দুই.
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব ও অহংকার শহীদ রফিক যে জগন্নাথের ছাত্র ছিলেন তাঁর কয়েকটি তথ্য তুলে ধরছি: ভাষা শহীদ রফিকের বাল্যবন্ধু ইসমাইল উদ্দিন আহমদ তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “১৯৫০ সালে দেবেন্দ্র কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষা দেওয়ার পর আমরা (ভাষা শহীদ রফিক ও ইসমাইল) আলাদা হয়ে যাই। রফিক ঢাকায় ভর্তি হওয়ার চেষ্টা চালায়।” রফিকের ওই চেষ্টা যে সফল হয় তা ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত “ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি স্মারক গ্রন্থে” উল্লেখ রয়েছে। ওই গ্রন্থে বলা হয়েছে, ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদ রফিক, পুরো নাম রফিক উদ্দিন।...মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে ১ম ও ২য় বর্ষে লেখাপড়া করেন। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ছিলেন।...মাত্র ২৬ বছর বয়সে রফিক ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।” ভাষা শহীদ রফিক দেবেন্দ্র কলেজে বাণিজ্য বিভাগে পড়ালেখা করেছেন। জগন্নাথ কলেজে কোন বিষয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তা নিশ্চিত করে জানা যায় না। তবে তিনি জগন্নাথ কলেজের নিয়মিত নয়; অনিয়মিত অর্থাৎ সান্ধ্যকালীন কোর্সের ছাত্র ছিলেন এটি নিশ্চিত। অবশ্যই অসমর্থিত একটি সূত্র বলছে: তিনি জগন্নাথের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
তিন.
ভাষা শহীদ রফিকের বাবা একজন প্রেস ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং জামাতা মোবারক আলী খানের পরামর্শে বাবু বাজার এলাকায় আকমল খান রোডে ‘পারিল প্রিন্টিং প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। ওই যৌথ ব্যবসায়ে ভাষা শহীদ রফিকের পিতা আবদুল লতিফের অপর অংশীদার ছিলেন রফিকের মামা ফেলু খাঁ। তিনিও কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। তবে বছর দেড়েক পর উভয়ের মধ্যে ব্যবসা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং দু’জনে আলাদা হয়ে যান। শ্যালক আলাদা ব্যবসা শুরু করায় ভাষা শহীদ রফিকের পিতার পক্ষে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা এসে প্রেস ব্যবসা দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে তিনি প্রেসের যন্ত্রপাতি ও বণ্টনকৃত মালামাল বিক্রি করে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু রফিক পিতাকে বলেন, পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি ওই প্রেস ব্যবসা দেখাশোনা করবেন। পুত্রের বিশেষ আগ্রহের কারণে রফিকের পিতা বাদামতলিতে ‘কমার্শিয়াল আর্ট প্রেস’ নামে নতুন প্রেস ব্যবসা শুরু করেন। রফিকের অক্লান্ত কর্মনিষ্ঠায় ব্যবসা সুচারুরূপে চলতে থাকে।
ওই প্রেস ব্যবসা পরিচালনার স্বার্থেই রফিক জগন্নাথ কলেজের সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি হন। ওই সময় ভাষা শহীদ রফিকের মতো যারা পড়ালেখার পাশাপাশি অন্য কাজ করতেন তাদের কথা মাথায় রেখেই জগন্নাথে ওই কোর্সটি চালু করা হয়। যে কেউ চাইলেই ওই কোর্সে ভর্তি হয়ে কাজের পাশাপাশি স্বাচ্ছন্দ্যে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারতেন। ভাষা শহীদ রফিকও ওই সুযোগ নেন। আব্বাস উদ্দিন আহমদের মতে, “১৯৪৬ সালে কলকাতায় মহাদাঙ্গার পর রফিক দেশে ফিরে আসেন এবং বয়রা স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে বাণিজ্য বিভাগে। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি তিনি মাঝেমধ্যে পিতার প্রেসের ব্যবসা দেখাশোনা করতেন।” (ভাষাশহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, জুন ২০১০, পৃ. ১৪)।
পরিশেষে, ভাষা শহীদদের সম্পর্কে আগামী প্রজন্মকে জানাতে সত্য ইতিহাস তুলে ধরা সবার দায়িত্ব। গণমাধ্যমে অথবা অন্য কোথাও ভাষা শহীদদের জীবনী আলোচনা অথবা ভাষা আন্দোলনে তাদের অবদান তুলে ধরার ক্ষেত্রে সর্বশেষ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে লেখা প্রকাশ অথবা বক্তব্য প্রদান করা উচিত। আর এমনটি করা সম্ভব হলে নতুন প্রজন্ম ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন। আমরা আশা করতে চাই, আগামী দিনে ভাষাশহীদ রফিক সম্পর্কে আলোচনায় অথবা প্রবন্ধ বা ফিচার প্রকাশে তিনি দেবেন্দ্র কলেজের পাশাপাশি জগন্নাথেরও ছাত্র ছিলেন সে বিষয়টিও তুলে ধরা হবে। শুধু ভাষাশহীদ রফিক নয়, অন্য ভাষা শহীদদের সম্পর্কে আলোচনা বা প্রবন্ধ প্রকাশ অথবা ফিচার লেখার সময়ও সদ্যপ্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে প্রকাশের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার জন্য সবার নিকট বিনীত অনুরোধ করছি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
salah.sakender@outlook.com