বৃহস্পতিবার শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) তিন কিশোর খুন হয়। এরা হলো পারভেজ হাসান রাব্বী (১৮), রাসেল ওরফে সুজন (১৮) ও নাঈম হোসেন (১৭)। ওইসময় আরও অন্তত ১৫ কিশোর গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক সার্কেল) গোলাম রব্বানী শেখ জানান, এই ঘটনায় শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহ-তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিকুর রহমান, শারীরিক প্রশিক্ষক শাহনূর রহমানসহ কেন্দ্রে কর্মরত ১০ জনকে শুক্রবার ভোরে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়। কেন্দ্রে তাদের রাখা ঝুঁকিপূর্ণ এবং মূল ঘটনার কারণ জানতে সমাজসেবা কর্মকর্তাদের পরামর্শে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা বর্তমানে যশোর পুলিশ লাইনসের ব্যারাকে রয়েছেন।
সমাজসেবা অধিদফতর যশোরের উপ-পরিচালক অসিত কুমার সাহা বলেন, ‘ঘটনাটি আমরা মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়কে অবহিত করেছি। তিনি জানিয়েছেন- এ ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। জাতীয় শোক দিবস ও সরকারি ছুটি থাকায় আগামী রবিবার তদন্ত কমিটি গঠন করা হতে পারে।’
যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বলেন, ‘সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের বলা হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি গঠনের পর তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।‘
এদিকে, তিন খুনের ঘটনায় স্বজনরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। একইসঙ্গে তারা শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন। শুক্রবার সকালে কেন্দ্রের সামনে স্বজনদের অবস্থান ও কান্নাকাটি করতে দেখা যায়।
নিহত কিশোর পারভেজের বাবা খুলনার মহেশ্বরপাশা এলাকার রোকা মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে প্রায়ই ফোনে বলতো এখানকার পরিবেশ ভালো না। কেন্দ্রে শিশু-কিশোরদের নির্যাতন করা হয়। গতকাল সকালেও সে ফোন করে তাকে বড় জেলখানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে। পারভেজ আরও বলে, আমাকে যদি না নিয়ে যাও, তাহলে আমার লাশ নিয়ে যেতে হবে।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রোকা মিয়া বলেন, ‘সত্যি সত্যিই আজ আমার সন্তানের লাশ নিয়ে যেতে হচ্ছে।’
তিনি আক্ষেপ করেন, ‘সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের বর্বরতা কখনোই কাম্য নয়। আমি এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।’
নিহত অপর কিশোর রাসেলের ভাই বগুড়ার শেরপুর এলাকার ফরহাদ আলী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নিজে ভাই হারানোর বেদনা বোঝেন। তিনি নিশ্চয়ই এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার করবেন।’
তিনি জানান, কেন্দ্রে থাকাকালে তার ভাই এখানে খাবার দেওয়ায় অনিয়মসহ বন্দিদের ওপরে নানাধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছিল। তার ভাইসহ অন্যদের অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে তিনি এই ঘটনার বিচার চান।
নিহত নাঈমের ভাই বগুড়ার শিবগঞ্জ এলাকার শামিম প্রামাণিক জানান, তার ভাই এই কেন্দ্রে ছয় মাস আগে আসে। মৃত্যুর সংবাদ তাদের পরিবারের কাউকে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। তিনি বলেন, ‘টিভিতে খবর দেখে ছুটে এসেছি। হাসপাতাল মর্গে আমার ভাইয়ের লাশ দেখছি।’
এদিকে, আজ শুক্রবার সকালে আরও আহত রুপককে (১৫) যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ নিয়ে আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছে মোট ১৫জন। অন্যরা হলো- জাবেদ (১৭), আরমান (১৬), হৃদয় (১৬), লিমন (১৬), শাকিব (১৬), ঈশান (১৫), পাভেল (১৬), শরিফুল (১৬), সাব্বির (১৬), হৃদয়-২(১৭) মাহিম (১৭), রাকিব (১৬), সাব্বির (১৬), নাঈম (১৩)।
এদিকে, এ ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী), সিপিবি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, বাসদ (মার্কসবাদী), বাসদ এর স্থানীয় নেতারা।
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদ বলেন, সম্প্রতি কেন্দ্রে বন্দি কিশোরদের দুই গ্রুপের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরই জেরে বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রডের আঘাতে ও মারপিটে মারাত্মক জখম হয় ১৪ কিশোর। প্রাথমিকভাবে উন্নয়ন কেন্দ্রেই তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় আশঙ্কাজনক আহতদের একে একে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে নাইম, পারভেজ ও রাসেলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
তবে আহত কিশোররা বলছে, গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ডের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও মারপিটের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং অন্য বন্দিরা বৃহস্পতিবার (১৩ আগস্ট) দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত তাদের হাত-পা-মুখ বেঁধে দফায় দফায় মারধর করেছে। অচেতন অবস্থায় তাদের ফেলে রাখা হয়। সে কারণে বিনা চিকিৎসায় তাদের তিনজন মারা যায়। এক কর্মকর্তা কিশোরদের ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখান বলেও অভিযোগ করেছে তারা।
আরও পড়ুন-
‘হাত-পা-মুখ বেঁধে পেটায়, ক্রসফায়ারের ভয় দেখায়’
যশোরে তিন কিশোর নিহতের ঘটনায় কেন্দ্রের কর্মকর্তা দায়ী হতে পারেন, ইঙ্গিত ডিআইজি’র