বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে দেখা হলো না মরিয়মের

ছয় মাস আগে মোবাইল ফোনে বিয়ে করেছিলেন সৌদি আরবে আগুনে মারা যাওয়া রুবেল হোসাইন শেখ। বিয়ের পরে স্ত্রী মরিয়ম খাতুনের সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয়নি। তবে কথা ছিল প্রবাসী রুবেল দেশে ফিরলে ভিটায় উঠবে নতুন ঘর। ব্যাপক আয়োজন বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে। কিন্তু তার আগেই শেষ হয়ে গেছে সব স্বপ্ন। মোবাইল ফোনে বিয়ের সাত মাসের মাথায় সৌদি আরবে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মৃত্যু হয়েছে রুবেলের। সংসার শুরুর আগেই স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা মরিয়ম খাতুন। দুই পরিবারে চলছে মাতম। সেই শোক ছুঁয়েছে গ্রামের অন্য বাসিন্দাদেরও।

সৌদি আরবে অগ্নিকাণ্ডে নিহত রুবেলকে এখন লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে।

নিহত রুবেল হোসাইনের বাবা জফির উদ্দিন ছেলেকে হারিয়ে নিস্তব্ধ প্রায়। এই দুর্ঘটনা মানতেই পারছেন না তিনি। জানান, শুক্রবারই (১৪ জুলাই) তার মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন। তবে নিশ্চিত হতে পারেননি। শনিবার সকালে সেখানে থেকে ফোন করে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। রুবেলরা দুই ভাই, এক বোন। বৃদ্ধ বাবা রুবেলের পাঠানো টাকায় সংসার চালাতেন।

রুবেল হোসাইনস্বজনরা জানান, ছয়-সাত বছর আগে সৌদি আরবে যান রুবেল হোসাইন। সেখানে একটি সোফা কারখানায় তার সঙ্গে এলাকার আরও তিন জন চাকরি করতেন। বিদেশ থাকা অবস্থায় গত জানুয়ারিতে একই ইউনিয়নের ইব্রাহিম নগরের মঞ্জুর রহমানের মেয়ে মরিয়ম খাতুনের সঙ্গে বিয়ে হয় রুবেলের। দুই পরিবারের সম্মতিতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। এরপর থেকে কখনও বাবার বাড়ি, কখনও শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন মরিয়ম।

বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয়নি মরিয়ম খাতুনের। মোবাইলে ফোনে ভিডিও কলের মাধ্যমে একে অপরকে দেখেছেন তারা। মরিয়ম জানান, প্রতিদিনই একাধিকবার তাদের কথা হতো। ঘটনার দিন দুপুরে তাদের শেষ কথা হয়েছে। এরপর শুক্রবার রাতে সৌদি আরব থেকে রুবেলের এক সহকর্মী দুর্ঘটনার কথা জানিয়েছিলেন। পরের দিন শনিবার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন তারা।

তিনি আরও জানান, কিছু দিন আগে রুবেলের মা মারা যান। দেশের বাইরে থাকায় মাটিও দিতে পারেননি। এতে রুবেল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তিনি রুবেলকে বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দিতেন। শিগগিরই দেশে ফেরার কথা ছিল। কোম্পানি ছুটি দিলেই দেশে আসবেন বলে জানিয়েছিলেন।

মরিয়মের বাবা কৃষক মঞ্জুর রহমান বলেন, ‘ছেলেটা ভালো, এমন জানার পর না দেখেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম। মেয়ের ভালোর চিন্তা করে প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলাম। এখন ঘর-সংসার না করেই মেয়েটি স্বামীকে হারালো।’

রুবেলের বাবা জফির উদ্দিন বলেন, ‘ছেলে দেশে এলে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা আয়োজন করার কথা ছিল। আধাপাকা বাড়িটির পুরোটাই পাকা করার পরিকল্পনা ছিল। তবে তা আর হলো না।’

স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, ‘ছেলেটা গরিব। সংসারের অভাব দূর করার জন্য সৌদি আরবে গিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই চিরতরে চলে গেলো। মরিয়মের এখন কী হবে, তা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন।’

সৌদি আরবে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া নয় জনের মধ্যে চার জনেরই বাড়ি রাজশাহীর বাগমারায়। এরমধ্যে তিন জনের বাড়ি ঝিকড়া ইউনিয়নে। অন্যজনের যোগীপাড়া ইউনিয়নে। বাগমারা উপজেলার বারইপাড়া গ্রামের জমিরের ছেলে মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলামের পাসপোর্ট নম্বর: এ ই ৬৩২৬৮৪১; একই গ্রামের শাহাদত হোসেনের ছেলে আরিফের ইকামা নম্বর: ২৫৩৫১৭৬৩৩৯; ওই গ্রামের জফির উদ্দিনের ছেলে রুবেল হোসাইনের পাসপোর্ট নম্বর: বিসি ০২৩৭০৫৫; উপজেলার বড় মাধাইমুনির কাতিলা গ্রামের আনিসুর রহমানের ছেলে ফিরুজ আলী সরদারের পাসপোর্ট নম্বর ইই ০৫৮১২৭৪। তাদের মধ্যে সাজেদুল ইসলাম ও আরিফ চাচা-ভাতিজা। রুবেল তাদের প্রতিবেশী।

বাগমারা উপজেলার যোগীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘লাশগুলো যেন দ্রুত আসে, আর পরিবারগুলো যেন ক্ষতিপূরণ পায় সে ব্যাপারে আমরা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করি।’

বাগমারা উপজেলার শুভডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এই পরিবারগুলো খুবই দরিদ্র। দেশের বাইরে কাজ করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের ভাগ্য সহায় হয়নি।’

বাগমারা উপজেলার নির্বাহী অফিসার এএফএম আবু সুফিয়ান জানান, সৌদি আরবে মৃত্যুর ঘটনায় বাগমারা উপজেলার চার জন আছেন। পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। মরদেহ নিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে পরিবারগুলো।

এদিকে, খবর পাওয়ার পর রাজশাহী জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বাগমারা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুমন চৌধুরী এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রাজিব আল রানা নিহত শ্রমিকদের বাড়িতে যান। তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া ছাড়াও সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

সুমন চৌধুরী জানান, নিহতদের পরিবারপ্রতি প্রাথমিক সহযোগিতা হিসেবে ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও সহযোগিতা করা হবে। প্রত্যেক পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে।

এ ছাড়াও দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামিম আহমেদ শোকার্ত পরিবারের কাছে ছুটে যান। তিনি নিহতদের পরিবারকে সমবেদনা জানান এবং মরদেহ দ্রুত দেশে আনার ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

সৌদিতে বাগমারার চার জন নিহতের খবরে রবিবার (১৬ জুলাই) সকালে ওই চার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। এ সময় তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন। দ্রুত নিহতদের মরদেহ দেশে আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবেন বলেও আশ্বাস প্রদান করেন। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনাও জানান তিনি। পরে ব্যক্তিগতভাবে তাদের আর্থিক সহযোগিতা করেন তিনি।