ভূমিহীনদের জমি ভূমিদস্যুদের দখলে!

ভূমিহীন পরিবারসরকারের দেওয়া খাস জমি বন্দোবস্তের তিন দশক পরও মালিকানা বুঝে পায়নি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার ১৮ ভূমিহীন পরিবার। তাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশয়ে এসব জমি ভূমিদস্যুরা ভোগদখল করছে। এমনকি সরকারের দেওয়া ভূমিহীনদের কবুলিয়তনামা দলিলও হাতিয়ে নিয়েছে তারা। ভূমিহীনদের অভিযোগ, বন্দোবস্তের জমির দখল পেতে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চল খ্যাত নাচোল উপজেলা শহর থেকে ছয় কিলোমিটার পূর্বের প্রত্যন্ত ঝিকড়া গ্রামের ১৮টি ভূমিহীন পরিবার ৩০ বছর আগে ভূমির জন্য আবেদন করে। ১৯৯০ সালে ওই গ্রামের ৯০ বিঘা খাস জমির মধ্যে প্রায় ৬০ বিঘা খাস জমির বন্দোবস্ত দেয় সরকার। কিন্তু স্থানীয় প্রভাশালীদের বাধা আর হুমকিতে এখনও জমি বুঝে পায়নি ভূমিহীনরা।

ভূমিহীনদের অভিযোগের স্থানীয় বিএনপির সংসদ সদস্য আমিনুল ইসলামের নিকটাত্মীয় ও যুবলীগ নেতা সৈকত জোয়ার্দ্দারের দিকে। তাদের আশ্রয়-প্রশয়ে এসব জমি জোর করে ভোগ দখল করছেন আব্দুর রহিম, আব্দুল আখের, চূড়কা মার্ডি, হিংগু মূরমু, স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার মেসবাউল হকসহ কয়েকজনের একটি চক্র। সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে এই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

ভূমিহীনরা জানান, ভূমিদস্যু এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই এই কারবার করে আসছে। বাধা দিতে গেলেই নানা ধরনের হয়রানি ও হুমকি আসে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, প্রভাবশালী এই ভূমিদস্যুরা সেই সরকারের রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এ কার্যক্রম চালিয়ে গেছে।

জমি থেকে ভূমিহীন পরিবারকে উঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছেতাদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, ভূমিহীনদের বন্দোবস্তকৃত প্রায় ৬০ বিঘা খাস জমির মধ্যে মাত্র ১০-১২ বিঘা জমি ভূমিহীনদের দখলে থাকলেও; বাকি সব জমি অবৈধভাবে দখলে নিয়ে নামে-বেনামে বিক্রি করে বাণিজ্য চালাচ্ছে চক্রটি। আর তাদের ফাঁদে পড়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন গ্রামের সাধারণ মানুষ।

সম্প্রতি এসব জমি উদ্ধারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ঝিকড়া গ্রামের রুলি বেগম, শফিকুল, জিল্লুর রহমান, নুরেফা বেগম, তাহির উদ্দিন, ফরিজ উদ্দিন, ময়ানসহ ১৮টি ভূমিহীন পরিবার লিখিত অভিযোগও করেছেন।

ভূমিহীন নুরেফা বেগম বলেন, ‘৩ বিঘা জমি সরকার বন্দোবস্ত দেয়। সেই জমির চেক কেটে দেওয়ার নাম করে আমার কবুলিয়তনামা দলিল আব্দুর রহিম, আখের, ওয়ার্ড মেম্বার মেসবাউল হক হাতিয়ে নেয়। এমনকি আমাকে জমিতে নামতে দেয়নি আজ পর্যন্ত। হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ওরাই দখল রেখেছে। আমি এই বৃদ্ধ বয়সে কোথায় যাবো?’

জমি থেকে ভূমিহীন পরিবারকে উঠিয়ে দেওয়া হয়ভূমিহীন খাতেনুর বেওয়া জানান, ১৯৯২ সালে সরকার আমাকে জমি দেয়। তারপর থেকেই ২০২০ সাল পর্যন্ত খাজনা-খারিজ এবং চেক কাটতেই আছি। কিন্তু জমি বুঝে পাচ্ছি না। সবকিছু করছি আমি আর ভোগদখল করছে ভূমিদস্যুরা।

ভূমিহীন শফিকুল ইসলাম জানান, ১৯৯০ সালে সরকার ৭৩ শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়েছিল। তারপর থেকে ৩০ শতক জমি আমি পাই, বাকি জমি আজ পর্যন্ত বুঝে পাইনি। প্রভাবশালীরা জোর করে দখল করে খাচ্ছে।

অপর ভূমিহীন রুলি বেগম বলেন, ‘সরকার যদি জমি বুঝিয়েই না দিবে, তাহলে আমাদের জমি দিলো কেন? আমাকে জমি বুঝিয়ে দিক, আর তা না হলে গত ৩০ বছর ধরে আমি এই জমির খাজনা-খারিজ ও চেক কাটছি, তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক?’

অপর অভিযোগকারী ভূমিহীন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ভূমিদস্যুরা স্থানীয় এমপির নিকটাত্মীয় এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগ নেতা সৈকত জোয়ার্দ্দারের প্রভাব খাটিয়ে ভূমিহীনদের জমি ভোগ দখল করছে।’

ভূমিহীন পরিবারের জমি দখল করে চাষ করছে অন্যরাসরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়- শুধু ভূমিহীনদের বন্দোবস্তকৃত জমিই নয়, ওই এলাকায় সরকারের আরও খাস জমি অবৈধভাবে নিজেদের দখলে নিয়ে বিক্রি করে ভূমি বাণিজ্য চালাচ্ছে চক্রটি।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, নামোঝিকড়ায় ২২ বিঘার একটি খাস জমিতে প্রায় ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বসিয়েছে ওই চক্রটি। শুধু তাই নয়, বর্তমানে তাদের কাছ থেকে প্রতিবছর ২ থেকে ৩ হাজার টাকা করে চাঁদা নেয় ভূমিদস্যুরা।

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হননি অভিযুক্ত আব্দুর রহিম। কথা বলতে চাইলে তিনি অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। অভিযুক্ত ওয়ার্ড মেম্বার মেসবাউল হকও অভিযোগ অস্বীকার করেন।

দায় অস্বীকার করে স্থানীয় সংসদ সদস্য আমিনুল ইসলাম জানান, এই বিষয়ে তার কিছুই জানা নেই। তবে আব্দুর রহিম, আব্দুল আখের তার আপন মামাতো ভাই বলে জানিয়েছেন তিনি।

যুবলীগ নেতা সৈকত জোয়ার্দ্দারও সব অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তিনি ভূমিহীনদের ওপর ভূমিদস্যুদের পক্ষ হয়ে প্রভাব বিস্তার করেন না। উল্টো দাবি করেন, তিনি ভূমিহীনদের পক্ষে এবং তাদের জমি উদ্ধারে কাজ করে যাচ্ছেন।

ভূমিহীনদের জমিতে আম বাগান গড়ে তোলার অভিযোগআর নাচোল উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেওয়া এসব জমি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ জমা পড়েছে, সেগুলোর দাগ নম্বর দেখেও আমরা নিশ্চিত হয়েছি এসব জমি খাস খতিয়ানভুক্ত। এখন আমরা আমাদের হোল্ডিং বই এবং সরেজমিনে বাস্তব অবস্থা পরিদর্শন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন জমা দেবো উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে। পরবর্তী পদক্ষেপ তিনি নেবেন।’

এদিকে ভূমিহীনদের অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাবিহা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে ভূমি অফিসকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’ সরেজমিনে ভূমিহীনদের বন্দোবস্তকৃত জমির দলিলের দাগ, মৌজা, খতিয়ান ও জমির পরিমাণ দেখে দখল বুঝিয়ে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।