X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

টাইম ম্যাগাজিনে শেখ হাসিনা: কী বার্তা পাবে পশ্চিমারা?

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
২০ নভেম্বর ২০২৩, ১৯:২৭আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২৩, ১৯:২৭

সম্প্রতি বিখ্যাত টাইম সাময়িকীতে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কাভার স্টোরি ছাপা হয়েছে। ওই কাভার স্টোরির মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থা ও এর সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে পশ্চিমা পাঠকদের ধারণা দেওয়া। ২০২৪ সালের বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে টাইম সাময়িকীর ওই প্রতিবেদন তাই বেশ গুরুত্ব বহন করে। ওই প্রতিবেদনের মাধ্যমে পশ্চিমা জনগণ বাংলাদেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থা ও তার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে একটি ধারণা পাবে। বাংলাদেশ সম্পর্কে যেকোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যা পশ্চিমা শাসকদের কাজে দেবে। বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও জবাবদিহিমূলক সুশাসন বিষয়ে; স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা, অর্থনীতি, সামরিক বাহিনী ও রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে পশ্চিমা জনগণকে জানানোই ওই প্রতিবেদনের মূল লক্ষ্য। কারণ, উপর্যুক্ত প্রতিটি বিষয়ে পশ্চিমের জনগণের স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হলেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে বাংলাদেশ সম্পর্কে যেকোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।

পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর কাছে তার জনগণের মতামতের গুরুত্ব রয়েছে, শাসকদের তাদের সামগ্রিক কার্যক্রমের জন্য জনগণের কাছে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জবাবদিহি করতে হয় বিধায় যেকোনও অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শাসকদের জন্য জনপরিসর কী ভাবছে তার গুরুত্ব রয়েছে। টাইমের মতো সাময়িকীগুলো প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ওই জনমত তৈরিতে কাজ করে। সেই কারণে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন অথবা লিবিয়ার গাদ্দাফির মতো নেতারা টাইমের প্রচ্ছদে জায়গা পান এবং পশ্চিমা জনপরিসরে ওই কাভার স্টোরির বদৌলতে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবার পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সহজে তাদের বিরুদ্ধে নানা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। পশ্চিমের জনগণ ওই পদক্ষেপকে তখন স্বাগত জানায়।

তাই মোটাদাগে টাইম সাময়িকীর ওই প্রতিবেদন বাংলাদেশ ও তার সরকার প্রধান শেখ হাসিনা সম্পর্কে পশ্চিমা জনগণকে ইতিবাচক ধারণা দেওয়ার জন্য ছাপা হয়েছে এমন দাবি করা হলে তা অতিরঞ্জিত হবে। বরং বর্তমান সরকারকে নানা ইস্যুতে বিতর্কিত করা ও পশ্চিমা জনগণের কাছে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করাই ওই প্রতিবেদনের সূক্ষ্ম উদ্দেশ্য। প্রতিবেদনের ছত্রে ছত্রে তার প্রমাণ রয়েছে।

অনেকের কাছে মনে হতে পারে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে লেখা বাক্য, তিনি মারগারেট থেচার অথবা ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে বেশি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন তা ইতিবাচক। কিন্তু এক্ষেত্রে পশ্চিমা জনগণের মনস্তত্ত্ব বোঝা দরকার। তারা একই ব্যক্তিকে বারবার শাসক হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত নয়, তারা একজন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী পদে দুইবারের বেশি দেখে না। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের নির্বাচন ও সরকার কাঠামোর দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হবে। সুতরাং বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি হাইলাইট করায় পশ্চিমের জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করবে না। টাইমের নিউজের ইন্ট্রো যেভাবে শুরু হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর শাসনামলকে গ্লোরিফাই করতে তার সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করেননি।

বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামপন্থিদের দমিয়ে রেখেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে টাইমের ওই প্রতিবেদনে। এই একটি লাইন বাংলাদেশ ও বর্তমান সরকার সম্পর্কে পশ্চিমা জনগণের কাছে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারতো। কিন্তু পুরো প্রতিবেদন পড়লে বোঝা যাবে যে বাংলাদেশে এখনও ইসলামি সন্ত্রাসীদের প্রভাব রয়েছে এমন কথা প্রচার করা হয়েছে। তাই বর্তমান সরকার ইসলামপন্থিদের কোণঠাসা করে রেখেছে এমন কথা লিখলেও প্রতিবেদক ওই প্রতিবেদনের পরের অংশে গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনা উল্লেখ করে লিখেছেন, আইসিসের হলি আর্টিজানের ওই হামলার প্রভাব এখনও ঢাকা শহরে রয়েছে। ওই কারণে ঢাকার অনেক রেস্টুরেন্টে বিদেশিদের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যাতে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীরা তাদের জিম্মি করে নতুন কোনও হলি আর্টিজান ঘটাতে না পারে। এর মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে বাংলাদেশে এখনও আইএসআইএস-এর প্রভাব রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ইসলামি সন্ত্রাসী নির্মূলের যে দাবি প্রচার করা হয় তা টাইম সাময়িকীর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি বলেই তারা বিদেশিদের রেস্টুরেন্টে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার কথা লিখেছে।

এ কথা সত্য যে শেখ হাসিনার সরকার সম্পর্কে টাইমের প্রতিবেদনে ইতিবাচক কথাও লেখা হয়েছে। তবে শেখ হাসিনার সরকারের ওই সাফল্যগুলো আংশিক তুলে ধরা হয়েছে। যেমন: ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান সরকারের সময় ৯৮ ভাগ মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু প্রাথমিকের পরেও উচ্চশিক্ষায় মেয়েরা ভালো করছে। এক্ষেত্রে ঝরে পড়ার হার অনেক কম। সরকার তাদের মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে উপবৃত্তি প্রদান করায় মেয়েরা উচ্চশিক্ষায় ভালো করছে তা তুলে ধরা হয়নি ওই প্রতিবেদনে। টাইমের ভাষ্যমতে অন্য সুখবর হচ্ছে, বাংলাদেশ হাইটেক ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় দেশে পরিণত হচ্ছে। ওই কারণে স্যামসাংয়ের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সাপ্লাই চেইন চীন থেকে বাংলাদেশে সরাতে পারছে।

শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বাংলাদেশের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সাফল্যের কথাও তুলে ধরা হয়েছে টাইমের ওই প্রতিবেদনে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন এমনভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে যে তারা একসময় নিজের খাদ্য জোগাড় করতে সংগ্রাম করলেও এখন খাদ্য রফতানি করছে। বাংলাদেশের জিডিপির ঊর্ধ্বমুখিতারও প্রশংসা করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৭১ বিলিয়ন, যা ২০২২-এ এসে দাঁড়িয়েছে ৪৬০ বিলিয়নে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, যার অবস্থান ঠিক ভারতের পরে। কিন্তু অর্থনীতির উচ্চ প্রবৃদ্ধির ফলে জনগণের জীবনমানের পরিবর্তন হয়েছে এমন কোনও কথা লেখা হলে তা সরকারের জন্য ইতিবাচক হতো। বরং একজন রিকশাচালকের মুখে বলানো হয়েছে, তার প্রতিদিন আয় চারশত টাকা। ওই আয় দিয়ে তার পক্ষে স্ত্রী ও দুই সন্তানের জন্য রান্নার তেল ও ডাল কিনতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ২০০০ লোক গ্রামাঞ্চল ছেড়ে জনবহুল রাজধানী ঢাকায় কেন আসছে সেই প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশের জিডিপির বৃদ্ধিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। দুই অঙ্কের মুদ্রাস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে রয়েছে এবং তাদের জীবন যে যন্ত্রণাময় হয়ে উঠেছে তা তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব রাখছে তাও বলা হয়েছে। উপর্যুক্ত বিষয়গুলো তুলে ধরায় জিডিপির সাফল্যের দিক শেষ পর্যন্ত ফিকে হয়ে গেছে।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে ‘গৃহবন্দি’ আছে বলার পাশাপাশি ওই প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগকে সন্দেহজনক বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে পশ্চিমা জনগণ বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা পাবে। কারণ, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় সচরাচর বিরোধী দলকে দমনে নানা ধরনের হয়রানিমূলক মামলা এবং সরকার কর্তৃক বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের জেলে বন্দি করা হয়, পশ্চিমা জনগণ এমনই মনে করে।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চি যখন দীর্ঘসময় সামরিক জান্তা কর্তৃক গ্রেফতার ছিল তখন পশ্চিমা গণমাধ্যমে তার সম্পর্কে এমন বক্তব্য ছাপা হতো, যা পশ্চিমা জনগণকে তার প্রতি সমব্যথী করে তোলে। পশ্চিমে তিনি গণতন্ত্রের লড়াইয়ের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন।

সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকদের হয়রানি করা, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রভৃতি বিষয়ে টাইমের সংবাদ বাংলাদেশের সুশাসন ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেবে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে সবচেয়ে যে ইতিবাচক কথা তুলে ধরা হয়েছে তা হলো, তিনি পশ্চিমা স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর নন। উন্নয়নশীল বিশ্বের যে কয়জন নেতা পশ্চিমাদের জন্য উপকারী বলে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছেন, শেখ হাসিনা তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছেন। তিনি পুতিনের ইউক্রেন অভিযানের সমালোচনা করেছেন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে তার সরকারের যে ‘মাখামাখি’ আছে তা উল্লেখ করতে প্রতিবেদক ভোলেননি। রাশিয়া বাংলাদেশের সুশীল সমাজকে বৃত্তি প্রদান করছে বলে প্রতিবেদক উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া প্রতিবেদক বাংলাদেশে রাশিয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে তার প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে রাশিয়ার ইউরেনিয়াম পৌঁছে গেছে তা তিনি লিখেছেন। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প পশ্চিমাদের জন্য এক আতঙ্কের নাম। বাংলাদেশের পারমাণবিক প্রকল্পে তাই রাশিয়ার অংশীদারিত্ব কতোটা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর জন্য স্বস্তিদায়ক হবে তা ওই প্রতিবেদন থেকে বোঝা না গেলেও প্রতিবেদকের পারমাণবিক প্রকল্প বিষয়টি তার প্রতিবেদনে হাইলাইট করায় পশ্চিমা জনপরিসরে নানা প্রশ্নের জন্ম হবে।

টাইমে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম “শেখ হাসিনা অ্যান্ড দ্য ফিউচার অব ডেমোক্র্যাসি ইন বাংলাদেশ” তথা “শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ”। প্রতিবেদনের শিরোনাম থেকে বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে পশ্চিমা জনপরিসরে নানা প্রশ্ন রয়েছে।

ওই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই টাইম সাময়িকী ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ও তার জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করে গণতান্ত্রিক শাসন ছাড়া সুশাসন, ন্যায়বিচার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কিন্তু টাইমের ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেছেন, ‘জনগণ তার সঙ্গে রয়েছে এবং জনগণই তার প্রধান শক্তি।’ কিন্তু প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওই দাবির সপক্ষে কোনও তথ্য-উপাত্ত যুক্ত করা হয়নি। এক্ষেত্রে এই বছরের আগস্ট মাসে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের আইইআরের জরিপের তথ্য প্রতিবেদক তুলে ধরতে পারতেন। আইইআরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭০ ভাগ মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

প্রতিবেদক যখন বাংলাদেশের বিমানবন্দরে তার ফ্লাইটের জন্য বসে ছিলেন তখন তিনি টিভি পর্দায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার হচ্ছে বলে দেখতে পান। কোনও শাসনব্যবস্থাকে পপুলিস্ট হিসেবে পশ্চিমা গণমাধ্যম যখন দেখে তখন তারা ওই শাসনব্যবস্থার শাসকের এমন প্রচার-প্রচারণাকে হাইলাইট করে প্রচার করে পপুলিজমের সিম্বল হিসেবে।

এ কথা ঠিক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নির্বাসিত জীবন এবং তার পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সদস্যদের সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্য কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবায়নে চেষ্টা করছেন, তার ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেন।

বাংলাদেশ তথা শেখ হাসিনার অন্যতম সাফল্য বাস্তুচ্যুৎ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালানোর সময়ে বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মতো মানবিক কাজ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু টাইমের ওই প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশের ওই প্রশংসিত মানবিক কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী শরিফ হুসাইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তারা মরলো না বাঁচলো তাতে বাংলাদেশের কিছু যায় আসে না। বাংলাদেশ কেবল রোহিঙ্গাদের তাদের জমিন থেকে বের করে দিতে চায়।’

টাইমের ওই প্রতিবেদনে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য পদ্মা সেতুর কথা নেই। মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে আমূল পরিবর্তন হয়েছে তা পুরোপুরি অনুপস্থিত। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও গণমানুষের জীবন-জীবিকায় কী প্রভাব রাখবে তার আলোচনা প্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু টাইমের প্রতিবেদক অজ্ঞাত কারণে ওই বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। এমনকি কমিউনিটি ক্লিনিক বা মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাওয়ার জন্য বর্তমান সরকার যে জাতিসংঘ পুরস্কার পেয়েছে অথবা ঘরহীন সব মানুষের জন্য বিনামূল্যে ঘরের ব্যবস্থা করায় প্রান্তিক ছিন্নমূল মানুষের জীবনযাপনের পরিবর্তন হয়েছে, সেই বিষয়েও কিছুই লেখা হয়নি। টাইমের প্রতিবেদকের উপর্যুক্ত দুটিসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীরবতা তাই তার প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।

আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ওই প্রতিবেদনে বিএনপির কথা থাকলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নামগন্ধ নেই। পুলিশের গাড়ি ও পাবলিক বাসে আগুন দেওয়া এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বিএনপি কর্মীদের জড়িত হয়ে গ্রেফতার হবার কথা উল্লেখ থাকলেও রহস্যজনকভাবে জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও হত্যার রাজনীতি সম্পর্কে একটি শব্দও লেখা হয়নি। জামায়াত সম্পর্কে প্রতিবেদকের এই নীরবতা প্রশ্নসাপেক্ষ।

তবে আশার কথা হচ্ছে, ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গুরুত্বের কথা তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে এককভাবে সর্বোচ্চ সৈন্য প্রদানকারী দেশ এবং ইউএস সামরিক বাহিনীর ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত মহড়ার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এশিয়ার মধ্যে দ্রুত বর্ধনশীল বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের গুরুত্ব পশ্চিমা জনপরিসরে আরও বাড়াবে। এর পাশাপাশি উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া সেন্টারের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের যে উদ্ধৃতি ছাপা হয়েছে তারও বেশ গুরুত্ব রয়েছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা চাপগুলো হিতে বিপরীত হতে পারে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকার আগের চেয়ে বেশি সংকল্পবদ্ধ হতে পারে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তার পক্ষে যা করা সম্ভব তা করতে পারে।

পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী যদি মাইকেল কুগেলম্যানের কথা আমলে নেয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর ভিসা স্যাংশনের যে ঘোষণা দিয়েছে তা প্রয়োগের আগে তারা আরও সতর্কভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বাংলাদেশ তাদের শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হোক এমনটি মোটেও চায় না। বরং তারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে বাংলাদেশকে তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত করতে চায়।

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব তাদের অজানা নয়। টাইমের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ওই গুরুত্বের কথা আলোচনায় আসায় পশ্চিমা জনপরিসরে বাংলাদেশ নিয়ে আরও আলোচনা-সমালোচনার পরিমাণ বাড়বে। বাংলাদেশ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে নয় অথবা শার্ট-প্যান্ট সেলাই করা জাতি হিসেবে নয়; বরং ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী অর্থনীতি নিয়ে তাদের সঙ্গে হাঁটছে সেই ধারণা তৈরি হবে, যা এক অর্থে পশ্চিমে বাংলাদেশের ইমেজ বাড়াবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