‘জলকেলি’ উৎসবে মেতে উঠেছে কক্সবাজারের রাখাইন পল্লী

Cox-Rakain Pic-05নানা আয়োজন ও ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির মধ্যদিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে চলছে তিন দিনব্যাপি রাখাইনদের মাহা সাংগ্রেং পোয়ে বা জলকেলি উৎসব। তরুণ-তরুণীদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর নাচে গানে রাখাইন সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ সামাজিক এই উৎসব পরিণত হয় অসাম্প্রসায়িক বাঙালির প্রাণের উৎসবে। এ কারণে রাখাইন বর্ষকে বিদায় ও বরণে ‘সাংগ্রেং পোয়ে’ বা জলকেলি উৎসবের আয়োজন করা হয় প্রতিবছর। রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজন, পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হয় রাখাইন পল্লী।

Cox-Rakain Pic-03রাখাইন পঞ্জিকা মতে ১৬ এপ্রিল শেষ হয়েছে রাখাইন বর্ষ ১৩৭৮ সাল। আর ১৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে নতুন ১৩৭৯ রাখাইন বর্ষ। কোনও ধর্মীয় রীতি নয়, সামাজিক রীতি মতে রাখাইন নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের রাখাইনরা একে-অপরকে পানি নিক্ষেপ করার খেলায় মেতে ওঠে এই দিনগুলোতে। এই উৎসব চলবে আগামীকাল ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত।

Cox-Rakain Pic-01রাখাইন তরুণ-তরুণীরা জানায়, সাংগ্রেং পোয়ে’র তিনদিনের এই উৎসবকে তাদের ভাষায় বলা হয় ‘মাহা সাংগ্রেং পোয়ে’। ওই দিন সকালে এলাকা ভিত্তিক শোভাযাত্রা বৌদ্ধ কিয়াং এ যাবে। এক ঘণ্টা বাদক বিশেষ ঘন্টা বাজিয়ে কিয়াং-সহ প্যান্ডেল পরিদর্শনের নিদের্শনা দেন। এই শোভাযাত্রায় তরুণরা মাটির তৈরি কলসি ও পেছনে বয়স্ক নারী-পুরুষ ‘কল্প তরু’ বহন করবে। কিয়াং থেকে শোভাযাত্রাটি প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়ায় আর পানি নিক্ষেপ খেলায় মেতে উঠবে। প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়ানো এসব তরুণদের নাচে গানে আনন্দের পাশাপাশি তাদের ঐতিহ্যবাহী পানীয় পান করবে। একে অপরকে পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে পুরাতন বছরের সকল পাপ, ক্লান্তি আর অসঙ্গতি মুছে-ধুয়ে নতুন বছরকে বরণ করতে তাদের এ আয়োজন।

Cox-Rakain Pic-04কক্সবাজার শহরের রাখাইন পল্লীর শিক্ষার্থী মং হ্লা ওয়ান, বাওয়ান, ক্যনাই, থেন থেন নাই, চ লাইন, জনি, জ জ, মংসিয়াই, ইয়ুদি, জওয়ান, আক্য, আবুরি, ওয়ানশে, কিংজ, হাপু ও ওয়াহ ওয়াহ জানান, আদিকাল থেকে রাখাইন নববর্ষ উপলক্ষে সামাজিকভাবে সাংগ্রে পোয়ে উৎসব পালন হয়ে আসছে। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। আনন্দ-উল্লাসে নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছে সবাই। এর মাধ্যমে আমরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটানোর মধ্য দিয়ে পুরনো দিনের সব ব্যথা, বেদনা, হিংসা বিদ্বেষ ভুলে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। এটি আমাদের কাছে খুবই পবিত্র ও উৎসবের দিন।

Cox-Rakain Pic-06কক্সবাজারের রাখাইন সম্প্রদায়ের নেতা ও ‘আরডিএফ’র সভাপতি অধ্যক্ষ ক্যথিং অং বলেন, ‘চৈত্র সংক্রান্তি থেকে রাখাইনদের বর্ষবরণ ‘সাংগ্রেং পোয়ে’ উৎসব শুরু হয়ে চলে প্রায় সপ্তাহ জুড়ে। উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব ‘পানি খেলা’ বা ‘জলকেলি’ বৈশাখের চতুর্থ দিন থেকে শুরু হয়। এবারের ‘সাংগ্রেং পোয়ে’ বা জলকেলি উৎসব চলবে ৪ বৈশাখ থেকে ৬ বৈশাখ পর্যন্ত। ইংরেজি তারিখের হিসেবে ১৭ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিল।’

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরোজুল হক টুটুল বলেন, রাখাইনদের জলকেলি উৎসব উপলক্ষে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবও মাঠে রয়েছে। কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

Cox-Rakain Pic-07উল্লেখ্য, কক্সবাজার শহর ছাড়াও মহেশখালী, টেকনাফ সদর, হ্নীলা চৌধুরী পাড়া, রামু, পানিরছড়া, চকরিয়ার মানিকপুরসহ রাখাইন অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সপ্তাহ জুড়ে নববর্ষ পালনে নানা অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে শহরের টেকপাড়া, হাঙরপাড়া, বার্মিজ স্কুল এলাকা, চাউল বাজার, পূর্ব-পশ্চিম মাছ বাজার, আরডিএফ প্রাঙ্গন, ক্যাং পাড়া ও বৈদ্যঘোনাস্থ থংরো পাড়ায় তৈরি করা হয়েছে জলকেলির ২০টি নান্দিক প্যান্ডেল। রঙিন ফুল আর নানা কারুকার্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্যান্ডেলের চারপাশ। সবার মাঝে এখন বর্ষ বরণের আমেজ। রাখাইন এলাকার প্রতিটি বাড়ি সেজেছে নতুন সাজে। ছোট শিশু থেকে শুরু করে বড়রাও ব্যস্ত নতুন কাপড়ে নিজেকে রঙিন করে তুলতে। উৎসবের মূল লক্ষ্য অতীতের সকল ব্যাথা-বেদনা, গ্লানি ভুলে ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

/বিএল/