ক্রিকেট-বাণিজ্য, ক্রিকেট-আবেগ


ক্রিকেআমীন আল রশীদটের উন্মাদনা কখনও-সখনও এতটাই জাতীয়তাবাদ উস্কে দেয় বা দিয়েছে যে, তাতে করে মনে হয় এটি যতটা না খেলা, তারও চেয়ে বেশি বোধ হয় রাজনীতি, কূটনীতি। যদিও চূড়ান্ত বিচারে ক্রিকেট একটি খেলা এবং বৃহৎ বাণিজ্য। যারা খেলেন, তারা বিনিময়ে পয়সা পান। দেশ-বিদেশ ঘোরেন। যারা খেলার আয়োজন করেন, তারাও পয়সা পান। আবার এই খেলার ফলাফল নিয়ে যারা কোটি ডলারের জুয়া ধরেন, তাদের কাছেও এটি একটি বাণিজ্য।
যারা জার্সিসহ খেলার সরঞ্জাম তৈরি করেন, যারা খেলার সময় বিজ্ঞাপন দেন—তাদের কাছে এটি আরও বড় বাণিজ্য। কিন্তু যারা খেলা দেখেন, সাধারণ দর্শক, তাদের কাছে এটি কোনও বাণিজ্য নয়। বরং টিকিট কাটতে গিয়ে পুলিশের পিটুনিও খেতে হয়। সোজা পথে টিকিট না পেলে বাঁকা পথ ধরতে হয়। উচ্চপদস্থ কারও কাছে ধর্ণা দিতে হয়। ২০০ টাকার টিকিট কখনও ৫ হাজার টাকায় কিনতে হয়। আবার খেলা দেখার জন্য পাবলিক পরিবহনের হুজ্জত পেরিয়ে, ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে মিরপুরে যেতে হয়। সেখান থেকে মধ্যরাতে কোনও বাহন না পেয়ে হয়তো চার কিলোমিটার হেঁটে বাসায় ফিরতে হয়।
এই দর্শকদের কাছে খেলা কোনও বাণিজ্য নয়। বরং আবেগের বিষয়।  এই আবেগ প্রায়শই রূপ নেয় জাতীয়তাবাদে, বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা হলে। অর্থাৎ একজনের কাছে যা ব্যবসা, আরেকজনের কাছে সেটিই আবার আবেগ। আরেকটু ঘুরিয়ে বললে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর এই আবেগ পুঁজি করেই ব্যবসা করে একটি ক্ষুদ্র অংশ।
ক্রিকেট কি আসলেই এখন আর কেবল খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে? ক্রিকেট ছাড়া আমাদের জাতীয় জীবনে আর কোন ইস্যুটি জাতি-ধর্ম-দল নির্বিশেষে একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসে? মহান স্বাধীনতার ঘোষণা, আগস্ট ট্রাজেডি, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যার মতো জাতীয় ইস্যুতেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো একমত নয়। কিন্তু ক্রিকেটই সম্ভবত একমাত্র ইস্যু, যেখানে ১৬ কোটি মানুষের (খুব ব্যতিক্রম ছাড়া) আবেগ অভিন্ন। প্রত্যাশা অভিন্ন। অর্থাৎ বাংলাদেশ জিতবে।
ফলে, মাঠে যখন মাশরাফিরা জিতে যান, তখন জিতে যায় পুরো দেশ। তখন মাশরাফিদের ওই কজনের আনন্দাশ্রু আবেগাপ্লুত করে ১৬ কোটি মানুষকে। সেইসঙ্গে দেশের বাইরে থাকা আরও কোটিখানেক প্রবাসী বাংলাদেশিকে। যারা এই একটিমাত্র ইস্যুতে কোনও রকমের মতভিন্নতা বা মতদ্বৈততার প্রকাশ ঘটান না। ফলে ক্রিকেট এখন আর কেবল হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্যই নয়; এটি এখন ১৬ কোটি মানুষের আবেগের বিষয়।

৩.      

ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের যখন খেলা হয়, তখনকার উন্মাদনা আর ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে খেলার উন্মাদনায় কেন আকাশ-পাতাল তফাত? ক্রিকেট যদি স্রেফ একটি খেলাই হবে, যদি এটি স্রেফ বাণিজ্যই হবে, তাহলে কেন ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে খেলার দিন বাংলাদেশের মানুষের চোখে ঘুম থাকে না? কেন বিকেলের খেলা দেখার জন্য দুপুরের মধ্যে মানুষ সব কাজ শেষ করে মুক্ত হতে চান? কেন খেলার আগে আগে আকাশে মেঘ জমলে ১৬ কোটি মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে যায়? কেন সাকিব আল হাসান পরপর দুই ওভার মার খেলে বা ফালতু শট খেলতে গিয়ে তামিম আউট হলে এই মানুষগুলো বর্ণনাতীত কষ্ট পান? এখানেই প্রশ্ন জাতীয়তাবাদের। এখানেই প্রশ্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের।

৪.

মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের অবস্থান স্বাভাবিক। যদিও অসংখ্য বাংলাদেশি ক্রিকেটে পাকিস্তানের সমর্থক।তাদের অনেকেই পাকিস্তানের সমর্থন করে সেটি মুসলিম প্রধান দেশ বলে। কেউ কেউ ভারতবিরোধিতার জন্যও পাকিস্তানের সমর্থন করে। যদিও সংখ্যাটি হয়তো ‍খুব বেশি নয়।

এক্ষেত্রে ওই সমর্থকদের কারও কারও যুক্তি, খেলা তো খেলাই। যে দেশের খেলা ভালো লাগে, তাদের সমর্থন করি। তাদের কাছে জাতীয়তাবাদ কোনও ইস্যু নয়।

প্রশ্ন হলো, ভারত পাকিস্তানের বেলায়ই কেন এই জাতীয়তাবাদ উস্কে ওঠে? আগেই বলেছি, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর যুক্তি ১৯৭১। কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে? তারা তো ১৯৭১ সালে আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিল। এই দেশটির প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ থাকার কথা নয়। কিন্তু এরপরও যখন ভারতের সঙ্গে আমাদের খেলা হয়, আমাদের জাতীয়তাবোধ ও জাতীয়তাবাদ এমন পর্যায়ে  পৌঁছে যায় যে, যেন সত্যি-সত্যি যুদ্ধ লেগে গেছে।

এর জন্য ভারতের দায়টাই বোধ হয় বেশি।আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অকৃত্রিম বন্ধুর পরিচয় দিলেও স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক বহুকাল ছিল তিক্ত। সীমান্তে এখনও প্রতিনিয়ত গরু চোরাকারবারি দাবি করে বিএসএফ যেভাবে বাংলাদেশিদের গুলি করে, আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত যেভাবে নাক গলায়, অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার ইস্যুতে ভারত আমাদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করে এবং অন্য সব ইস্যুতে ভারত যেভাবে বাংলাদেশিদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, তাতে বাংলাদেশর জনগণের একটি বড় অংশই ভেতরে ভেতরে ভারতবিদ্বেষী হয়ে উঠেছে।এটি একদিনে হয়নি। দিনের পর দিন, বছরের পর আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা, কূটনৈতিক সম্পর্কের দুর্বলতাও এর জন্য কম দায়ী নয়।

এক্ষেত্রে ক্রিকেটেরও ভূমিকা আছে। সবশেষ বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে এদেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে, এবং ওই খেলায় প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। ফলে এবার এশিয়া কাপের ফাইনালে ওই বিশ্বকাপের প্রতিশোধ নিতে উন্মুখ ছিল গোটা দেশের মানুষ। ফলে দেখা গেলা, ক্রিকেট আর কেবল ২২ গজের পিচে কিংবা ২২জন খেলোয়াড়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; এটি হয়ে উঠেছে তীব্র জাতীয়তাবাদের লড়াই।পরিণত হয়েছে নিজের দেশের মর্যাদা ও আবেগের বিষয়ে।

লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর   

Save