্র থেকে স্টুডিও, মিথ্যার প্রতিযোগিতা

২০২৫ সালের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময় ডিজিটাল সংকটের গভীরতা উন্মোচিত হয়। আল জাজিরা এবং দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতীয় প্রাইমটাইম টেলিভিশন চ্যানেলগুলো গাজা-ইসরায়েল সংঘাত (২০২৩), রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ভিডিও গেমের ফুটেজকে ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে প্রচার করে। বিশেষত, করাচি বন্দরে ভারতীয় নৌ হামলা, ইসলামাবাদ দখল এবং পাকিস্তানি পাইলট আটকের মিথ্যা খবরগুলো আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হয়। ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিন (অনলাইন) উল্লেখ করেছে, সংবাদ স্টুডিওগুলোকে ‘ওয়ার রুম’-এ রূপান্তর করা হয়েছিল— বিমান হামলার সাইরেন, হেলিকপ্টারের শব্দ ও পাকিস্তানের মানচিত্রে টার্গেট চিহ্নিত করে দর্শকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো হয়।

কাশ্মিরের ছাত্রী ইফরাহ খলিলের অভিজ্ঞতা এই সংকটের মানবিক দিকটি তুলে ধরে: ‘টিভি দেখে মনে হয়েছিল আমার বাড়িই লক্ষ্যবস্তু! মা ফোন করে বললেন, সব মিথ্যা’ (আল জাজিরা, ১৫ মে ২০২৫)।

গণমাধ্যমের ভূমিকা: জাতীয় লজ্জা থেকে আন্তর্জাতিক অবিশ্বাস

ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সেন্সেশনাল রিপোর্টিং আন্তর্জাতিক মহলে দেশটির সাংবাদিকতার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আল জাজিরার প্রতিবেদনে উল্লিখিত ১০টি মিথ্যা খবরের তালিকায় রয়েছে:

১. জি নিউজ-এর দাবি: ভারতীয় সেনাবাহিনী ইসলামাবাদ দখল করেছে।

২. ইন্ডিয়া টুডের প্রচার: করাচি বন্দর ধ্বংসে ফিলাডেলফিয়ার বিমান দুর্ঘটনার ফুটেজ ব্যবহার।

৩. আজ তক-এর গুজব: সেনাবাহিনীর ওপর আত্মঘাতী হামলা, যা পরে প্রত্যাখ্যান করা হয়।

ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনের মতে, ‘৪০০-এর বেশি নিউজ চ্যানেলের একটি বড় অংশই মিথ্যা খবরের কারখানা। এমনকি রেটিংয়ের লড়াইয়ে প্রবীণ সাংবাদিকরাও ভুয়া ভিডিও শেয়ার করতে দ্বিধা করেননি’। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের ২০২৪ প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারতের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১তম, পাকিস্তান (১৫২তম)।

Quad ও IPEF: অঙ্গীকার বনাম বাস্তবতা

এই তথ্য সংকটের প্রেক্ষাপটে Quad (Quadrilateral Security Dialogue) এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (IPEF)-এর মতো ফোরামে ভারতের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। উভয় ফোরামই তাদের ঘোষণাপত্রে ‘ভুয়া খবরের বিস্তার রোধ’ ও ‘ক্ষতিকর ন্যারেটিভ মোকাবিলায় সঠিক তথ্য প্রসার’-এর প্রতিশ্রুতি দিলেও, ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনে ভারতের শীর্ষ অবস্থান এই অঙ্গীকারগুলোর সাথে বৈপরীত্য তৈরি করেছে।

দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ‘সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর ‘বিপর্যয়কর ব্যর্থতা’ ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময়ে মিথ্যা তথ্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারেনি। মেটা (ফেসবুকের মালিক) দাবি করেছে, তারা মিথ্যা তথ্য সরানোর জন্য ‘উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ’ নিয়েছে, কিন্তু গবেষকরা বলছেন, শীর্ষ ৪২৭টি বিভ্রান্তিকর পোস্টের মধ্যে মাত্র ৭৩টিতে সতর্কতা চিহ্নিত করা হয়েছিল।‘

