ওয়াসার এমডিগণের ‘অদৃশ্য খুঁটি’

ওয়াসার এমডি বললেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের কথা। তিনি ঢাকা ওয়াসার প্রায় সমর্থক শব্দে পরিণত হয়েছেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে কারও মনে প্রশ্ন আসতেই পারে , আচ্ছা ২০০৯ সালের আগে কি ঢাকায় পানির কলে ঠিকঠাক পানি আসতো? যতটুকু পানি আসতো সেটুকু কি বুড়িগঙ্গার পানির মতো কালো ছিল? জনাব তাকসিম যখন আর ওয়াসার এমডি থাকবেন না, তখন আমাদের কলে ঠিকঠাক পানি আসবে তো?

ঢাকা ওয়াসার এমডি জনাব তাকসিম এ খান মাঝে মাঝেই আলোচনায় আসেন এবং বলা বাহুল্য, সেটা নেতিবাচক কারণে। চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডির দিকে তাকালে এজন্য অবশ্য নিজেকে কিছুটা ‘দুর্ভাগা’ ভাবতেই পারেন। যেহেতু আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু থাকে ঢাকা, তাই তাকে নিয়েই আলাপ-সমালোচনা হয় অনেক বেশি। অথচ দেশের দ্বিতীয় প্রধান শহর চট্টগ্রামের ওয়াসার এমডিও আসতে পারতেন আলোচনায়।

ঢাকা ওয়াসার এমডিকে নিয়ে যখনই আলোচনা হয় অনিবার্যভাবেই অতি দীর্ঘ সময় তার দায়িত্বে থাকা নিয়েও আলোচনা সামনে আসে। অথচ আমরা অনেকেই জানি না চাকরির মেয়াদের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডিরও একই অবস্থা। চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ ২০০৯ সালের জুলাই মাসে এক বছরের জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর প্রথম দফায় তিন মাসের জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পেলেও ছয় দফায় পুনর্নিয়োগ পেয়ে টানা ১০ বছরের বেশি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি।  

ঢাকা ওয়াসার এমডির বেতন বৃদ্ধি নিয়ে তুমুল শোরগোল হলেও চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি এই বছরের শুরুতে বেতন বৃদ্ধি নিয়ে যা করেছিলেন, সেটা কিছু পত্রিকায় খবর হলেও নাগরিকদের মধ্যে খুব বেশি কথাবার্তা হয়নি।

এই বছরের শুরুতেই নিজের মূল বেতন বর্তমানের আড়াইগুণ করতে বোর্ডের কাছে আবেদন করেছিলেন চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যোগ করলে আর প্রস্তাব মানলে তার মোট পারিশ্রমিক হতে পারতো ১০ লাখ টাকা। বর্তমানে তিনি বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা, আপ্যায়ন, বিশেষ ভাতাসহ মোট পান ৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা। তিনি যে অর্থবছরের সপ্তম মাসে এই বেতন বৃদ্ধির আবেদন করেছিলেন তার প্রথম ৫ মাসে ওয়াসা তার রাজস্ব উপার্জনের লক্ষ্যের মাত্র ২৭ শতাংশ অর্জন করছিল। এমন ভয়ংকর পারফরম্যান্সের পরও তিনি বেতন-ভাতা একদফায় তিনগুণ করে ফেলতে চেয়েছিলেন।

মিডিয়ায় সংবাদ চলে আসার পর বোর্ডের তীব্র সমালোচনার মুখে চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি তার বেতন বৃদ্ধির আবেদন প্রত্যাহার করেন। কারণ হিসাবে দেখান করোনাকালের আর্থিক সংকটকে। এ ব্যাপারে মিডিয়ার প্রশ্নের মুখে খাবি খেয়েছেন তিনি, কিন্তু আমরা তো এটুকু জানলাম, দেশের একটি প্রতিষ্ঠানের একজন সর্বোচ্চ নির্বাহী দেশ যে করোনার কারণে চরম আর্থিক সংকটে আছে, সেটা জানতেন না, জানলেন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ার পর। সব খবর নিয়েই আমাদের যেমন এখন ট্রল করার এক ধরনের অভ্যাস আছে, সেটাও দেখা যায়নি চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডির ক্ষেত্রে। তিনি ‘ভাগ্যবান’।

ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান নানা নেতিবাচক কারণে মিডিয়ার সংবাদ হন খুব নিয়মিত। ওয়াসার সর্বোচ্চ নির্বাহী থাকার ক্ষেত্রে তার অপরিহার্যতা আলোচনায় এসেছে। আলোচনায় এসেছে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং সেটা দুদকের খোঁজ-খবর নেওয়ায়। ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি ফোটানো ছাড়াই খাওয়া যায় বলে তার উক্তি জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল। পরে জুরাইন থেকে ওয়াসার পানি দিয়ে জনাব তাকসিমকে শরবত খাওয়ানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন জনাব মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একদল এলাকাবাসী।

