‘বিশ্বাস ছিল কেউ ক্ষতি করবে না’

 

ভাগ্যলক্ষ্মী চাকমা

'বিহারে (বৌদ্ধ বিহার) কাজ শেষে ফিরেঘরেই ছিলাম। আমার ছেলে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ গোলোযোগের কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে উঠি। শুক্রবার সকাল ১০টা- সাড়ে ১০টার সময় দেখি পাশের বাড়িতে আগুন দিয়েছে। ভয়ে, জীবন বাঁচাতে আমরা ছোটাছুটি শুরু করি। দীর্ঘদিন ধরে এখানে বসবাস করছি। বিশ্বাস ছিল কেউ ক্ষতি করবে না।’ রাঙামাটির লংগদু উপজেলার টিনটিলা পাড়ার বাসিন্দা ভাগ্যলক্ষ্মী চাকমা বাংলা ট্রিবিউনকে এসব কথা বলেন। শুক্রবার দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে তার ঘরের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

ভাগ্যলক্ষ্মী চাকমা স্থানীয় পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চাকরি করেন। তার বড় মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুই ছেলের একজন স্বাস্থ্য সহকারী এবং আরেকজন খাদ্য অধিদফতরে চাকরি করেন। তার মেয়ে চিকিৎসার জন্য বর্তমানে ভারতে আছেন। ঘটনার দিন এক ছেলে খাদ্য বিভাগে তার অফিসে ছিলেন। ছোট ছেলেসহ বাড়িতে ছিলেন ভাগ্যলক্ষ্মী। তিনি জানান, দুর্বৃত্তরা ঘর থেকে বের করে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুনে তাদের চারজনের অফিসের কাগজপত্র, সার্টিফিকেট, ভাগ্যলক্ষ্মীর অফিসের ওষুধপত্র, সার্ভিস বুক, চেকবই, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার, ফার্নিচার সব নষ্ট হয়ে গেছে। কিছুদিন পরেই ভাগ্যলক্ষ্মী চাকরি থেকে অবসরে যাবেন। এই সময় আগুনে সব কাগজপত্রসহ ঘরের সবই হারালেন।  লংগদুতে জ্বালিয়ে দেওয়া ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তুপ

তিনি বলেন, ‘ঘরে যে স্বর্ণ ও টাকা পয়সা ছিল এখন ছাইয়ের মধ্যে সেগুলোই খুঁজছি। ঘরের খালি দেয়ালটাই আছে।’

বাংলা ট্রিবিউনকে এই নারী আরও জানান, টিনটিলা পাড়ার বেশির ভাগ বাড়িতেই সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করা হয়। ফলে আগুন দ্রুত ছড়ায় ও অনেক বিস্ফোরণ হয়।প্রমোদ চাকমা

একই পাড়ার বাসিন্দা প্রমোদ চাকমা। তিনি স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। প্রমোদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিহত যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম নয়ন আমার পরিচিত। আমরা একসঙ্গে ফুটবল খেলতাম। সে আমার সন্তানের মতোই। তার মৃত্যুর ঘটনায় আমিও দুঃখ পেয়েছি। পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে বলে গুজব ছড়াচ্ছিল। পাহাড়ে যে কোনও বাঙালি ও পাহাড়ির অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর প্রায়ই পরিস্থিতি থমথমে হয়ে ওঠে। তাই স্ত্রী ও দুই মেয়েকে বৃহস্পতিবার রাতেই নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেই। বৃদ্ধা মাকে নিয়ে আমি বাসায় ছিলাম।’লংগদুতে জ্বালিয়ে দেওয়া ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তুপ

তিনি বলেন, “শুক্রবার সকালে গোসল করতে যাচ্ছিলাম। এ সময় বাইরে চিৎকার শুনে বের হই। দেখি সামনেই মঙ্গল কান্তি চাকমার বাসায় আগুন দিয়েছে। এ সময় কিছু লোক আমার বাসায় এসে বের হয়ে যেতে বলে। তারা বাঙালি ছিল। তবে তাদের চিনি না। হুমকি দিয়ে তারা চলে যায়। এরপর সেনাবাহিনীর লোকেরা এসে বলে ‘আপনারা নিরাপদে থাকবেন, যেভাবে আছেন থাকেন।’ সেনাসদস্যরা চলে যাওয়ার পর আরেকদল যুবক ঘর থেকে বের করে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাসার নিচের ড্যাবা (দুই পাহাড়ের মাঝের খাদ) দিয়ে নেমে আরেক বাসায় চলে যাই। পরনে ছেড়া লুঙ্গিটা ছাড়া এখন আর কিছুই নেই। কাগজপত্র, কাপড়চোপড়, ফার্নিচার সবই পুড়ে ছাই। সারারাত আতঙ্কে ছিলাম আবার হামলা হয় কিনা।’ দুর্বৃত্তরা আগুন দেওয়ার আগে  পরিচিত এক বাঙালি এস সরে যেতে বলেছিলেন বলেও জানান প্রমোদ।লংগদুতে জ্বালিয়ে দেওয়া ঘরবাড়ি

স্থানীয় জনসংহতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিশঙ্কর চাকমা জানান,  টিনটিলা পাড়ায় ১৮০টি পরিবার বসবাস করে। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তার বাড়িতেও আগুন লাগানো হয়েছে। তিনি হামলাকারীদের চিনতে পেরেছেন। শিগগিরই মামলা করবেন।  

মনিশঙ্কর আরও জানান, পাশেই মানিকজোড় ছোড়ায় প্রায় ৭০ থেকে ৮০টি পরিবার ও দোকানপাটেও দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়েছে।

এদিকে শনিবার সকালে রাঙামাটির ডিসি মানজারুল মান্নান ও পুলিশ সুপার সাইদ তারিকুল হাসানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। বেলা সাড়ে ১১টায় উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে জরুরি আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক সভায়ও অংশ নেন তারা।লংগদুতে জ্বালিয়ে দেওয়া ঘরবাড়ি

উল্লেখ্য বৃহস্পতিবার (১ জুন) লংগদু উপজেলা থেকে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক ও স্থানীয় সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন দুই যাত্রী নিয়ে দীঘিনালার দিকে রওনা হন। দুপুরের পর দীঘিনালার চার মাইল এলাকায় তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে সন্ধ্যায় ফেসবুকে তার মৃতদেহের ছবি দেখে শনাক্ত করে পরিবার ও বন্ধুরা।

শুক্রবার সকালে নয়নের লাশ লংগদুতে তার গ্রামের বাড়ি বাইট্টাপাড়া আনা হয়। সেখান থেকে লংগদুবাসীর ব্যানারে কয়েক হাজার বাঙালির একটি শোকমিছিল উপজেলা সদরের দিকে যাচ্ছিল। এ সময় উপজেলার ঝর্ণাটিলা এলাকায় মারফত আলীর বাড়িতে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়। ওই সময় ওই মিছিল থেকেই প্রধান সড়কের পাশের লংগদু উপজেলা জনসংহতি সমিতির কার্যালয়সহ আশেপাশের পাহাড়িদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়।
এ ঘটনার পরপরই সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। পরবর্তী নির্দেশ দেওয়া না পর্যন্ত এ আদেশ বলবৎ থাকবে বলে জানানো হয়। এদিকে কোনও ধরনের নাশকতা এড়াতে বর্তমানে ঘটনাস্থলে বিপুল পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

/এফএস/ 

আরও পড়ুন- 

যুবলীগ নেতার মৃত্যুর ঘটনায় লংগদুতে পাহাড়িদের বাড়িঘরে আগুন