বাংলাদেশকে নিয়ে কেন মমতার অনধিকার চর্চা?

সম্প্রতি বাংলাদেশকে নিয়ে বেফাঁস ও ‘আল-টপ্পা’ মন্তব্য করে বেশ সমালোচিত হয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক নিগূঢ় ও ঐতিহাসিকভাবে সুসংহত। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখনিঃসৃত বাণীতেও সেই উদাহরণ পাওয়া যায়। ভারত-বাংলাদেশের অটুট বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কোনও অপশক্তি চিড় ধরাতে পারবে না বলে তিনি সর্বদা বিশ্বাস করতেন।

সাম্প্রতিককালে দুই দেশেরই কতিপয় অপশক্তি তথা স্বাধীনতাবিরোধীরা এই সম্পর্কের রাশ টানতে বেশ উদগ্রীব হয়ে মাঠে নেমেছেন। তার প্রমাণ আমরা হাতেনাতে পাচ্ছি বেশ কিছু দিন ধরে এদেশে চলা একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দেশকে বেকায়দায় ফেলার দুরভিসন্ধিতে। বিভিন্ন এজেন্ডা ও ছলচাতুরি দিয়ে এই দুই দেশের ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্কে বিষবাষ্প ছড়াতে সুকৌশলে বিভিন্ন ছক হাতে নিচ্ছে তারা।

স্বাধীনতাবিরোধীরা দেশের সার্বভৌম ভূখণ্ডে বিশ্বাস করে না, তারা ব্যস্ত সবসময়ই দেশকে অশান্ত পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতে।

বাংলাদেশের চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনকে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অহেতুক অতি কথনকে সুস্পষ্ট সংবিধানবিরোধী বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশের কোটা আন্দোলন ছিল মূলত সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের একটি ন্যায্য আন্দোলন। আমরা দেখেছি একটি যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায্য আন্দোলনকে কীভাবে তৃতীয় গোষ্ঠী তথা স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের পরিকল্পনায় এনে মৃত্যুপুরী বাস্তবায়ন করতে। তদন্তে হয়তো আরও অনেক নিগূঢ় রহস্যের জাল বেরিয়ে আসবে। হোক সেটা রাষ্ট্রীয় কিংবা জনমনের তদন্ত। তবে এটা হলফ করেই বলা যায়, কোমলপ্রাণ নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে রক্তের হোলি দিয়ে যারা রাঙিয়েছেন তারা আর যাহোক একশব্দে দেশদ্রোহী। তাদের অচিরেই চিহ্নিত করতে হবে।

শুধু অপরাধীদের ধরলে হবে না বরং কারা এদের মদতদাতা ও উসকানিদাতা তাদেরও আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। রাষ্ট্রের সকল সুবিধা ভোগ করে বিদেশে বসে দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা কিংবা বিদেশিদের লেলিয়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার অপচেষ্টাকারীদেরও চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে কোনও যৌক্তিক আন্দোলনকে আর সুন্দরভাবে মীমাংসা করা যাবে না।

মোড়লগিরি, দালালি, অনাবশ্যক বা অনধিকার কর্তাগিরিকে বাংলা প্রবাদে সরফরাজি চাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ব্যঙ্গার্থে। মমতার বাংলাদেশকে নিয়ে মন্তব্য অনেকটা সরফরাজি চালের মতো। ভোট ব্যাংকের রাজনীতি ও তোষামোদি রাজনীতির জন্য ভারতে বিখ্যাত তিনি। এখন প্রশ্ন একটি দেশের অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশকে নিয়ে কি প্রকাশ্যে দেশবিরোধী মন্তব্য করতে পারেন? তিনি কি দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী? যেখানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের প্রতি আস্থাশীল ও শ্রদ্ধাশীল, সেখানে একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এ ধরনের দায়িত্বহীন মন্তব্য দিয়ে কি দু’দেশের সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরাতে কাজ করছেন? নাকি তৃতীয় কোনও শক্তির মদত দিচ্ছেন?

মমতার এই নিরর্থক মন্তব্যের পর সুর চড়িয়েছেন দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কড়া বার্তা দিয়ে যেমন আমরা স্পষ্ট করেছি, তেমনি ভারত সরকারও দিয়েছে যথাযথ বার্তা। তারপরও দুই দেশের সরকারের তীব্র প্রতিবাদের পরও মমতার অনড় অবস্থান রহস্যের সৃষ্টি করছে রাজনৈতিক মহলে। তিনি আসলে কাকে খুশি করতে এই অনড় অবস্থান নিয়েছেন?

ভারতীয় গণমাধ্যম বিভিন্ন সময় দাবি করে আসছে পশ্চিমবঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। উদাহরণ হিসাবে আমাদের এমপি আনারের কথাই বলা যায়। খুনিরা বুঝতে পেরেছিল বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় খুন করা খুব সহজ। পশ্চিমবঙ্গে স্বাগতম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে প্রতিনিয়ত উদ্ধার  হচ্ছে তাজা বোমা, গ্রেনেড, আগ্নেয়াস্ত্রসহ জঙ্গিদের আস্তানার তথ্য। একসময় ভারতের কাশ্মিরকে বলা হতো জঙ্গিদের অভয়ারণ্য। সে অপবাদ মুছে এখন পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠেছে জঙ্গিদের সেইফ ল্যান্ড। জিহাদি সব কাজ ও নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা ও আইএসএস-এর মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর সাংগঠনিক বড় পীঠস্থান হয়ে ওঠার তথ্য মিলছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাদের কাছে। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা যে নাজুক পরিস্থিতিতে আছে তা আমরা একবাক্যে বলতেই পারি।

বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা মালদা, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, উত্তর ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো এলাকা জঙ্গি নেটওয়ার্কের বিশেষ হাব হিসাবে প্রতীয়মান রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ভারতের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়ে কি কোটা আন্দোলনের আড়ালে তৃতীয় গোষ্ঠীকে উসকানি দিচ্ছেন? নাকি যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করেন না তাদের সাথে হাত মিলাতে চাচ্ছেন? পশ্চিমবঙ্গের মতো বাংলাদেশকেও নাকি জঙ্গি নেটওয়ার্কের হটলাইনের আওতায় আনতে চাচ্ছেন?

মমতার এ বার্তা আদতে কীসের বার্তা সেটি আসলে খালি চোখে বোধগম্য নয়। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এই বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া নেওয়া ও গভীর অনুসন্ধান করা। বাংলাদেশ একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে পরিচালিত স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এদেশে জঙ্গিবাদের ওপর সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। সেই জঙ্গিবাদকে আবার উসকানি দিচ্ছে ভিনদেশি অপশক্তি, তাদের বিরুদ্ধে অভিযানের এখন সময় এসেছে। জাতির সামনে তাদের পরিচয় উন্মোচন করিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। অপশক্তি তো মোটেই চাই না আমার এই সোনার বাংলা ভালো থাকুক। থাকুক নিরাপদ ও শান্তিতে। এসব হানাদার পাষণ্ডদের মুখোশ খুলে ফেলার এখনই উপযুক্ত সময়।

মমতারা এসব বলার সাহস কীভাবে পায়? উত্তর খুব সহজ। শুধু মনের গভীরে চিন্তা করলে হবে না, চোখ কান খোলা রাখলেই বোঝা যাবে আসল কাহিনি কী? তিনি যে ভোট ব্যাংকের রাজনীতি করেন শেখ শাহজাহান ও শওকত মোল্লারদের নিয়ে, তা সুসংহত করতে প্রয়োজন উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর মদত। সেটা যদি বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে আদর্শগত মিলে যায় তাহলে তো দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যায়। তাই তো তিনি এই গোষ্ঠীকে খুশি করতে বিভিন্ন কৌশলের আড়ালে অপরাধীদের পশ্চিমবঙ্গে আসার বার্তা দেন।

একটি অঙ্গরাজ্যের প্রধান কি দেশের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করার এখতিয়ার রাখেন? উত্তর আসবে হয়তো না। তবে এটা সত্যি, আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টতে যারা সরাসরি যুক্ত তাদের বেশ চাঙা করতে মমতার এই বক্তব্য টনিক হিসাবে কাজ করেছে। তারা বেশ খুশি ও উৎফুল্ল হয়েছে মমতার এই বক্তব্য শুনে। তারা ভাবছে আমরা দেশে দুষ্কর্ম করলেও বিদেশি শক্তি তো আমাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিবে। ভয় করে লাভ কি? আন্তর্জাতিক এরকম শক্তি তো আমাদের বিভিন্ন অপকর্মের ছাতা হিসেবে কাজ করবে। দেশে শুধু আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীল করে বেড়াবো। আর বিদেশি বহিঃশক্তি এসে সহজেই বৈতরণী পার করবে আমাদের।

এটি মূলত তিনি পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু ভোট টানতে নির্বাচনি মাঠে ফরমুলা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ভোটারদের কাছে টানতে মাঝে মাঝে উসকানিমূলক নানা তত্ত্বের পসরা বসান তিনি। বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলার আগে তার ভাবা উচিত এটা পশ্চিমবঙ্গ না, বাংলাদেশ। এখানে কুকথার প্রভাব অনেক বেশি। ভারতে রাজনৈতিক বাতাবরণে তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছেন মা মাটি ও মানুষ এই স্লোগানকে উপজীব্য করে। তার উচিত নিজের দেশ নিয়ে রাজনীতি করা, অন্য দেশের বিষয়ে নাক না গলানো। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বাংলাদেশ দৃঢ় ও বলিষ্ঠতার সাথে মোকাবিলা করবে। অন্য ভিনদেশি লোকের মন্তব্য এখানে বেমানান ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। তার উচিত এই মন্তব্যের জন্য জাতির উদ্দেশে অবিলম্বে ক্ষমা চাওয়া।

কলকাতার ধর্মতলায় গত ২১ জুলাইয়ের তৃণমূলের সভাতে বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও অশান্তি প্রসঙ্গে মমতা জানিয়েছিলেন–‘পড়শি দেশ থেকে কেউ পশ্চিমবঙ্গের দরজায় এলে তিনি ফেরাবেন না’। কাদের তিনি ফেরাবেন না তা তিনি স্পষ্ট করে যদিও বলেননি। তার দেশে তিনি কাকে ঢুকাবেন বা ঢুকাবেন না এটা তাদের একান্ত সিদ্ধান্ত, তবু এটা বলার অধিকার কি রাখেন তিনি? নাকি এটি বলার অধিকার রাখে পররাষ্ট্র দফতর? যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার সর্বোচ্চ ক্ষমতা রাখে সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর কথার গুরুত্ব কতটুকু? ভারতের সংবিধানের সপ্তম তফসিলের প্রথম তালিকার ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে বিদেশ সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় এবং অন্য কোনও দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত বিষয়ের এখতিয়ার একমাত্র ভারত সরকারের। তাহলে অবস্থানটা স্পষ্ট যে সাংবিধানিক এখতিয়ারের বাইরের কোনও বিষয় নিয়ে রাজ্য সরকারের বলার কিছু নেই।

প্রকৃত অর্থে মমতার এই ধরনের অনুশীলন একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমাদের আরও কৌশলী ও রাষ্ট্রীয় জনমতের মাধ্যমে সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে হবে। না হলে এ ধরনের অপশক্তি আমাদের আরও বেশি ঝাপটি মেরে ধরবে।

লেখক: গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক

vprashantcu@gmail.com