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, Quad ও IPEF-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো ভারতের ওপর নজরদারি বাড়াচ্ছে। ফ্রন্টলাইনের প্রতিবেদন অনুসারে, মে মাসের সংঘাতের সময় ৮ হাজারের বেশি সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হয়, যার মধ্যে কাশ্মিরি সাংবাদিক ও স্বাধীন মিডিয়া প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সেন্সরশিপ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

অর্থনীতি থেকে কূটনীতি: মিস-ইনফরমেশনের বহুমুখী শিকার  

মিস-ইনফরমেশনের প্রভাব শুধু সামাজিক অস্থিরতায় সীমিত নয়। আল জাজিরা জানিয়েছে, বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা ভারতের তথ্য পরিবেশ নিয়ে সতর্ক হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে, ভারতীয় মিডিয়া কানাডার বিরুদ্ধে ‘পশ্চিমা ষড়যন্ত্র’ তত্ত্ব প্রচারের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ছায়া ফেলেছে।

অমর্ত্য সেন থেকে সাংবাদিকতা শিক্ষার্থী:

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সতর্কতা এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক: ‘গণতন্ত্র সঠিক তথ্য ও নৈতিকতা ছাড়া টিকে থাকতে পারে না।” এই বক্তব্য বর্তমান ভারতের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যেখানে সরকারি তথ্যকৌশল ও মিডিয়ার অস্বচ্ছতা জনগণের আস্থা হারাচ্ছে।

জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কাসিমের মতে, ‘ভারতীয় মিডিয়া আজ নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে বিনোদনের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। সত্য যাচাইয়ের চেয়ে রেটিংও গুরুত্বপূর্ণ।‘ সাংবাদিকতা পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পেশা বেছে নেওয়ার আগে নৈতিকতা বনাম জীবিকার দ্বন্দ্বে পড়তে হয়।

চূড়ান্ত প্রতিফলন: ডিজিটাল অখণ্ডতা ছাড়া বৈশ্বিক নেতৃত্ব অসম্ভব

২০২৫ সালের মে মাসের ঘটনা প্রমাণ করেছে, ক্ষেপণাস্ত্র বা জিডিপি নয়—সত্যই ভারতের সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ। দ্য গার্ডিয়ানের মতে, ‘সামাজিক মাধ্যমের মিথ্যা দাবিগুলো মূলধারার মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ‘ইনফরমেশনাল ওয়ারফেয়ার’-এর রূপ নেয়, যা দুই পরমাণু শক্তিধর দেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।‘

Quad ও IPEF-এ স্বাক্ষরিত নীতিমালাগুলো কাগজে-কলমে সীমিত না রেখে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আন্তর্জাতিক বিশ্বাস অর্জনের জন্য তথ্যের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি অপরিহার্য। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ‘তথ্য অবকাঠামোর অবিচ্ছিন্নতা ছাড়া কোনও জাতিই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে না’।

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত, সুইডেন, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
১৬ মামলার আসামি ‘পিচ্চি রাজা’ গ্রেফতার
১৬ মামলার আসামি ‘পিচ্চি রাজা’ গ্রেফতার
মৃত্যুর পরও মিলছে না পাওনা, বিপাকে হাজারো শিক্ষক পরিবার
টাইম স্কেল জটিলতামৃত্যুর পরও মিলছে না পাওনা, বিপাকে হাজারো শিক্ষক পরিবার
ইরানে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
ইরানে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
জানতেন সব কিছু, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের শঙ্কা নিয়ে চিন্তিত নন ট্রাম্প
জানতেন সব কিছু, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের শঙ্কা নিয়ে চিন্তিত নন ট্রাম্প
সর্বশেষসর্বাধিক