১ হাজার দিন পার হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। পৃথিবীর ইতিহাসে যোগ হয়েছিল আরও একটি নাটকীয় অধ্যায়। ইউক্রেনের সামাজিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক, এই তিনটি মূল স্তম্ভে সরাসরি আঘাত হেনেছিল রাশিয়া। বিশ্বজুড়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ধিক্কার, মিটিং, মিছিল, অর্থনৈতিক অবরোধ, রাশিয়ান পণ্যের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা— সব কিছুকে উপেক্ষা করেই রাশিয়া আজও যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যেতে অনড়। ইউক্রেনও কি যুদ্ধ চালাতে অনড় নয়? প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গেলো। অথচ এই যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকের মাসগুলোতে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রনায়ক, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদরা ভেবেছিলেন, রাশিয়ার সামরিক শক্তির কাছে ইউক্রেন দুমড়ে-মুচড়ে যাবে! কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলছে! পর্যাপ্ত সামরিক সহায়তা পেয়ে ইউক্রেন ১ হাজার দিন পরেও যথেষ্ট পরিণত। বরং রাশিয়া কোথাও কোথাও পিছু হটছে, রাশিয়া এখন শান্তিচুক্তি চাইছে— এমন নানা কথা হাওয়ায় ভাসছে। কিন্তু বৈপরীত্যটা এখানেই, রাশিয়া হাইপারসনিক দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে, রাতের অন্ধকারে ১৮৮টি ড্রোন-আক্রমণে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোতে আঘাত হেনেছে, ইউক্রেনও পাল্টা রাশিয়ার অভ্যন্তরে ওয়াশিংটনের দেওয়া এটিএসিএমএস মিসাইল ছুড়ছে।
এই সময়কালে দুই দেশেরই অসংখ্য নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। গৃহচ্যুত হয়েছে। যাদের কাছে এই যুদ্ধ খায় না মাথায় দেয় সেটা ভাবনার বিষয় ছিল না– তারাও প্রতিপক্ষ হয়েছে। ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়ান হানায় ৬০০ জন শিশু ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝরে পড়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী সংস্থার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৮০ লাখের ওপর মানুষ রুশ হানায় আতঙ্কিত হয়ে ইউক্রেন ছেড়ে অন্যত্র শরণার্থী হয়েছে। প্রায় ৭০ লাখ মানুষ খোদ ইউক্রেনেই তাদের বাসস্থান হারিয়েছে। ১ হাজার দিনের যুদ্ধে ২ হাজার ৫০০-এর বেশি যুদ্ধবন্দি রাশিয়ার জেলে নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছেন। প্রায় ২০ হাজার শিশুকে যুদ্ধবন্দি করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে সব যুদ্ধেই নারীকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও এর কোনও ব্যত্যয় হয়নি।
প্রশ্ন উঠেছে, এই যুদ্ধের শেষ কোথায়?
অতীতের গর্ভে জারিত হয় বর্তমানের বীজ! একটু ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো যাক। সতেরো-আঠারো শতকে ইউক্রেনে কসাক রাজত্বের উত্থান ঘটলেও সেই রাজ্য অচিরেই পোল্যান্ড ও রাশিয়ার মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। পরে ১৯১৭ সালে বলশেভিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জার শাসনের অবসান ঘটে। জন্ম হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের। রুশ বিপ্লবের পর ১৯১৮ সালে ইউক্রেনে একটি বলশেভিক সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সালে ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের চারটি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের অন্যতম ছিল। এর পর আসে ১৯৯১ সাল। ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ভেঙে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৯১ সালের ১ ডিসেম্বর গণভোটের মধ্যে দিয়ে ইউক্রেনীয় জনগণ স্বাধীন ইউক্রেন-এর জন্য সমর্থন জানায়।
মনে করা হয়, ইউক্রেনের এই ঘোষণা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ইউক্রেন জাতিসংঘের আওতায় সামরিক অংশীদারত্বে যোগদান করে। একই সঙ্গে ১৯৯৩ সালে ন্যাটো জোটেও যোগদান করে। এরপর ২০১৩ সালে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি মুলতবি করে রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এতে দেশে ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন।
ইউক্রেনের এই ডামাডোলে রাশিয়া ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ক্রিমিয়া দখলে নেয়। এরপর থেকে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি ইউক্রেনের পূর্বভাগ দোনবাসে যুদ্ধ শুরু করে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘তুষের আগুন যেমন প্রথমে ধিক-ধিক, শেষে হঠাৎ ধু-ধু করে জ্বলে ওঠে’, তেমনই রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে তুষের আগুন ধু-ধু করে জ্বলে উঠলো। ফল, আজকের এই যুদ্ধ।
দিন যতই এগোচ্ছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ-পরিস্থিতি ততই জটিল আকার ধারণ করছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ইউক্রেনকে সামনে রেখে পেছন থেকে আমেরিকাসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে আছে। উদ্দেশ্য, পুতিনের রাশিয়াকে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল করে দেওয়া। অবশ্য, রাশিয়ার প্রতি আমেরিকার এই মনোভাব আজকের নয়। রাশিয়া যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল, তখন থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক উন্নতির পরিপন্থি আমেরিকা। ইতিহাসের পাতায় তার বহু উদাহরণ রয়েছে। রাশিয়ার মোকাবিলা করতে, সামনে ইউক্রেনকে দাঁড় করিয়ে, পেছনে লড়ছে আমেরিকাসহ ন্যাটো গোষ্ঠী এবং ইউরোপিয়ান দেশগুলো। এ যেন মহাভারতের চিত্র! সামনে ভীষ্ম পিতামহ, মধ্যে শিখণ্ডী, পেছন থেকে তির ছুড়ছেন অর্জুন!
এই যুদ্ধের পেছনে যথারীতি একটা ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে। সম্প্রতি স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউরোপের দেশগুলোতে যুদ্ধে অস্ত্র আমদানি ২০১৪-১৮ এবং ২০১৯-২৩-এর মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়কালে আমেরিকার যুদ্ধে অস্ত্র রফতানি শতকরা ১৭ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ রাশিয়ার যুদ্ধে অস্ত্র রফতানি ৫৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
২০১৯ সালে রাশিয়া ৩১টি দেশে সামরিক অস্ত্র রফতানি করতো। অথচ ২০২৩ সালে মাত্র ১২টি দেশে অস্ত্র রফতানি করতে পেরেছে তারা।
বিশ্বজুড়ে যে যুদ্ধের অস্ত্রবাজার রয়েছে, সেখানে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ সামরিক অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মুনাফার মুখ দেখাচ্ছে। সুতরাং এই যুদ্ধ এখনই থেমে যাবে, এমন আশা করা আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র! আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডান রিটার সম্প্রতি ‘হাও ওয়্যার্স এন্ড’ নামে একটি বই লিখেছেন।
তার মতে, যুদ্ধ না থামার পেছনে একটি কারণ শত্রু দেশের সেনাধ্যক্ষের শান্তিচুক্তির প্রতি অনাস্থা, অবিশ্বাস। তিনি মনে করেন, বিপক্ষ দেশ শান্তিচুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারবে না, অদূর ভবিষ্যতে যথার্থ মান্যতা দেবে না! ক্ষমতার মেরুকরণের সঙ্গে সঙ্গে তাকে কূটনৈতিক কৌশলে লঙ্ঘন করার সুযোগ নেবে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪০ সালে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল নাৎসিদের অবিশ্বাস করে জার্মানির শান্তিচুক্তিতে আমল দেননি। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এক দশকের ওপর চলার পেছনে অন্যতম কারণ, সিরিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সিরিয়া সরকারের শান্তিচুক্তির প্রতি অনাস্থা। এই একই অবিশ্বাস রাশিয়া, আমেরিকা এবং ইউক্রেনের মধ্যেও রয়েছে। ফলত, এই অবিশ্বাসের বাতাবরণ দূর করতে না পারলে, এই যুদ্ধের আশু নিষ্পত্তি দেখা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে, আমেরিকার নির্বাচনে পালাবদল ঘটেছে। আগামী দিনে এটাই দেখার, এই যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি কী দাঁড়ায়। ট্রাম্প কি সত্যি সত্যি এ যুদ্ধ নিরসনে কঠোর পদক্ষেপ নিবেন? নাকি ছেলে ভুলানোর গল্প বলে আড়ালে নিজের বাণিজ্য শানিত করবেন? সময় হয়তো এর যথার্থ উত্তর দেবে।
লেখক: গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
vprashantcu@gmail.com