X
শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫
৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমরা কীভাবে ব্যবহার করবো?

প্রশান্ত কুমার শীল
১৩ জুন ২০২৫, ২০:৩৮আপডেট : ১৩ জুন ২০২৫, ২০:৩৮

সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে মতামত তৈরি হয়। আবেগ প্রকাশ পায়। অলীক সুখানুভূতিও হয়। এমনকি বাস্তব জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক সিদ্ধান্তও প্রভাবিত হয়। অথচ এই প্ল্যাটফর্মেই একদিকে দেখা যায়– কেউ যখন দুঃখের ‘পোস্ট’ দিচ্ছে, আর তাতে ‘হা হা’ রিঅ্যাক্ট পড়ছে। অন্যদিকে দেখা যায়, এক বা দুটি কমেন্টের ওপর নির্ভর করে পুরো মন্তব্যধারা গঠিত হচ্ছে। এসব ‘ডিজিটাল আচরণ’ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এর নেপথ্যে আছে গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বাস্তবতা। যা প্রথম মন্তব্যকে ভিত্তি ধরে অন্যরা একের পর এক অনুরূপ না হলেও আংশিক পরিবর্তন করে মন্তব্য করে। যেখানে নিজেদের বোধ বুদ্ধিও বিবেচনায় নেয় না। স্রেফ অনুকরণের আশ্রয় নেয়। ডিজিটাল কোডিং ভোঁতা করে দিচ্ছে আমাদের মানবিক আচরণকে। আমরা হয়তো অনেকেই মনে করছি ভার্চুয়াল জগতে সবকিছুই উন্মুক্ত। কোনও বাধা থাকে না। যা ইচ্ছে তা বলা যায়। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের উন্মুক্ত মতামত প্রকাশের জায়গা অনেকটা সংকুচিত করে। বন্দি রাখে মূলত ডিজিটাল অ্যালগরিদমের ফাঁদে। এবার দেখা যাক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে গেলে কী কী বিষয় আমাদের মাথায় রাখা উচিত-

ইমোশনাল ডিট‌্যাচমেন্ট:

ফেসবুক বা অনুরূপ প্ল্যাটফর্মে কেউ মৃত্যুবেদনা, ব্যক্তিগত কষ্ট বা মানসিক বিপর্যয়ের কথা প্রকাশ করলে দেখা যায়, কিছু নেটিজেন সেখানে হাসির রিঅ্যাকশন দেয়। এটা একদিকে যেমন আবেগীয় অসংবেদনশীলতা, অন্যদিকে ইচ্ছাকৃত ট্রলিংয়েরও নিষ্ঠুর অসভ্য প্রকাশ। এটি বোঝার প্রাসঙ্গিক মনস্তাত্ত্বিক ধারণাটিকে বলা হয়– ‘ইমোশনাল ডিট‌্যাচমেন্ট ইন ডিজিটাল স্পেসেস’। অর্থাৎ বাস্তব অনুভূতিতে কৃত্রিম ডিজিটাল হানা দেওয়ার মতো। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা প্রায়ই এসবের শিকার হচ্ছে। যেহেতু এই মাধ্যমে প্রবেশে কোনও সময় ও শ্রেণি নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই যে কেউ চাইলে যে কারো বন্ধু তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। সমাজের নানা পেশাদার বা অপেশাদার থেকে শুরু করে যে কোনও বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ এতে সংযুক্ত হতে পারেন। ব্যক্তিগত জীবনে যে অনুজকে আমরা হয়তো এড়িয়ে চলি অথবা দেখা হলে কথা বলি না। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা তার উল্টো জানান দিই। যে বন্ধু হওয়ার যোগ্য না, সে হয়ে যায় বন্ধু। সেটা হোক চায়ের দোকানদার কিংবা কাজের বুয়া। এই মাধ্যমে যে কেউ যে কারও বিষয়ে অনাধিকার চর্চা করে এবং পোস্টের রিঅ্যাক্ট কিংবা মন্তব্যের ঘরে অহেতুক নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তব জীবনে হয়তো আমরা এমনটা করতে সংকোচ বোধ করি।

অনলাইন ক্রুয়েলটি ও কগনিটিভ লেজিনেস:

ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে শরীরী ভাষা, চোখের চাহনি বা কণ্ঠস্বরের অনুপস্থিতিতে আবেগ বুঝে ওঠা কঠিন। এই মাধ‌্যম আমাদের অনুভব করার ক্ষমতা হ্রাস করে। সেই সঙ্গে অনেকের মধ্যে তৈরি হয় এক ধরনের অনলাইন নিষ্ঠুরতা (অনলাইন ক্রুয়েলটি), যা অন্যের কষ্টে হাসতে শেখায়। অন্যের কোনও সাফল্য অর্জনে, নিজেকে পোড়ায়। অন্যের বিশেষ করে কাছের মানুষের কোনও সুখের বহিঃপ্রকাশ করলে, মনের অজান্তেই কেন জানি হিংস্রতা প্রকাশ করি। হয়তো তাদের সাফল্যের পোস্টে বাজে কমেন্ট করি নতুবা কোনও কমেন্ট না করে চুপিসারে নিজের গাম্ভীর্যের রাশভারী দেখায়। তাছাড়া, অনেকেই পোস্টের মর্মার্থ উপলব্ধি না করে, ভালো করে না দেখে-না বুঝেই হাসির রিঅ্যাক্ট দেয়, শুধু অভ্যাস বা মনোযোগহীনতার কারণে। আবার অনেকে বুঝেই উঠতে পারে না যে ‘হা-হা’ রিঅ্যাক্ট এখানে অনুচিত– এটা একপ্রকার ‘কগনিটিভ লেজিনেস’ বা মানসিক অলসতা।

ডার্ক হিউমার:

বর্তমান ডিজিটাল সংস্কৃতিতে ডার্ক হিউমারের প্রসার ঘটছে। কিছু তরুণ নেটিজেন যেকোনও আবেগকে হালকাভাবে নিয়ে ট্রল করা বা মিম বানানোকে মজা বলে প্রতিপন্ন করে। এখানে অন্যকে ছোট করে একধরনের অলীক বায়বীয় সুখানুভূতি অনুভূত হয়। এতে সমাজের প্রতি বা সামাজিক জীব হিসাবে তার নিজের যে সহানুভূতি আছে তা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। কেউ দুঃখ প্রকাশ করলে, প্রতিক্রিয়াতে অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেয়– যেন এক ধরনের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রমাণ! এবং তা করে যেন পৈশাচিক আনন্দ পেতে মরিয়া তারা। অনেকেই ভাবে সুখ শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এটা সত্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে নিজেকে যত বেশি সুখী দেখায় বাস্তবে সে কিন্তু ততটা সুখী না। সে শুধু ডিজিটাল মাধ্যমে কৃত্রিম হ্যাপিনেস ঘুরপাকে থাকে।

সোশ‌্যাল প্রুফ’বা সামাজিকতার প্রমাণ তত্ত্ব:

মানুষ এখন সাহিত্য (বই) যত না পড়ে, তার থেকে বেশি সামাজিক মাধ্যমের কমেন্ট সেকশনে নেটিজেনদের কমেন্ট পড়ে। মানুষের চিন্তাভাবনা সবকিছুই সেখানে প্রতিফলিত হয়। অথচ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানেও এক অদ্ভুত প্রবণতা– যে কোনও পোস্টের কমেন্ট সেকশনে প্রথম কয়েকটি মন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী মন্তব্যগুলো তৈরি হয়। একদম অন্ধ অনুকরণ। প্রথম কয়েকটি মন্তব্য ইতিবাচক হলে, বাকিগুলোও সে-পথে হাঁটে। নেতিবাচক হলে, বাকিরাও নেতিবাচক মন্তব্য করে।

এই প্রবণতার নেপথ্যে রয়েছে ‘সোশ‌্যাল প্রুফ’ বা সামাজিকতার প্রমাণ তত্ত্ব। যখন মানুষ অন্যদের মতামত দেখে, তখন তারাও সেটিকেই ‘সঠিক’ বা ‘জনপ্রিয়’ ধরে নিয়ে, নিজের মতামত তৈরি করে। বিশেষ করে অনিশ্চিত বা জটিল বিষয়ে এই প্রবণতা আরও প্রকট। সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদমগুলো জনপ্রিয় কমেন্টগুলোকেই উপরে দেখায়, ফলে সেসব মতামত-ই সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়। এর ফলে তৈরি হয় এক ধরনের ‘কমেন্ট সেটিং’, যা বাস্তব জীবনের ‘অ‌্যাজেন্ডা সেটিং’-এর ডিজিটাল রূপ মাত্র।

ডিজিটাল সেটিং তত্ত্ব:

সংবাদমাধ্যমে ‘অ‌্যাজেন্ডা সেটিং’ একটি পুরনো তত্ত্ব, যার মাধ্যমে গণমাধ্যম নির্ধারণ করে কোন খবর বেশি গুরুত্ব পাবে, আর কোনটা নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায়– এই ক্ষমতা কিছু নেটিজেন বা ইনফ্লুয়েন্সারদের হাতে চলে গেছে। যারা পোস্ট বা মন্তব্যের মাধ্যমে জনমতের গতিপথ নির্ধারণ করে। যখন নির্দিষ্ট বিষয় বারবার আলোচনায় আসে, বা প্রথমে কিছু নেতিবাচক ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য উপরে উঠে যায়, তখন সাধারণ মানুষ ওই মতামতের দিকেই ঝুঁকে পড়ে, অনেক সময় যাচাই না করেই মন্তব্য করা শুরু করে। এই যেন চিলে কান নেওয়ার মতো। নেটিজেনরা এখন ভাইরাল হওয়ার ভৌ দৌড়ে ছুটে বেড়ায়। খুব তাড়াতাড়ি তাদের পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি বেশি ভিউ করাতে চায়। তার জন্য হাতে নেয় ভিন্ন কৌশল। যেমন- মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কুরুচিপূর্ণ শব্দ, ছবি, বাক্য কিংবা অঙ্গভঙ্গির আশ্রয়। যে করে হোক সবকিছু যেন প্রভাবিত বা টোপে ফেলানো তাদের লক্ষ্য। ডিজিটাল সেটিংয়ের মাধ্যমে আসলে তারা জনমত নিয়ন্ত্রণ করতে চাই।

ডিজিটাল সেটআপ তত্ত্ব:

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ‘কমেন্ট’ এবং ‘অ‌্যাজেন্ডা সেটিং’-এর সম্মিলিত প্রভাব সমাজে গুজব, বিভ্রান্তি ও ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করতে পারে। প্রথমে কয়েকজন ভুল তথ্য বা ভুল ব্যাখ্যা দিলেই তা সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়। যেমন– স্বাস্থ্য, ধর্ম, রাজনীতি বা কোনও জনপ্রিয় ব্যক্তিকে নিয়ে মিথ্যা বা বিরূপ মন্তব্য প্রথমেই ‘জনপ্রিয়’ হলে, পরে সেগুলোই ‘সাধারণ ধারণা’-য় রূপ নেয়।

ভুল তথ্য শুধু একবার প্রচার করলেই ক্ষান্ত হচ্ছে না বরং সেটিকে জনপ্রিয় করে তুলতেই এক ধরনের সেট-আপ তত্ত্বে আবর্তিত হচ্ছে তারা। এসব সেটিংসে আমরা গভীর ভুলে আচ্ছন্ন হয় সহজেই। ভুলে যায় কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল। একটি বায়বীয় প্রভাবকের মধ্য দিয়ে মনে হচ্ছে আমরা দৈনন্দিন সময় পার করছি। মনে হচ্ছে ডিজিটাল সেট-আপ বা বিন্যাস আমাদের সব নির্ধারণ করে দিচ্ছে।

ডিজিটাল ‘লিঞ্চিং:

নীরবতা কুণ্ডলী তত্ত্ব বা ‘স্পাইরাল অব সাইলেন্স’ বেশ জনপ্রিয় তত্ত্ব সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ অধ্যায়ন বিভাগে। যোগাযোগের যত সব তত্ত্ব আছে এর মধ্যে এই তত্ত্বটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে বেশ সরব মতামত একটা সময় মিডিয়া সুকৌশলে নীরব করে দেয়। এর প্রভাবে যখন একপাক্ষিক মতামত ছড়িয়ে পড়ে, তখন ভিন্নমতাবলম্বীরা চুপ করে যেতে বাধ্য হয়। এই নীরবতা আসলে বিকল্প মতের মৃত্যু। তারপর এক সময় মানুষের মনে হয়– ভিন্ন কিছু বলা মানেই অপ্রিয় হওয়া, বিদ্রুপের শিকার হওয়া, কিংবা ডিজিটাল ‘লিঞ্চিং’-এর মুখোমুখি হওয়া মনে করে।

এতে মতের বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়, বিতর্কের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগামহীন কু-রসিকতা, ভুল রিঅ্যাক্ট, আর বিদ্রুপ– সবকিছু মিলে তৈরি করছে একপ্রকার আবেগহীন ডিজিটাল সমাজ। এখানে সহানুভূতি, সমবেদনা কিংবা শ্রদ্ধা– যেন এক ‘রিঅ্যাক্ট বাট্‌ন’-এ সীমাবদ্ধ। মানুষ বাস্তব জীবনে মুখোমুখি সহানুভূতি পায়, কিন্তু ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে হয় নিঃসঙ্গ, হয় বিদ্রুপের শিকার। এর ফলে সমাজে তৈরি হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা, মেরুকরণ, ও মানসিক দূরত্ব।

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের এই মিডিয়ার প্রভাব সম্পর্কে আরো সচেতন করা দরকার– বিশেষত কিশোর-কিশোরীদের। ‘রিঅ্যাক্ট’ বা ‘কমেন্ট’ দেওয়ার আগে ভাবা, যাচাই করা, এবং অন্যের আবেগের প্রতি সম্মান দেখানো একটি সামাজিক দায়িত্ব।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রামায়ণের পৌরাণিক বীর মেঘনাদের মতো আড়াল থেকে মন্তব্য করা যায় বলে, অন্যের ভাবাবেগকে আহত করে যা খুশি মতো মন্তব্য করা উচিত নয়। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মও যেন ভুল বা বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যকে প্রোমোট না করে, তার জন্য অ্যালগরিদমিক স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং দায়িত্বশীল হতে হবে।

মনে রাখতে হবে, অনলাইনে সদাচরণ, সহানুভূতি, ও সহমর্মিতা চর্চা করাও সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য এক ধরনের সামাজিক আন্দোলন। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের অবশ্যই ডিজিটাল লিটারেসি সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে এবং এই সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী হতে হবে।

লেখক: গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঈদের ছুটির শেষ দিনে কমলাপুরে যাত্রীদের ঢল, ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়
ঈদের ছুটির শেষ দিনে কমলাপুরে যাত্রীদের ঢল, ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়
তাপপ্রবাহের পর ময়মনসিংহে আধা ঘণ্টার বৃষ্টিতে স্বস্তি
তাপপ্রবাহের পর ময়মনসিংহে আধা ঘণ্টার বৃষ্টিতে স্বস্তি
ঈদের ছুটির শেষ দিনে আকাশপথেও ঢাকায় ফিরছেন কর্মজীবীরা
ঈদের ছুটির শেষ দিনে আকাশপথেও ঢাকায় ফিরছেন কর্মজীবীরা
সিডনির ডাকে প্রথমবার বিগ ব্যাশ লিগে বাবর
সিডনির ডাকে প্রথমবার বিগ ব্যাশ লিগে বাবর
সর্বশেষসর্বাধিক