সংরক্ষিত বনের পাশে চর দখল করে ইটভাটা!

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বাইনচটকি ফেরিঘাট এলাকায় সংরক্ষিত বনের পাশে বিষখালী নদীর চর দখল করে বাড়ানো হচ্ছে দুটি ইটভাটার পরিধি। এতে নদীর গতিপথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পলি পড়ে নদী ভরাট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জোয়ার-ভাটার স্রোত বাধা পেয়ে ফেরিঘাট এলাকায় বিষখালী নদীতে জেগে ওঠা চরের উত্তর পাশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। আবার দক্ষিণ পাশের চর দখল করে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে ইটভাটায়।

সংরক্ষিত এই বনের এক কিলোমিটারের মধ্যে দুটি ভাটা থাকায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।

ভাটা-সংশ্লিষ্ট স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রতিবছর সুকৌশলে ভাটার পরিধি বাড়ানো হয়। ইট পোড়ানোর মৌসুম ছাড়াও সারা বছর ভাটার ইটের টুকরা ফেলে নদীতে জেগে ওঠা চরে ভরাট করে ভাটার পরিধি বাড়াচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এতে নদীর জোয়ার-ভাটার স্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভাটার এক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। যেখানে রয়েছে হরিণের অবাধ বিচরণ। এসব প্রাণীও এখন আছে হুমকির মুখে।

কোন ক্ষমতার বলে বীরদর্পে এই ইটভাটা চালিয়ে যাচ্ছেন, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। তাদের অভিযাগ, ইটভাটাটির মালিক জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক কিসলু প্রভাবশালী হওয়ায় সব মহলকে ম্যানেজ করেই ভাটা পরিচালনা করছেন।

বরগুনা ২_1

১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত-২০০১) অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও জনবসতিপূর্ণ এলাকার তিন কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন এবং ইট পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বিষখালী নদীর চর দখল করে গড়ে ওঠা ইটভাটা দুটি স্থাপনে এই আইন মানা হয়নি। এতে বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকিতে পড়েছে। সেই সঙ্গে বনের হরিণসহ অন্যান্য প্রাণীর প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। ইটভাটা দুটির কারণে পাশের বাইনচটি গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পাথরঘাটা উপজেলা কাকচিড়া ইউনিয়নের বাইনচটকি ফেরিঘাট এলাকার বিষখালী নদীর চরে আরএসবি-০১ ও আরএসবি-২ নামের দুটি ইটভাটার অবস্থান। এই ভাটা দুটির পরিধি বাড়াতে একটি ভাটার পূর্বে ও দক্ষিণ পাশে বিষখালী নদীতে জেগে ওঠা চরে ইটের টুকরা ফেলে ভাটার পরিধি বাড়াচ্ছে। আরকেটি ভাটার উত্তর পাশে নদীতে মাটি ফেলে ছোট রিং বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দক্ষিণ পাশের চর থেকে মাটি কেটে ভাটায় ইট তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এ সময় ইটভাটার ব্যবস্থাপক পরিচয়ে মনির নামের এক ব্যক্তি এসে ছবি তুলতে নিষেধ করেন। পরে এই প্রতিবেদককে প্রতিবেদন না করার জন্য অনুরোধ করে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ সময় তার কাছে চর দখল করে ভাটা নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো সরকারি জমি নেই। রেকর্ডীয় সম্পত্তিতে ভাটা স্থাপন করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই বিষয়টি নিয়ে বাজারে (বরগুনা শহরে) গিয়ে আপনার সাথে কথা বলবো।’

বাইনচকি এলাকার বাসিন্দা আবদুল হক বলেন, ‘এই ইটভাটা প্রতিবছর নদীর তীর ভরাট করা হচ্ছে। যতটুকু চর জাগে, তা ভরাট করা হয়। এই ইটভাটা আইন মানছে না। ভাটার গন্ধে আমরা এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। তবু ভাটার মালিকদের ভয়ে আমরা কিছু বলতে পারি না।’

বরগুনা ৩_2

ভাটার মালিক আবদুর রাজ্জাক কিসলু বলেন, ‘নদীর জায়গা দখল করছি না। যে জায়গা ভরাট করা হচ্ছে, তা আমার রেকর্ড করা সম্পত্তি। অল্প জায়গায় হয়তো ইট ফেলা হচ্ছে। ব্যক্তিমালিকানা জমিতে আমি ভাটা করেছি। এখানে কোনও সরকারি জমি নাই। উপজেলা প্রশাসক আমাদের সীমানা নিধারণ করে দিয়েছে। আমরা তার মধ্যেই আছি।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বরিশাল বিভাগী সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, ‘নদীতীরের ভূমি বা ভরাট করা বেআইনি। এতে নদী স্বাভাবিক স্রোতধারা বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে নদীতে পলি জমে চর জেগে ওঠে। এভাবে ভাটার পরিধি বাড়িয়ে নদীর তীর ভরাট করা অপরাধ।’

বরগুনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষক মো. খালিদ হোসেন বলেন, কোনোভাবেই সংরক্ষিত বনের পাশে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। বনের পাশে ইটভাটা স্থাপন করা হলে বন ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি প্রাণিকুলের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। এতে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে

বরগুনা

এ বিষয়ে পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুফল চন্দ্র গোলদার বলেন, ‘ইটভাটার জন্য নদীর চর ভরাট করে দখল করার বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।