আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েই ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তির (২০১৫) অধীনে আমেরিকা আর থাকবে না। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ধরনের আদেশনামা জারি করেছেন। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে তিনি প্রথমবার এটি করেছিলেন। কিন্তু তখন প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও ট্রাম্প সফল হননি। কারণ প্যারিস চুক্তির অনুচ্ছেদ ২৮ অনুসারে, কোনও দেশ একবার এই চুক্তিতে সদস্য হিসেবে স্বাক্ষর করলে তিন বছরের আগে চুক্তিভঙ্গ করতে পারে না।
বিগত ২০১৬ সালে ওবামা আমলে আমেরিকা এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সদস্য দেশ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ২০২০ সালে ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে আমেরিকার সদস্যপদ বাতিল করে নেয়। কিন্তু জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আসলে ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি আমেরিকাকে পুনরায় এই চুক্তির আওতায় ফিরিয়ে আনেন। এখন ট্রাম্প আবার ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারিতে আমেরিকার সদস্য পদ প্রত্যাহার করলেন।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তির উদ্দেশ্য:
প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়া জোরদার করা। পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পবিপ্লব যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে না দেওয়া এবং সম্ভব হলে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করা। এই চুক্তি অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ এড়াতে, ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে বিকল্প (রিনিউয়েবল এনার্জি) শক্তি উৎপাদনের পরিকাঠামো গঠনে উন্নত দেশগুলো অনুন্নত দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য করা। অনুন্নত দেশগুলো সেই অর্থ ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় করা। প্রতিটি সদস্য দেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া কমাতে জরুরি ভিত্তিতে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা এবং সে সবের ফলাফল পাঁচ বছর পরপর বাধ্যতামূলকভাবে অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর সামনে তুলে ধরা।
জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী কে?
প্রাকৃতিক কারণেই জলবায়ুতে পরিবর্তন হয়। কিন্তু গত কয়েক দশকে যে হারে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, তার জন্য মানুষের কর্মকাণ্ডই মূলত দায়ী। দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজে মানুষ পেট্রোলিয়াম-জাত তেল, গ্যাস এবং কয়লা পুড়িয়ে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে ফেলেছে। ঊনবিংশ শতকে শিল্প বিপ্লবের সময়ের তুলনায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম থেকে প্রকাশিত গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট ২০২৫ তথ্যমতে, চরম আবহাওয়া সংক্রান্ত ঘটনা যেমন তাপপ্রবাহ, ভারী বৃষ্টিপাত, নজিরবিহীন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, দাবানল, খরা ইত্যাদি আগামী দিনে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। এই ঝুঁকি কমাতে বিশ্বের প্রতিটি দেশ এখনও যদি পদক্ষেপ না করে, তাহলে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে।
প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকার বের হওয়ার যুক্তি:
আমেরিকা কেন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে এলো? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো ভালোই জানেন। তার এই পদক্ষেপের কারণে ইতোমধ্যে ঘরে-বাইরে তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে দেখা গেছে। কিন্তু রাজনীতি আর অর্থনীতি ভিন্ন জগৎ!
২০১৬ এবং ২০২৪-র নির্বাচনি প্রচারে ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন যে আমেরিকার ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙা করতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারকে তার প্রশাসন পূর্ণ সমর্থন করবে এবং প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকা নিজেকে সরিয়ে নেবে। কারণ প্যারিস চুক্তিতে থাকতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে এবং অনুন্নত দেশগুলোকে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডে অনুদান দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে সাহায্য করতে হবে।
জীবাশ্ম জ্বালানি ও আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি:
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আমেরিকার ফসিল ফুয়েল ইন্ডাস্ট্রির যোগাযোগ অস্বীকার করা যায় না। আমেরিকার রাজনীতিতে এই ইন্ডাস্ট্রি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমনকি এই শিল্পের মালিকরা মনে করেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির পিছনে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কোনও ভূমিকা নেই! প্রসঙ্গত, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনে পৃথিবীতে প্রথম স্থানে আছে চীন (৩১.৯ শতাংশ), দ্বিতীয় স্থানে আমেরিকা (১৩ শতাংশ) আর তৃতীয় স্থানে ভারত (৮.১ শতাংশ)। ট্রাম্প মনে করেন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে চীন ও ভারতের ওপর জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমেরিকার মতো বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে না!
ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান দলের সদস্য। বারাক ওবামা এবং জো বাইডেন দুজনেই ডেমোক্র্যাট। সুতরাং প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে থাকা বা না-থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই শিবিরের মধ্যে রাজনৈতিক চাপান-উতোর সহজেই চোখে পড়ে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিকে মান্যতা দিয়ে ওবামা এবং বাইডেন প্রশাসন জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প জ্বালানির ব্যবহারকে জোরদার করতে চেয়েছিল। যার ফলে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি, ব্যাটারি-চালিত গাড়ি উৎপাদনে জোর দেওয়া হয়েছিল। পদক্ষেপ করা হয়েছিল বিকল্প শক্তি উৎপাদনের মধ্যে দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার। আমেরিকার অর্থনীতিকে কার্বনমুক্ত করার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি আমেরিকার ফসিল ফুয়েলনির্ভর অর্থনীতির ক্ষতি করবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে আমেরিকানদের বঞ্চিত করবে।
বৈশ্বিক রাজনীতি ও বিকল্প জ্বালানি:
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকার বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একটি প্রশ্ন উঠে এসেছে, চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকা সরে আসেনি তো? তবে এই পরিপ্রেক্ষিতে চীন, ভারত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। চীন এবং ভারতের ওপর চাপ আসবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার। পৃথিবীর সব দেশের সক্রিয় সহযোগিতা না পেলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নিরর্থক হবে। তবে খাস আমেরিকায় ব্যাটারি-চালিত গাড়ি এবং বিকল্প জ্বালানি শিল্পের উৎপাদন যেভাবে এগিয়ে চলেছে, সে ক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা আগামীতে ক্রমশ হ্রাস পাবে।
তাই অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকা যদি আবার প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যোগ দেয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলেও কিন্তু পেশায় ব্যবসায়ী। রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসার যোগাযোগ সম্পর্কে তিনি ভালোভাবে ওয়াকিবহাল। এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ তার হাতে আছে। প্যারিস চুক্তি থেকে সরে এসে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পালন করা হলেও কিন্তু প্যারিস চুক্তিকে মান্যতা দিয়ে তার পূর্বসূরিদের মতো বিকল্প জ্বালানি শিল্পের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার দরজাটা কিন্তু বাস্তবে খোলা রাখলেন তিনি।
লেখক: গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক