লৌহরিয়ায় হরিণ প্রজননকেন্দ্রের বেহাল দশা

৫০ বছরে হরিণ বেড়েছে মাত্র ৬৪টি

প্রশিক্ষিত লোকবল, নিরাপদ আশ্রয় ও পর্যাপ্ত খাবারের অভাবসহ নানা সমস্যায় ধুঁকছে টাঙ্গাইলের মধুপুরে লৌহরিয়া হরিণ প্রজননকেন্দ্র। অর্ধ শতাব্দী বয়সী এই প্রজনন কেন্দ্রটিতে হরিণ বেড়েছে মাত্র ৬৪টি। কর্মকর্তাদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে এ হরিণ প্রজননকেন্দ্রের সংস্কার ও উন্নয়নের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখানে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের কাছে হরিণ দর্শন যেন ‘ সোনার হরিণ’। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও হরিণের দেখা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরতে হয় তাদের।  

লৌহরিয়ায় হরিণ প্রজননকেন্দ্র

টাঙ্গাইল বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৬ সালে মধুপুর শাল বনের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে হরিণের প্রজনন বৃদ্ধির জন্য ৪০ একর জমির ওপর লৌহরিয়া হরিণ প্রজনন কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। এখানে প্রথমে ২ জোড়া হরিণ ছেড়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ ৫০ বছরে এই প্রজনন কেন্দ্রে হরিণের বংশ বৃদ্ধি হয়েছে খুবই কম। রোগ-শোক, মৃত্যু, শেয়ালের আক্রমণ এসব পার করে এখানে টিকে আছে এখন মাত্র ৬৮টি হরিণ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ২টি মায়া হরিণ ও ৬৬টি চিত্রা হরিণ।

দীর্ঘদিন ধরে এই প্রজনন কেন্দ্রের সংস্কার এবং উন্নয়নের জন্য কোনও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। ফলে অর্থবরাদ্দের অভাবে উন্নয়নের কোনও ছোঁয়া লাগেনি। এটি দেখাশোনার জন্য নির্দিষ্ট কোনও প্রশিক্ষিত লোকবল নেই। লৌহরিয়া বিটের কয়েক হাজার একর প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রক্ষা, নতুন বাগান সৃজনসহ অন্যান্য কাজের ফাঁকে এখানে কর্মরত বনবিভাগের চারজন কর্মকর্তা-কর্মচারী দেখভাল করেন।

সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, এছাড়া প্রজনন কেন্দ্রের চারপাশের দেয়াল জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে দেয়ালের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে এবং অনেক জায়গায় দেয়ালের ওপর দিয়ে শেয়াল লাফিয়ে সহজেই ভেতরে প্রবেশ করে সদ্য জন্মানো হরিণ সাবকদের ক্ষতি সাধন করে।

লৌহরিয়ায় হরিণ প্রজননকেন্দ্রের বেহাল দশা

বনবিভাগ সূত্র জানায়, সরকার একটি হরিণ লালন পালন নীতিমালা করেছে। সেটির বিধিমালা অনুমোদন হয়ে গেলে ব্যক্তি পর্যায়ে হরিণ পালনের সুযোগ তৈরি হবে। তখন এই প্রজনন কেন্দ্র থেকে বাণিজ্যিকভাবে হরিণ সরবরাহ করে আর্থিকভাবে সরকার লাভবান হতে পারবে। সেই সঙ্গে এখানে পর্যটকদের ভিড়ও বেশি হবে।

হরিণের খাবার হিসেবে বর্ষা মৌসুমে বনের ভেতর প্রাকৃতিক ঘাষ, লতা-পাতা যথেষ্ঠ পরিমাণে থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে তাদের খাবারের অভাব দেখা দেয়। হরিণ উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট কোনও বরাদ্দ না থাকায় বনবিভাগের অন্যও কোন বরাদ্দ থেকে ব্যবস্থা করে বাইরে থেকে খাবার সরবরাহ করা হয়। কুড়া, ভুষি, সবজি যতটুকু দেওয়া হয় তা চাহিদার  অর্ধেকেরও কম। ফলে খাদ্য স্বল্পতার কারণে হরিণগুলি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

প্রজনন কেন্দ্রের ভেতরে সেচের ব্যবস্থা করে ঘাষের চাষ করলে শুষ্ক মৌসুমেও হরিণের খাবার ও পানির চাহিদা মেটানো যেতে পারে বলে মত দেন অনেকেই।

লৌহরিয়া বিটের ফরেস্ট গার্ড মো. মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ৬৮ টি হরিণের জন্য প্রতিদিন ২০ কেজি কুড়া, ২ কেজি খইল এবং ২ কেজি লবণ দেওয়া হয়ে থাকে যা তাদের চাহিদার তুলনায় অর্ধেকেরও কম। প্রজননকেন্দ্রের ভেতর সেচের ব্যাবস্থা করে ঘাষের চাষ করতে পারলে হরিণদের খাবার ও পানির সমস্যা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব হবে।

তিনি আরও বলেন, এই বিটের বন রক্ষা করা এবং পাশাপাশি প্রজনন কেন্দ্রের দেখভাল করা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। এখানকার জন্য নির্দিষ্ট অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ দেওয়া দরকার যারা সার্বক্ষণিক এটির দেখভাল করতে পারবে। তবেই হরিণের সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি সম্ভব হবে।

দর্শনার্থীদের কাছে হরিণ দর্শন যেন ‘সোনার হরিণ’

বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার কিউরেটর নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আবদ্ধ জায়গায় একটি প্রাপ্তবয়স্ক হরিণের দৈনিক গড়ে ১ কেজি দানাদার খাবার প্রয়োজন হয়। যার মধ্যে ৭০ শতাংশ গমের ভুশি এবং ৩০ শতাংশ সয়াবিন দানা। সবজি (পটল/শসা/গাজর) ২ কেজি, শাক ২ কেজি, কাঁচা ঘাষ ৩ কেজি, ছোলা ২০০ গ্রাম এবং পানির প্রয়োজন হয় ৪ লিটার থেকে ৫ লিটার। একটি হরিণ বছরে দুইবার বাচ্চা প্রসব করে থাকে। প্রতিবার ১টি থেকে ২ টি বাচ্চা প্রসব করে থাকে।

তিনি আরও  বলেন, কেওড়া গাছের পাতা হরিণ খুব পছন্দ করে। এসব চাষ করতে পরলে হরিণদের খাবারের চাহিদা অনেক মেটানো সম্ভব।

টাঙ্গাইল বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা বলেন, লৌহরিয়া বিটের কয়েক হাজার একর জায়গার বন রক্ষা করে অতিরিক্ত কাজ হিসেবে এই প্রজনন কেন্দ্রের খেয়াল রাখা মাত্র ৪ জন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। পর্যটন মৌসুমে পর্যটকদের এই হরিণ দেখানোর জন্য সুব্যবস্থা থাকা দরকার। সার্বক্ষনিক তত্ত্বাবধানের জন্য এখানে প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ দেওয়া দরকার, যারা প্রতিটি হরিণের ওপর নজর রাখতে পারবে। কোনও হরিণ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিক সেটির চিকিৎসা দিতে পারবে।  

তিনি আরও  বলেন, এই প্রজনন কেন্দ্রের জায়গাটি সুরক্ষিত না হওয়ার কারণে বাচ্চাগুলিকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। এর চতুর্পাশের দেওয়াল সংস্কার অথবা নতুনভাবে তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে মাটির গভীর থেকে দেওয়ালের উচ্চতা বাড়াতে হবে। এই জন্য অর্থ বরাদ্দের বিশেষ প্রয়োজন।

আরও পড়ুন:

সুন্দরবনে র‌্যাবের অভিযান: ৮ বছরে নিহত ৮৮ বনদস্যু
যশোরে নিহত ৪ জনের মধ্যে ৩ জনের পরিচয় মিলেছে

সাতক্ষীরায় র‌্যাব পরিচয়ে ব্যবসায়ীকে অপহরণের অভিযোগ

/এআর/টিএন/

আপ - /এসএ/