বিশ্বব্যাপী শুল্ক যুদ্ধের ঘোষণা করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নতুন নীতিতে বাংলাদেশ সহ এশিয়ার একাধিক দেশের ওপর উচ্চহারে আরোপ করা হয়েছে শুল্ক। এমন পরিস্থিতির মাঝেই থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন’ বা ‘বিমস্টেক’ সম্মেলন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে মুক্ত বাণিজ্যের লক্ষ্যে ভীষণভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এই সাত দেশের সম্মেলন।
আঞ্চলিক বাণিজ্যে জোর দিতে এবারের ‘বিমস্টেক’ সম্মেলন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির লক্ষ্যে বড়সড় পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যের লক্ষ্যে পৌঁছতে সব রকম প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ফেলতে উদ্যত হয়েছে ‘বিমস্টেক’ সদস্যভুক্ত দেশগুলো। যার ফলশ্রুতিতে ২০২৬ সালে এই বিষয়ে চূড়ান্ত চুক্তি হতে পারে। আশার বিষয় হলো ইতিমধ্যেই সমুদ্রে পণ্য পরিবহণ নিয়ে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে এই সম্মেলনে। এই সদস্য ভুক্ত দেশগুলো নিজেদের বাজারে একে-অপরের পণ্য প্রবেশের সুযোগ করে দিলে সবাই উপকৃত হবে। বলাই বাহুল্য এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিপুল বাজার বাকিদের জন্য অনেক বেশি লাভদায়ক হতে পারে।
উল্লেখ্য, বিমস্টেক হলো বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এবং সংলগ্ন অঞ্চলে অবস্থিত সাতটি সদস্য রাষ্ট্রের একটি জোট। এটি দক্ষিণ এশিয়াকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে যুক্ত করছে। যেখানে দক্ষিণ এশিয়া থেকে রয়েছে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা। এবং পূর্ব এশিয়ায় রয়েছে মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ড। তথ্য বলছে, এই সংগঠন বিশ্বের ১.৭ বিলিয়ন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। এবং এর মোট জিডিপি ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৯৭ সালের ৬ জুন চারটি দেশ (বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড) নিয়ে তৈরি করা হয় বিমস্টেক। পরে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে এখানে যুক্ত হয় মিয়ানমার এবং ২০০৪ সালে যুক্ত হয় নেপাল এবং ভুটান।
মোদি- ড. ইউনূসের সাক্ষাৎ:
দেখা হলো, কথাও হলো। তবে প্রায় আট মাস ধরে চলতে থাকা শৈত্যে প্রথামাফিক সৌজন্যতা ছাড়া উষ্ণতার কণামাত্র আভাস পাওয়া গেলো কি? উত্তর হয়তো সহসাই হাতে আসবে।
‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিকাল এন্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন’ বা ‘বিমস্টেক’ সম্মেলনের ফাঁকে মোদি-ইউনূসের সাক্ষাতের পর ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক যে তিমিরে ছিল সেখানে থেকে ইউটার্ন দিয়েছে। বরফ কিছুটা হলেও গলেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। দু’পাশ থেকেই ঠাণ্ডা বিরোধী বক্তব্য আমরা দেখতে পেয়েছি।
ড. ইউনূস কূটনীতি:
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে বৈঠকের চেষ্টা যে অব্যাহত ছিল তা কিছুটা আভাস আমরা বেশ কয়েকবারই পেয়েছি। তীব্র ভারত বিরোধী বক্তব্য আমাদের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ দিলেও ড. ইউনূস জানেন প্রতিবেশীর সঙ্গে ন্যায্য সম্পর্ক তৈরি করতে হলে অবশ্যই প্রয়োজন আলোচনার টেবিলটিতে বসা। কিন্তু সে টেবিলে ভারত বসতে ছিল নারাজ। ব্যাংককের বিমস্টেক সম্মেলনে হয়তো তীব্র চেষ্টাই ছিল মোদির সঙ্গে ড. ইউনূসের সাক্ষাতের চেষ্টা। ঠিক ঠিক শেষ মুহূর্তে ভারত রাজি হলো আলোচনার টেবিলে বসার। এই একটি সাক্ষাৎ বড় কিছু বয়ে কি আনবে? না আনলেও দুই দেশের সম্পর্কে যে বরফ জমে ছিল তা কিছুটা হলেও গলবে, সেটি নিশ্চিত।
এটিকে কি আমরা ড. ইউনূসের কূটনৈতিক সফলতা দাবি করতে পারি? হয়তো পারা যায়। এর ব্যাপ্তি যে খুব বৃহৎ হবে তা আমরা আশা না করলেও বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে বন্ধুত্বের হাতই প্রসারিত করেছে। তবুও বলতে হয় ড. ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাতের পুরনো একটি ছবি উপহার হিসেবে দিয়েছেন, সেখানেও চমৎকার কূটনৈতিক মেধা দেখিয়েছেন ড. ইউনূস। ২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ১০২তম ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে প্রফেসর ইউনূসের হাতে স্বর্ণপদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তারই একটি আলোকচিত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের বার্তায় কোনও অস্বস্তি রাখতে চাননি ড. ইউনূস। এটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।
তবুও আমাদের নজর দিতে হবে- ঠিক কী কারণে দুই দেশের সুসম্পর্কের মাঝে তৈরি করেছে পাহাড় প্রমাণ দেওয়াল।
ভারতের আশ্রয়ে হাসিনা:
বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মুখে ভারত চলে যান শেখ হাসিনা। মোদি সরকার তখন সেদেশের সকল বিরোধী দলের সঙ্গে সর্বদল বৈঠকের পর সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্ত নেয় তাকে আশ্রয় দিবে। মূলত তখন থেকেই ভারতের সাথে আমাদের টানাপোড়েন শুরু। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা-সহ বহু মামলা দায়ের হয়েছে। যার সুনিশ্চিত প্রমাণও পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বে আসার পর বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিকে হাতিয়ার করে বারবার শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছে।