কয়েক মাস আগের দুটো ঘটনা কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। জনাব তাকসিম তার বেতন বৃদ্ধির জন্য ওয়াসাকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়েছিলেন মানুষের সামনে। এরপর তার বেতন ভাতা বৃদ্ধি করে সোয়া ৬ লাখ টাকা করা হয়। মজার ব্যাপার, এর কিছু দিন পর তিনি ওয়াসার পানির মূল্যবৃদ্ধির জন্য যখন প্রস্তাব করলেন তখন কারণ হিসেবে দেখালেন ওয়াসা লোকসানে আছে। নিজের স্বার্থের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে এমন দুটি অবিশ্বাস্য পরস্পরবিরোধী কথার নজির এই দেশে খুব বেশি নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই সেটা নিয়ে যেমন কলাম লেখা হয়েছে, টকশো হয়েছে, তেমনি নাগরিকরা সামাজিক মাধ্যমে ট্রল করেছেন।

সর্বসাম্প্রতিক যে ঘটনাটি আমাকে এই কলামটি লিখতে প্রণোদনা জুগিয়েছে, সেটা হচ্ছে জনাব তাকসিমের দীর্ঘ সময় ছুটিতে আমেরিকায় থাকার সময়ও দায়িত্ব হাতে রাখার ইচ্ছে প্রকাশ করা। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য তিনি প্রায় প্রতিবছরই একটি নির্দিষ্ট সময় আমেরিকায় থাকেন। গত বছরের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৪ জুলাই তিন মাস তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। এর আগে তিনি ২০১৯ সালের ১১ জুন থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন।

প্রতিবারই দেশের বাইরে যাওয়ার আগে একটি অফিস আদেশ জারি করেন তাকসিম এ খান। ওই অফিস আদেশের মাধ্যমে তিনি অনলাইনে অফিস করার বিষয়টি জানিয়ে যেতেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসেই নথিপত্রে স্বাক্ষরসহ সব কার্যক্রম পরিচালনা করেন। একজনকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষে রুটিন দায়িত্ব পালন করতে বলতেন।

গত বছর তাকসিম এ খান ছুটিতে থেকেও নথিপত্রে স্বাক্ষর করেন। অন্যদিকে তাঁর ছুটির সময়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এমডির দায়িত্ব পাওয়া ওয়াসার পরিচালক (উন্নয়ন) আবুল কাশেমও নথিপত্রে স্বাক্ষর করেন। একসঙ্গে দুজন এমডির দায়িত্ব পালন নিয়ে সমালোচনা হয়।

এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় এবার যে বিদেশে যাওয়ার সময় তিনি দায়িত্বে থাকতে চাচ্ছেন, এটা বোর্ডের সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে করছেন সেটা। গত ৭ জুলাইয়ের বোর্ডসভায় ওয়াসার এমডি যুক্তরাষ্ট্রে বসে অফিস করার অনুমতি চেয়েছিলেন। বোর্ড সেই অনুমতি না দিয়ে তাকে ছয় সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর করে। কিন্তু তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে লেখা অনুমতির আবেদনে উল্লেখ করেন– ‘আমার বহিঃবাংলাদেশ অবস্থানকালীন সময়ে আমি অন ডিউটি থাকবো।’

অথচ এমন পদক্ষেপ তিনি নিতে পারেন না কোনোভাবেই। ‘পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬’-এর ২৮(১) ধারা অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পারিশ্রমিক, সুযোগ-সুবিধা এবং চাকরির অন্যান্য শর্তাবলি পরিচালনা বোর্ড নির্ধারণ করে থাকে। এমনকি এমডিকে অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া আছে বোর্ডকে।

বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্টটি থেকে আরও জানা যায়, অতীতে অন্যান্য ক্ষেত্রেও জনাব তাকসিমের বোর্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার নজির আছে। ৭ জুলাইয়ের বোর্ডসভায় তিনি পানির দাম ২০ ভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাব আমলে নিয়ে বোর্ড চলতি মাসে পাঁচ ভাগ ও আগামী জানুয়ারি মাসে ১৫ ভাগ দাম বাড়ানোর বিষয়ে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। বলা হয়েছিল, পরবর্তীকালে এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু তাকসিম এ খান বোর্ডকে না জানিয়ে গত ৪ আগস্ট পানির দাম ২৫ ভাগ বাড়ানোর জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান। এ ঘটনায় ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যানসহ সদস্যরা ক্ষুব্ধ হন।

ঢাকা ওয়াসার পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্তের বাইরে একজন এমডি কীভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছেন সেটা আমাদের সামনে পর্যন্ত এসেছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার ক্ষেত্রে আমাদের মিডিয়ার মনোযোগ কম বলে আমরা জানি না অনেক কিছুই। কিন্তু এই দেশে বসবাস  করে এই দেশের পরিস্থিতি বুঝে আমরা যৌক্তিকভাবেই অনুমান করতে পারি সেখানেও নিশ্চয়ই আছে এরকম নজির। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার যতদিন ক্ষমতায় আছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে উভয় এমডির ওয়াসার শীর্ষ পদে থাকা প্রমাণ করে পরিচালনা পর্ষদকে পাত্তা দেওয়ার আদৌ কোনও দায় নেই, তাদের নিশ্চিতভাবেই আছে অতি আমাদের চোখে অদৃশ্য ভীষণ শক্তিশালী কোনও খুঁটি।
 
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট