ভারতের মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনে ভারতে বিজেপির শক্তিমত্তা ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। নিরঙ্কুশ জয় পেতে থাকা বিজেপি দলের জন্য এই নির্বাচন এসিড টেস্টও বটে। ঘুরে ফিরে আসছে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদির প্রাসঙ্গিকতা। মোদি কি আসলে ধরে রাখতে পারবেন তার মসনদ? নাকি আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাবে তার ব্যক্তি কারিশমা। যদিও এই বছর জম্মু-কাশ্মিরের বিধানসভা নির্বাচনে কঠিন লড়াই করে বিজেপি হারলেও কার্যক্ষেত্রে ইতিহাস গড়ে হরিয়ানায় টানা তৃতীয়বার জয়ী হয়েছে মোদির দল। যা খানিকটা স্বস্তিতে রেখেছে কেন্দ্র বিজেপিকে।
মহারাষ্ট্রে সবসময় মহাখেলা হয়ে থাকে। ইতিহাস বলছে গত ত্রিশ বছরে মহারাষ্ট্রের কোনও একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এবারও যে অন্যরকম হবে, তাও কিন্তু মনে হয় না। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর জোট শরিকদের মুখ্যমন্ত্রিত্বসহ একাধিক বিষয় নিয়ে দরকষাকষি হতে পারে। এমন ঘটনা যে একেবারে ঘটবে না তাও কিন্তু আগাম আন্দাজ করা কঠিন। এই নির্বাচনের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো, ভোটে যদি এমভিএ জয়ী হয় তাহলে শিন্ডে এবং অজিত পাওয়ারের দল চিরতরে মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, বিজেপির নেতৃত্বে মহাযুতি জয়ী হলে, তাহলে উদ্ধবের দল রাজনীতিতে খুব দ্রুত গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।
মহারাষ্ট্রে এমভিএ জোটে আছে কংগ্রেস-শিবসেনা-শরদ পাওয়ার। উল্টো দিকে ক্ষমতাসীন বিজেপি, শিবসেনা-শিন্ডে এবং এনসিপি-অজিত পাওয়ারের মহাজোট বা মহাযুতি। অনেকেই মনে করেন, এবারের মহারাষ্ট্রের ভোট কোনও রকম আদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। যদি মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসের নেতৃত্বে মহাবিকাশ আঘাড়ি (এমভিএ) জোট ভোটে জিততে না পারে তাহলে সামনের বছর বিহারের ভোটেও তা প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস বা বিজেপির প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের চেয়ে জোটে জোটে সমানে সমানে লড়াই হবে।
বর্তমানে মহারাষ্ট্রে বিজেপির নেতৃত্বে মহাজোটের সরকার চলছে। গত ২০১৯ সালে ভোট ঘোষণা হওয়ার আগেই নাসিকের একটি জনসভায় নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিল ভোটে জিতলে মুখ্যমন্ত্রী হবেন দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। যদিও পাঁচ বছর আগে ২৮৮-এর মধ্যে ১২২টি আসন জিতে বিজেপির সেই আশা পূর্ণ হয়নি। তৈরি হয়েছিল কংগ্রেস, এনসিপির সমর্থনে উদ্ধব ঠাকরের মুখ্যমন্ত্রিত্বে এমভিএ সরকার। উদ্ধব সরকারের আড়াই বছরের মাথায় শিবসেনায় আড়াআড়ি ফাটল ধরিয়ে ৩৯ জন বিধায়ককে নিয়ে একনাথ শিন্ডে বেরিয়ে এসে বিজেপির সমর্থনে নতুন সরকার তৈরি করেন। পরে ভাঙন ধরানো হয় শরদ পাওয়ারের এনসিপিতেও। যদিও এতে নরেন্দ্র মোদির ঘোষণা-মতো দেবেন্দ্র ফড়নবিশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া আর হলো না। তাকে শিন্ডে সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েই থাকতে হয়েছে। এবার অবশ্য সাবধানী বিজেপি। তারা আগাম কোনও মুখ্যমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেনি। তার মানে এই নয় যে তারা সে দাবি ছেড়ে দিয়েছে বা দেবে। এখন ফলাফলই বলে দিবে তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে?
গত লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের নেতৃত্বে এমভিএ ৩১টি এবং বিজেপির নেতৃত্বে মহাযুতি জোট ১৭টি আসনে জয়ী হয়েছে। আসনের ব্যবধান বড় হলেও শতাংশের বিচারে দুই জোটের ভোটের ফারাক ছিল কিন্তু কম। এমভিএ ৪৩.৭১% এবং মহাজুটি ৪৩. ৫৫%। এর মধ্যে কংগ্রেসের ভোট ছিল ১৭% আর বিজেপির ২৬%। যদি লোকসভা ভোটে প্রাপ্ত এই ভোটকে বিধানসভা আসনের নিরিখে দেখা যায়, তাহলে মহারাষ্ট্রে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের নেতৃত্বে এমভিএ এগিয়ে ছিল ১৫৮টি বিধানসভা আসনে, বিজেপির জোট এগিয়ে ছিল ১২৫টি বিধানসভা আসনে। ২৮৮ আসনের মহারাষ্ট্র বিধানসভায় সরকার গড়তে হলে চাই ১৪৫টি আসন। সেদিক থেকে দেখলে বলা যায়, এমভিএ কিছুটা হলেও বিজেপি জোট থেকে এগিয়ে। ফলে, এমভিএকে রুখতে এবং প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা ঠেকাতে বেশ কিছু জনকল্যাণমূলক প্রকল্প খুব দ্রুত চালু করেছে শিন্ডে সরকার। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘মুখ্যমন্ত্রী লড়কি বহিন যোজনা। এর ফলে রাজ্যের প্রায় ২.৫ কোটি মহিলা মাসে ১৫০০ টাকা করে ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছে। বিজেপির আশা, যেহেতু প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে গড়ে প্রায় ৭০ হাজার মহিলা এই প্রকল্প থেকে উপকৃত হয়েছে, তাদের অর্ধেকও যদি বিজেপি জোট মহাযুতিকে ভোট দেয়, তাহলেই তাদের জয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে। যদিও রাজনীতিতে এত সরল পাটিগণিত সাধারণত কাজ করে না।
এখনও মহারাষ্ট্রে ভোটারদের চোখে উদ্ধব ঠাকরেই প্রথম পছন্দ। কিন্তু অনেকেই আন্দাজ করতে পারেনি, একনাথ শিন্ডের জনপ্রিয়তাও আগের থেকে বেড়েছে অনেকটাই। অতি সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, উদ্ধবের পরই ৮ শতাংশ পিছিয়ে একনাথ শিন্ডে, আর অনেক পিছিয়ে আছেন দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। শিন্ডে সরকার একটা সমস্যায় পড়েছে। এবং যে পক্ষই সরকারে আসুক, তাকেই এখন এই সমস্যায় পড়তে হবে। সেটা হলো, প্রতিনিয়ত যত ধরনের সামাজিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সংরক্ষণের দাবি উঠছে, ইতোমধ্যে সংরক্ষণের আওতায় থাকা জনগোষ্ঠীগুলোকে অসন্তুষ্ট না করে ততটা সংরক্ষণ দেওয়া অনেক সময়েই আর সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে অসন্তোষ বাড়ছে। এই ক্ষোভ বিরোধীদের পক্ষে যেতে পারে। মারাঠা সংরক্ষণ আন্দোলনের নেতা মনোজ জারাঙ্গে পাতিলের সংগঠনের প্রভাব রয়েছে মারাঠাওয়াড়া এবং পশ্চিম মহারাষ্ট্র অঞ্চলের প্রায় ১০৪টি আসনে। এটি ভালোভাবে ভোগাবে বিজেপির নেতৃত্বে শিন্ডে সরকারকে।
দুপক্ষই প্রধানত ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং নানা ধরনের আর্থিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে জয় পেতে চাইছে। বিজেপির আক্রমণাত্মক হিন্দুত্ব এবং কংগ্রেসের ‘সংবিধান বাঁচাও’-এর ডাক এই মুহূর্তে বেশ পিছনের সারিতে। মাঝে মধ্যে বিজেপির ‘কাটেঙ্গে তো বাটেঙ্গে’ জাতীয় স্লোগান শোনা যাচ্ছে, আবার একই সঙ্গে ভোটের আশায় মাদ্রাসা স্কুলের শিক্ষকদের ভাতা বাড়িয়েছে বিজেপির নেতৃত্বে একনাথ শিন্ডে সরকার।
হিন্দুত্বকে ব্যবহার করে যে ভোটে জেতা যায়, সেটা ভারতবাসীকে প্রথম দেখিয়েছিলেন উদ্ধব ঠাকরের বাবা বালাসাহেব ঠাকরে। সেদিক থেকে তিনিই বিজেপির পথপ্রদর্শক। সাংবাদিকতা ছেড়ে ১৯৬৬ সালে বালাসাহেব ঠাকরে শিবসেনা তৈরি করেছিলেন মারাঠাদের চাকরিতে অগ্রাধিকার, মারাঠি অস্মিতা জাগিয়ে তোলা ইত্যাদি ভাবনা থেকে। এখন এই শিবসেনা বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ। মারাঠা সংরক্ষণের দাবি এবং স্বীকৃত ওবিসি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে, নতুন করে কোনও গোষ্ঠীকে ওবিসি-সংরক্ষণ দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে বিরোধ অনেক দিন ধরেই রয়েছে মহারাষ্ট্রে। দুপক্ষকে একসঙ্গে খুশি করা কঠিন কাজ। এসব জটিল সমীকরণ সামলাতে হচ্ছে বিজেপির মহাযুতি সরকারকে।
ভারতের নির্বাচন জটিল সব সমীকরণে আবদ্ধ। সেটা যদি হয় মহারাষ্ট্র তাহলে টুইস্ট দুই গুণ বেড়ে যায়। ভারতের রাজ্যগুলোতে এখন কংগ্রেসের এক ধরনের জোয়ার চোখে পড়ছে। ভোটাররা বিজেপির চেয়ে রাহুলের তরুণ নেতৃত্বের প্রতি বেশ আকর্ষিত হচ্ছে। এখন প্রশ্ন উঠছে জাতীয় নির্বাচনে কোণঠাসা মোদি পুনরায় কি প্রত্যাবর্তন করতে পারবেন? নাকি জটিল সমীকরণে কংগ্রেস জোটের কাছে ধরাশায়ী হবে? তবে হরিয়ানায় পরাজয় এবং জম্মু-কাশ্মিরে দুর্বল ফলের পর মহারাষ্ট্র এখন কংগ্রেসের কাছে প্রায় অগ্নিপরীক্ষা। এত সহজে হয়তো কংগ্রেস জয় ছিনিয়ে আনতে পারবে না, তবে বেশ হাড্ডা হাড্ডি লড়াই হবে। যদি বিজেপি মহারাষ্ট্র পরাজিত হয় তাহলে সামনে বিহার, দিল্লির নির্বাচনে অনেকটা ব্যাকফুটে থাকবে। তাই বিজেপি চাইবে যেকোনও মূল্যে মহারাষ্ট্র যাতে হাতছাড়া না হয়। সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামতে কিন্তু এবার মহারাষ্ট্রের প্রচারণায় মোদির তেমন দৃশ্যমান উপস্থিতি চোখে পড়েনি। মূলত আরএসএসের অতি সক্রিয়তার ওপর নির্ভর করছে মহারাষ্ট্রের ফলাফলের রসায়ন। ভারতের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও তাকিয়ে আছে মহারাষ্ট্রের মহানাটকের দৃশ্য অবলোকন করতে।
লেখক: গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
vprashantcu@gmail.com