তবে ভারত এ বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। ভারত চুপ কেন? এখন প্রশ্ন হলো ভারত কি আদৌও শেখ হাসিনাকে ফেরত দিবে? উত্তর হয়তো এক লাইনে দেওয়া সম্ভব নয়।
তবে আমরা সহজেই কিছুটা অনুমান করতে পারি ভারত কী করবে? বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মনে করে ভারতে আশ্রিত থাকা শেখ হাসিনা এখন দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতির পথে অন্যতম বাধা। বিশেষ করে ভারতে বসে তার আক্রমণাত্মক বক্তব্য। শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত না পাঠানোর যুক্তি হতে পারে:
১. শেখ হাসিনা ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু। যদি তাকে ফেরত দেয় তাহলে ভারতকে ভবিষ্যতে আর কেউ সহযোগিতা ও বিশ্বাস করবে না।
২. ভারতের আধিপত্য বিস্তারে শেখ হাসিনা যে ভূমিকা রেখেছে তাই ভারত শেখ হাসিনার মতো এই রকম সাথী হারাতে কখনও চাইবে না।
পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতা:
বাংলাদেশ ভারতের সাথে পৃথিবীর দীর্ঘ পঞ্চম স্থল সীমানা শেয়ার করে আসছে। বাংলাদেশের তিন দিকে ভারতে। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের কাছে ভারত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কিছু লোক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিরূপ আচরণ ও পাক ঘনিষ্ঠতা মোটেই ভালো চোখে দেখছে না ভারত। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যের আহবান দেখানোকে নয়া দিল্লি তাদের নিরাপত্তা হুমকি মনে করছে।
বাংলাদেশে চৈনিক চাল:
শেখ হাসিনা আমলে বহুবার বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করেছে চীন। তবে ভারত বন্ধু শেখ হাসিনা কোনোবারই চীনকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়নি। বর্তমান সময়ে ভারতের প্রধান ‘শত্রু’ এই চীন। সীমান্তে আগ্রাসন ও বঙ্গোপসাগরে চৈনিক চাল ব্যর্থ করতে ভারত যেখানে সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে সেখানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা মোটেই ভালো চোখে দেখছে না ভারত।
বাংলাদেশের মোংলায় আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা ইতিমধ্যেই ভেবে ফেলেছে চীন। চীনা বিনিয়োগ আনতে জিনপিংয়ের সাথে গভীর আলাপ হয়েছে বর্তমান সরকারের। যা ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুতের পথে অন্যতম কাঁটা হয়ে উঠেছে।
ভারতের উত্তর-পূর্বের ৭ রাজ্য ফেক্টর:
দিন কয়েক আগে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও উষ্ণ হয় ড. ইউনূসের একটি ভাইরাল মন্তব্যকে ঘিরে। চীন সফর থেকে ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওতে ড. ইউনূসকে বলতে শোনা যায়, “ভারতের পূর্ব প্রান্তের সাতটি রাজ্য, যাদের সেভেন সিস্টার্স বলা হয়। ওই বিরাট অঞ্চল কিন্তু পাহাড় আর স্থলভাগে ঘেরা। সমুদ্রপথে যোগাযোগ করার উপায়ই নেই তাদের। বাংলাদেশই হলো সমুদ্রপথের রাজা। তাই ওই এলাকায় চীনা অর্থনীতির বিস্তার ঘটতেই পারে।” যদিও এটাকে ভুল ভাবে প্রচার করে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম। বাংলাদেশের তরফ থেকে বলা হয়েছে এই মন্তব্য শুধু বাণিজ্যিক সংযোগ প্রকাশ করার জন্য বলা হয়েছে। এটার কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই।
উগ্র মৌলবাদ ও হিন্দু নির্যাতন:
শেখ হাসিনার বিদায়ের পরপরই বাংলাদেশ জুড়ে বিশৃঙ্খল ছবি দেখেছে গোটা বিশ্ব। কিছু উগ্র নিষিদ্ধ গোষ্ঠী দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ‘খেলাফতের’ ডাক দিয়েছে। বাংলাদেশে এই নিয়ে মিছিল ও করেছে তারা। যা বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তিতে আঘাত এনেছে। এই সংগঠনগুলোর অবৈধ কর্মকাণ্ড দমন করতে সরকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে যদিও কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে তাদের। তার উপরে অভিযোগ আছে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের পাশাপাশি বাড়ি-ঘর পোড়ানো ও খুন হওয়ার ঘটনা। এসব বিষয় নিয়ে বারবার অভিযোগ করেছে ভারত। যদি বাংলাদেশ এর শক্ত জবাব দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে চীর বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নেই যা আছে তা হলো চীর স্বার্থ। ভারত-বাংলাদেশের সংকট কেন সৃষ্টি হয়েছে এটা নিয়ে লুকানোর কিছু নেই। এটা ঠিক বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. ইউনূস যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন সম্পর্ক উন্নয়নে তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তিনি ভালো করে জানেন প্রতিবেশী দেশের সাথে খারাপ সম্পর্ক রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি এটাও জানেন কাকে কীভাবে তুষ্ট করতে হয়। তাইতো মোদির হাতে তার নিজের ছবি উপহার দিয়ে মূলত তিনি তার জাত চিনালেন। পরিচয় দিলেন কূটনীতিক শিষ্টাচারের। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ আরও বেগবান, গতিশীল ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিকশিত হবে এটাই এখন প্রত্যাশা।
লেখক: গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক