জবানবন্দিতে সিরাজ উদ দৌলা আদালতকে বলেন, ২০০১ সালে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন তিনি। গত ১৯ বছর দায়িত্ব পালনকালে স্থানীয় প্রভাব বলয় তৈরি হয়েছে তার। সেই লোকদের নিয়ে মাদ্রাসার যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়ন করতেন তিনি। মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি কিছু ছাত্রের সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক তৈরি করেন। এদের মধ্যে ছিলেন মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, ছাত্রদলের সভাপতি নূর উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদের, জাবেদ, জুবায়ের, এমরান, রানা ও শরিফ। এদের বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা দিয়ে সহযোগিতা করতেন অধ্যক্ষ। পরীক্ষার ফি ও বেতন মওকুফ করে দেওয়া হতো তাদের। এমনকি পরীক্ষায় বিশেষ সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি ওদের পছন্দ অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীও ভর্তি করা হতো। এসব থেকে কমিশন পেতো তারা।
জবানবন্দিতে নুসরাতের ঘটনার প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে সিরাজ বলেছেন, ২৭ মার্চ সকালে পিয়ন নুরুল আমিনের মাধ্যমে নুসরাতকে মাদ্রাসায় তার কক্ষে ডেকে আনা হয়। খবর পেয়ে নুসরাতের সঙ্গে আরও তিন ছাত্রী কক্ষের সামনে আসে। সিরাজের কাছে তথ্য ছিল, নুসরাত অন্য ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য সম্পর্ক ছিন্নের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে তাকে। ডেকে আনার পর শুধু নুসরাতকে কক্ষে ঢুকতে দেওয়া হয়। অন্য তিন ছাত্রী কক্ষের বাইরে ছিলেন। ওই পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে সিরাজ বলেন, ‘কক্ষে কিছু কথা হওয়ার পর নুসরাত পড়ে যায়। এরপর আমি পেছন থেকে তার কোমরে দুই হাত দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি তাকে। সে বসে থাকে। তারপর নুরুল আমিনকে ডাকি। পরে নুসরাত তার বান্ধবীদের সঙ্গে চলে যায়।’
এই ঘটনা নুসরাতের পরিবার জানার পর কী প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় সেটা জানিয়ে জবানবন্দিতে সিরাজ জানান, ২৭ মার্চ দুপুরে নুসরাতের মা, ছোট ভাই, কমিশনার মাদ্রাসায় আসেন। এরপর সিরাজকে মারার চেষ্টা করেন নুসরাতের মা। একপর্যায়ে সিরাজও তাদের হুমকি দেন। সেখানে নূর উদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন। পরে শাহাদাত হোসেন শামীমও আসেন। অবস্থা বেগতিক দেখে সোনাগাজীর আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিনকে ফোন করেন সিরাজ। রুহুল আমিন থানা থেকে এসআই ইকবালকে পাঠান। ইকবাল নুসরাতকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরপর সিরাজকে থানায় নিয়ে যান। সেখানে মামলা রেকর্ড করেন। সেই মামলায় গ্রেফতার হন তিনি।
সিরাজ জবানবন্দিতে আরও জানান, ২৮ মার্চ তার অনুরোধে কাউন্সিলর মাকসুদ ও রুহুল আমিনের তত্ত্বাবধানে মানববন্ধন করা হয়। শামীম, নূর উদ্দিন, কাদেরসহ অন্যরা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে হাজির করেন। ওই দিন আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয় সিরাজকে। ২৯ মার্চ সিরাজের স্ত্রী ফেরদৌস আরা ও ছেলে আদনান প্রথম জেলখানায় দেখা করতে যান তার সঙ্গে। পরে সিরাজের স্ত্রী, শাশুড়ি, তিন বোন ও শ্যালক রাজু ও তার স্ত্রী তানিয়া তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কারাগারে যান। জেলখানায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটি ‘ভক্ত গ্রুপ’ও দেখা করে সিরাজের সঙ্গে। তাদের মধ্যে শামীম, নূর উদ্দিন, জাবেদ, রানা ও আব্দুল কাদেরও ছিলেন। জেলখানায় এই গ্রুপের সঙ্গে তার মামলা ও জামিন নিয়ে কথা হয়। আলাপ হয় নুসরাতের পরিবারকে আপস করতে বাধ্য করা ও মামলা প্রত্যাহারের জন্য তারা কী করছে তা নিয়ে। সিরাজের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও মানববন্ধন চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন তিনি। এ সময় শামীম ও নূর উদ্দিনসহ কারাগারে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া অন্যদের বকাবকি করেন সিরাজ। কিছু একটা চিন্তা করে দ্রুত তাকে জানাতে নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মাকসুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার কথাও জানান তিনি।
মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলায় আদালতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দির শেষে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা বলেন, ‘নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যার হুকুম দিয়ে ভুল করেছি। এভাবে হুকুম দেওয়া ঠিক হয়নি। আমি অনুতপ্ত। সত্য জবানবন্দি দিলাম।’
আরও পড়ুন: নুসরাত হত্যা মামলা: অভিযোগ গঠনের শুনানি ২০ জুন
সিরাজের হুকুমে নুসরাত হত্যায় সরাসরি অংশ নেয় ৫ জন