X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতি মেনে নেওয়াই কি আমাদের নিয়তি?

ডা. জাহেদ উর রহমান
০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:১৮আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:১৮

বাংলাদেশে সব আমলে ক্ষমতাসীনদের সবচেয়ে অপ্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হচ্ছে ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’। জার্মান ভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতি এবং সুশাসন নিয়ে কাজ করে। সংস্থাটির দুর্নীতির ধারণা সূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স) বাংলাদেশে এক রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে অনেক আগে থেকেই। এই সূচকের সবচাইতে বড় দিক হচ্ছে এই সূচকের মাধ্যমে আমরা সারা বিশ্বের সব দেশের মধ্যে একটা তুলনামূলক চিত্র দেখতে পাই। ফলে বাংলাদেশ তার আশপাশের এবং অন্যান্য তুলনীয় দেশগুলোর তুলনায় দুর্নীতির ক্ষেত্রে কেমন আছে, সেটা শুধু রাজনৈতিক দল কেন, সচেতন নাগরিকদের কাছেও খুবই কৌতূহল উদ্রেককারী।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন সর্বশেষ সরকারটির সময়ে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ পরপর পাঁচবার পৃথিবীতে অন্য সব দেশগুলোর তুলনায় সবার শেষে ছিল। এটাকে তৎকালীন বিরোধী দল ‘দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন’ বলে ব্যবহার করেছিল। অবশ্য সেই পাঁচবারের প্রথমবারের ফল বিএনপির সময়ে প্রকাশিত হলেও যে বছরের ভিত্তিতে সে ফলাফল হয়েছিল, সে বছরের প্রায় পুরোটা ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ এবং শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

বিএনপির সময় যখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করতো তখন বিএনপির লোকজন সেটা একেবারেই পছন্দ করতো না। বরং সমালোচনা করতো সংস্থাটির। না বললেও আমাদের বুঝে নিতে সমস্যা হয় না তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের কাছে এই সংস্থাটি ছিল ‘অসাধারণ স্বচ্ছ’ এবং সুন্দর একটি প্রতিষ্ঠান। 

প্রায় দেড় দশক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়, বলা বাহুল্য, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তাদের কাছে এখন আর ভালো কোনও প্রতিষ্ঠান নয়। যখনই কোনও মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে টিআইবি কোনও জরিপ বা গবেষণা করে দুর্নীতি এবং সুশাসনহীনতা নিয়ে কথা বলে তখনই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে ‘অস্বচ্ছ’, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ইত্যাদি শব্দ যুক্ত করে বক্তব্য দেন। সংসদে কী হয় না হয় কতটা সময় সংসদের মূল কাজ অর্থাৎ আইন প্রণয়নে ব্যয় হয়, সেসব নিয়ে টিআইবি ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ নামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বলাবাহুল্য এতেও বেরিয়ে যায় থলের বিড়াল। তাই সংসদেও তীব্র সমালোচনার শিকার হয় সংস্থাটি। 

ক্ষমতাসীনদের কাছে টিআইবিকে আসলে কেমন লাগে সেটার এক অসাধারণ প্রমাণ হতে পারে সংস্থাটি নিয়ে তথ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, সেটা। এই বছরের ১০ মে তিনি বলেন, ‘টিআইবি এখন কথায় কথায় বিবৃতি দেয়। সম্প্রতি রেলের টিকিট ও টিটিই নিয়ে মধ্যরাতে একটা ঘটনা ঘটেছিল। এটার কোনও খোঁজ খবর না নিয়েই সকাল বেলা টিআইবি বিবৃতি দিয়ে দিল। এখন রিজভী আহমেদ আর টিআইবির মধ্যে আমি কোনও পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি না। কোনও কিছু ঘটার আগেই যেমন রিজভী আহমেদ বিবৃতি লিখে রাখেন, তেমনি টিআইবিও কোনও কিছু হওয়ার আগেই বিবৃতি লিখে রাখে।’ 

টিআইবি নতুন করে খারাপ হয়নি, টিআইবি সব শাসকদের কাছে খারাপ ছিল শুরু থেকেই। তবে আগে যেমন বলেছি এই সংস্থাটির নানা রকম রিপোর্ট জনগণের জন্য অসাধারণ কার্যকরী হয়েছে। দেশের দুর্নীতি আর সুশাসনহীনতা সম্পর্কে মানুষ জানে, কিন্তু টিআইবির নানা সেক্টর নিয়ে গবেষণা মানুষকে এর পরিমাণ এবং ব্যাপ্তি নিয়ে ভালো ধারণা দেয়। 

ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে মেরে দেওয়া, অবকাঠামোসহ অন্যান্য প্রকল্প থেকে টাকা চুরি করা থেকে শুরু করে দেশের সব দুর্নীতির মাশুল শেষ পর্যন্ত দিতে হয় সাধারণ মানুষকেই। এসব সেক্টরে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। কিন্তু এসব দুর্নীতির তুলনায় অনেক কম অংকের (বছরে ১১/১২ হাজার কোটি টাকা) দুর্নীতি নিয়ে বরং দেশের মানুষের অনেক বড় মাথাব্যথা।

টিআইবি দুর্নীতির একটি খানা জরিপ করে। এখানে এক বছরে সেবা খাতে সারা দেশের কতগুলো খানা/পরিবার (হাউজহোল্ড), কী পরিমাণ এবং কেমন ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছে, সেই স্ট্যাডি করা হয়। যেহেতু এসব দুর্নীতির ক্ষেত্রে মানুষ সরাসরি হয়রানির শিকার হয় এবং ঘুষ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের পকেট থেকে টাকা দিতে হয়, তাই এই দুর্নীতি এবং ঘুষের প্রতি আমাদের ক্ষোভ বেশি। সত্যি বলতে দেশের অনেক মানুষ দুর্নীতি বলতে নিজে সরাসরি মুখোমুখি হয়েছে, এমন দুর্নীতিই বোঝে।

সম্প্রতি ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’ শীর্ষক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে টিআইবি যাতে ২০২০ এর ডিসেম্বর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের জরিপ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে মোট ১৭ ধরনের সেবা খাতের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে ঘুষ, জোরপূর্বক অর্থ আদায়, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি, সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন হয়রানি। জরিপের এক বছরে ঘুষ দেওয়া টাকার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশে মাথাপিছু ঘুষ দেওয়ার পরিমাণ ৬৭১ টাকা।

বর্তমান জরিপে দুর্নীতির ব্যাপ্তি বেড়েছে। এর আগে ২০১৭ সালে সেবা খাতের দুর্নীতি নিয়ে খানা জরিপ করেছিল টিআইবি। সার্বিকভাবে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্নীতির শিকার খানা বেড়েছে। ২০১৭ সালে যা ছিল সাড়ে ৬৬ শতাংশ, ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৭ সালে প্রতিটি খানাকে গড়ে ঘুষ দিতে হয়েছিল ৫ হাজার ৯৩০ টাকা। ২০২১ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকায়।

এই জরিপের আরও কিছু বিষয় লক্ষণীয়। দুর্নীতির শিকার হলেও অভিযোগ করেননি ৭৯ দশমিক ২২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ অভিযোগ করেননি ঝামেলা বা হয়রানির ভয়ে। সব খানেই দুর্নীতি– তাই অভিযোগ করার প্রয়োজনবোধ করেননি ৪৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সাড়ে ১৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। তবে ৭২ শতাংশ অভিযোগের ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিযোগের বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

টিআইবির এই গবেষণার একটা দিক আমার কাছে খুব উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে– দুর্নীতির শিকার হওয়া মানুষদের অর্ধেকই দুর্নীতির ব্যাপারে অভিযোগ করার প্রয়োজন মনে করেন না কারণ তারা মনে করেন দুর্নীতি সব জায়গায়ই ছড়িয়ে আছে। এদেশের সরকারি সেবা খাতের দুর্নীতি সবসময় চলেছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটির প্রশ্রয়ে। তাই মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বিচার প্রত্যাশা না-ই থাকতে পারে মানুষের। তাই দুর্নীতির অভিযোগ করে ফল না পাওয়া, এমনকি পাল্টা প্রতিহিংসার শিকার হবার ভয়ে কেউ বিচার চাইবার ঝামেলায় জড়াতে না চাইতেই পারে। এসব বিবেচনায় যারা দুর্নীতির বিচার চান না, তারাও অন্তত দুর্নীতিকে মেনে নেন না। 

জাতি হিসাবে আমাদের জন্য সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে দুর্নীতির শিকার সেই অর্ধেক সংখ্যক মানুষ যারা মনে করেন যেহেতু দুর্নীতি সব জায়গায় আছে তাই সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামানোর দরকার নেই। অর্থাৎ তারা ‘দুর্নীতি অনিবার্য’ এটা মনে করে মেনেই নিচ্ছেন।

একটা বীভৎসতার মধ্যে বসবাস করার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে মানুষ ধীরে ধীরে প্রাথমিকভাবে সেটার প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়তে শুরু করে। তার পরের ধাপে মানুষ সেটাকে মেনে নিতে শুরু করে। ফলে একটার পর একটা নতুন প্রজন্মের কাছে দুর্নীতি যে অন্যায় এই বোধ ক্রমাগত বিলীন হয়ে যেতে থাকে। 

ক্ষমতাকাঠামোতে যাই হোক না কেন, সমাজে যদি দুর্নীতির প্রতি ঘৃণা, নিদেনপক্ষে নেতিবাচক ধারণা থাকে, তাহলে দুর্নীতির প্রসার কিছুটা হলেও বাধাপ্রাপ্ত হয়। আর সমাজে যদি দুর্নীতিকে গ্রহণ করে নেওয়া হয়, তাহলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করার ইচ্ছে তো থাকেই না, বরং অনেকেই ব্যাকুল হয়ে থাকে যে কোনও মূল্যে দুর্নীতি করার ওইসব লাভজনক পদে গিয়ে দুর্নীতি করে সম্পদশালী হয়ে উঠতে। আমাদের চারপাশে আমরা এই মান ফলাফল দেখছি বেশ কয়েক বছর থেকেই।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