এখানে প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া জরুরি যে, মোহাম্মদ নাসিম যদি কখনও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন না করতেন এবং করোনা-মহামারি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিচ্যুতি ও অব্যবস্থাপনাকে এতটা নগ্ন করে না তুলতো, তাহলে তার মৃত্যু নিয়ে এতটা ভয়ংকর ও কুৎসিত উল্লাস প্রকাশও হয়তো আমরা দেখতে পেতাম না। যেহেতু তিনি এক মেয়াদে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তার সময়ে এই খাতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এবং এসব দুর্নীতিতে তিনি ও তার পরিবারের নাম যুক্ত হয়েছে এবং তিনি বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা আজও দেওয়া হয়নি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন মোহাম্মদ নাসিমের স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন হওয়া দুর্নীতির অভিযোগগুলোর কোনও তদন্ত অথবা এ বিষয়ে কোনও ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, সেহেতু মৃত্যুর পর তার বিরুদ্ধে জনরোষের প্রকাশটা সুখকর হবে না, সেটা বিবেচনায় রেখেই এই আলোচনাটা করছি। ব্যক্তির মৃত্যুতেই তার কর্মের দায়মুক্তি ঘটে- এরকমটি বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু মোহাম্মদ নাসিমই কেবল নন, সৈয়দ আশরাফ, ড. হুমায়ূন আজাদ, ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর পরও নগ্ন উল্লাসকারীদের ঘৃণ্য উচ্ছ্বাস আমরা দেখেছি। ফলে কেবল স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মোহাম্মদ নাসিমের কথিত দুর্নীতির জন্যই তিনি মৃত্যুর পর তার প্রাপ্য সম্মানটুকু পাচ্ছেন না, চরম নোংরা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন- বিষয়টা তেমন সরলভাবে দেখার কোনও সুযোগ এক্ষেত্রে নেই।
মোহাম্মদ নাসিমের (পড়ুন সৈয়দ আশরাফ, ড. আনিসুজ্জামান, ড. হুমায়ূন আজাদ কিংবা শাহরিয়ার কবীর, মুনতাসীর মামুন বা ড. জাফর ইকবাল) ওপর এই কথিত উল্লাসীদের বিদ্বেষ, অসূয়া এবং ঘৃণার কারণ বহুবিধ। প্রথমেই এটা এ কারণে যে, মোহাম্মদ নাসিম কিংবা সৈয়দ আশরাফ কিংবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- প্রত্যেকের পিতাই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকা সেনানী। যদিও তাদের কাউকেই মুক্তিযুদ্ধে শত্রুর হাতে প্রাণ দিতে হয়নি, তাদের হত্যা করেছে এ দেশেরই কুলাঙ্গার ও আজকে উল্লাস-প্রকাশকারীদের পিতা কিংবা ভাইয়েরা। হয়তো মন্তব্যটা ঢালাও হলো কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাকিদের এই কাতারে ফেলতে অসুবিধা হয় না। কারণ, তারা কেবল নাসিমের মৃত্যুতে উল্লাস করে না, তারা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ, শেখ হাসিনা কিংবা উদার-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পক্ষে যে বা যে-ই দাঁড়াক, তারই কোনও বিপদে-আপদে-মৃত্যুতে তীব্র উল্লাসে ফেটে পড়ে।
মোহাম্মদ নাসিম কিংবা তার পক্ষের মানুষেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনই বাংলাদেশে জেঁকে বসা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। আমরা ভুলে যাই যে, গোটা দুটি দশক দেশে স্বৈরশাসন কেবল দেশের গঠনতান্ত্রিক পরিবর্তনই ঘটায়নি, স্থায়ী অব্যবস্থা হিসেবে দুটো স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকেও বাংলাদেশের গলায় গেঁথে দিয়ে গেছে। এর সঙ্গে ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা যোগ করলে এদের মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে একা আওয়ামী লীগের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা এক অসম্ভব ও ‘কখনও শেষ না হওয়া’ ব্যাপারই বটে। দুঃখজনক হলো, আমরা এই যুদ্ধকে কেবল মোহাম্মদ নাসিম কিংবা শেখ হাসিনার যুদ্ধ হিসেবে তাদের মাঠে রেখে নিজেরা নিরাপদে থেকেছি- সকলে না হলেও আমাদের একটি বিরাট অংশ। আরও দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এই দীর্ঘ সেনাশাসন ও তাদের সৃষ্ট রাজনৈতিক দলসমূহের রাজনীতি আসলে মোটা-দাগে “গিভ অ্যান্ড টেক”-এর। এখানে আদর্শের কোনও বালাই নেই, যে দিকে বৃষ্টি সেদিকেই ছাতা উত্তোলন এবং ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে নিজেদের ব্যাংক-ব্যালেন্স বাড়ানো, নিজের দলের লোকদের দিয়ে শিল্পায়নের নামে দেশকে শোষণ, অর্থপাচার এবং কালো টাকা দিয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতির ১৯৭৫-পরবর্তীকাল। এর থেকে আওয়ামী লীগ নিজেকে মুক্ত রাখতে পারতো কিনা- এ প্রশ্ন আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। কারণ, অন্য রাজনৈতিক দল করলে যদি বাড়ি-গাড়ি-শিল্পপতি হওয়া যায় তাহলে কেবল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আর যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি নিয়ে রাজনীতি করতে কতজনকে আওয়ামী লীগের পাশে পাওয়া যাবে সে প্রশ্ন উড়িয়ে দিলে সত্যকে অস্বীকার করা হবে। এখানেই আসে সিস্টেমের প্রশ্ন, যে সিস্টেম বাংলাদেশে স্বৈরশাসকবর্গ ও তাদের রাজনৈতিক দলের সরকার তৈরি করেছে তা ভেঙে কিংবা তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করার মতো বিপ্লবী দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে ক্রেডিট দেওয়ার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ এই সিস্টেমের ভেতরই রাজনীতি করছে, সরকার গঠন করছে এবং টিকে থাকছে। যার জন্য তাকে বহুবিধ কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে, যার অনেকটির সঙ্গেই আপনি-আমি একমত না হতে পারি কিন্তু বাংলাদেশের সিস্টেমে সেগুলো পুরনো ও অনুসৃত। এই সিস্টেমের ভেতরও আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে গিয়ে পুলিশের লাঠির বাড়িতে মোহাম্মদ নাসিম কিংবা মতিয়া চৌধুরী অথবা সোহেল তাজ রাস্তায় শুয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করেন অথবা শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার শিকার হয়ে অর্ধশতাধিক মানুষ মারা যায় কিংবা গুরুতর আহত হয়।
এই সিস্টেমের ভেতরই মোহাম্মদ নাসিমের আগে ও পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা এ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ‘লুটেপুটে’ খায়। শুধু স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেন? লুটেপুটে খাওয়ার চিত্রটা কি অন্য কোনও মন্ত্রণালয়ে নেই? যেহেতু এখন দেশে দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা মানুষের সামনে উন্মোচিত সেহেতু এখন আলোচনা কেবল এটাতেই সীমাবদ্ধ। মোহাম্মদ নাসিম কিংবা বিএনপি বা এরশাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রীদের কেউই যে এ দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না খুব একটা, যতটা নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে। মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে বিদেশে সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, ওদিকে খন্দকার মোশাররফ হোসেন লন্ডনে কোটি কোটা টাকা পাচার করেছেন বলে দুদকের মামলায় আদালতে প্রমাণ হিসেবে ব্যাংক হিসাব, বাড়ির মালিকানা ইত্যাদি দলিল-দস্তাবেজ দাখিল করা হয়েছে। আর এরশাদের আমলের স্বাস্থ্য মন্ত্রীদের দুর্নীতির বিষয়টি তো আজকাল আর উল্লেখেরও কেউ প্রয়োজন বোধ করেন না। অর্থাৎ বাংলাদেশে একটি সিস্টেম দাঁড়িয়েছে, যে সিস্টেমে কোনও পক্ষই জনস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন না। দুঃখজনক হলো, আওয়ামী লীগ এই যে তিন মেয়াদ ধরে ক্ষমতায় আছে, তাদের হাতেও স্বাস্থ্য বিভাগ কিংবা এই চলে আসা সিস্টেমে বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন আনাটা সম্ভবপর হয়নি- একে ব্যর্থতা হিসেবেই তুলে ধরতে হবে এবং একে ভিন্নভাবে দেখার কোনও সুযোগই নেই।
কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রী হিসেবে দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় এবং আজকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চরম ‘অব্যবস্থা’ গোচর হওয়ায় নাসিমের মরণোত্তর বিচার এবং তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত দাবি না করে তার মৃত্যুতে তীব্র উল্লাস প্রকাশ করার পেছনের কারণটি কি? কারণটি এটাই যে, তিনি জেলের ভেতর ঘাতকের বেয়নেটে নিহত হওয়া ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর পুত্র, প্রেসক্লাবের সামনে পুলিশের লাঠির বাড়ি খাওয়া কিংবা বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি ও শাসনের সমালোচনাকারীদের প্রথম সারির একজন। একই কথা প্রযোজ্য সৈয়দ আশরাফ কিংবা ড. আনিসুজ্জামান কিংবা ড. হুমায়ূন আজাদের ক্ষেত্রেও। এরা যদি এ পক্ষের রাজনীতির সমর্থক না হতেন তাহলে তারা মৃত্যু-পরবর্তীকালে এতটা নোংরা আক্রমণের শিকার হতেন না। মোহাম্মদ নাসিমের ক্ষেত্রে আসলে এ সবকিছুই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, তাই তার ভাগ্যে নোংরামিটাও বেশিই জুটছে। আর এখানেই রয়েছে আওয়ামী লীগের জন্য শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি।
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে কিন্তু ক্ষমতায় এসে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রের বিপক্ষে যায় এমন কোনও কিছু করবে সেটা আওয়ামী লীগের প্রকৃত কোনও সমর্থক মেনে নেবে না, যে কারণে আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের চাওয়াটা হয়ে যায় বিশাল। এক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি কারোরই এরকম কোনও দায় বা দায়িত্ব নেই। দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হোক, জেল হোক, কিংবা বছরের পর বছর বিদেশে পালিয়ে থেকে যতই রাজসিক জীবনযাপন করুক না কেন- এসবে তাদের কোনও পাপ নেই, সাত খুন মাফ। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার করবেন একদিকে কিন্তু অন্যদিকে বালিশকাণ্ড ঘটবে বাংলাদেশে, কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আবজালরা হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাবে- এটা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে মেলে না বলেই লোকে হাহাকার করে ওঠে।
মোহাম্মদ নাসিম দিনভর দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সমালোচনা করবেন আর দিনশেষে তার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য খাতকে ‘শেষ’ করে দেওয়ার অভিযোগ থাকবে, এটা হতে পারে না। তাই মৃত্যুর পর তার বিরুদ্ধে সব আক্রোশ গিয়ে শেষ হয় তার পিতৃপরিচয়, আজীবন করে আসা তার রাজনীতির ওপর। মোহাম্মদ নাসিমকে যদি আওয়ামী লীগ রাজনীতির একটি ‘একক’ ধরি তাহলে ‘অযুত’ আওয়ামী লীগারের জন্য শিক্ষা এটাই যে, ভবিষ্যতে কোনও আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুর পর যেন তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কারণে আঙুল তুলতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করার রাজনীতিতে মনোযোগ দেওয়া। বাকি যেসব কারণে মূল আক্রমণ সেটা তো সকলকেই সহ্য করতে হয়েছে এবং হবেও। এক্ষেত্রে মোহাম্মদ নাসিম, সৈয়দ আশরাফ কিংবা শেখ হাসিনা কারোরই কোনও মাফ নেই। মনে রাখা দরকার, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর পুত্রের কাছে মানুষ অন্য কাউকে নয়, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর রাজনীতিকেই খোঁজে; শেখ হাসিনার কাছে মানুষ বঙ্গবন্ধুকেই খোঁজে।
লেখক: সাংবাদিক