গত ১ জুন স্থানীয় এক যুবলীগ নেতার হত্যাকাণ্ডের জের ধরে পাহাড়িদের কয়েকটি পাড়ায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। লংগদু উপজেলা জনসংহতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনি শংকর চাকমা জানান, এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিনটিলা পাড়া। সেখানে প্রায় ১৮০টি পরিবার বসবাস করতো ও তাদের সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এছাড়া মানিকজোড় ছড়ায় ৭০ থেকে ৮০টি বাড়ি এবং বাইট্টপাড়ার কিছু দোকান ও বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী প্রায় তিন শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গত ৪ জুন রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুয়াজ্জেম হোসেন জানান, লংগদু উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ২১২টি পরিবারকে চিহ্নিত করেছে জেলা প্রশাসন। তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য লংগদুতে তিনটিলা বৌদ্ধ বিহারে একটি ও লংগদু সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আরেকটিসহ মোট দুটি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে যারা ফিরে আসছেন, তাদের অনেকেই আপাতত তিনটিলা বৌদ্ধ বিহারে আশ্রয় নিয়েছেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাইনি জোনের জুম কমান্ডার লে. কর্নেল আবদুল আলিম চৌধুরী জানান, দুটি পয়েন্টে খাদ্য বিরতণ করা হচ্ছে। যত দিন পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে লোক থাকবে ও পুনর্বাসন না হবে, ততদিন এখানে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে খাবার দেওয়া হবে। সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি রিজিওন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য সাত লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
তবে ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ কেউ সরকারি ত্রাণ নিচ্ছেন না বলে জানা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজনের দাবি, যতদিন পর্যন্ত তাদের পুনর্বাসন করা না হবে, ততদিন পর্যন্ত কোনও প্রকার সরকারি সাহায্য গ্রহণ করবেন না।ব্যক্তি উদ্যোগে ও পারিবারিক উদ্যোগে পাড়ায় পাড়ায় যে ত্রাণ বিতরণ চলছে তারা সেগুলোই নিচ্ছেন। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত কিরণ চাকমা বলেন, ‘আমাদের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যতদিন পর্যন্ত সেই পরিমাণ অর্থ দেওয়া অথবা পুনর্বাসন করা না হবে, ততদিন পর্যন্ত আমরা কোনও সরকারি সহায়তা গ্রহণ করবো না। আমরা চাই সঠিক পুনর্বাসন।’
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কলিন মিত্র চাকমা বলেন, ‘প্রশাসনের আশ্বাসে বাড়ি ফিরে আসার জন্য অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কেউ কেউ এসেছেন। তাদের মধ্যে অনেকের বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ায় ফিরে গেছেন বিহারে, কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে। অনেকেই দূরে চলে গেছেন। ফলে তারা কোথায় আছেন, সে খবরও পাচ্ছি না। পরিস্থিতি শান্ত হলেও লোকজনের আতঙ্ক এখনও কাটেনি।’
লংগদু থানার ওসি মোমিনুল ইসলাম জানান, পাহাড়িদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের পর যারা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তাদের ফিরে আসতে নিরাপত্তার স্বার্থে দুটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। একটি তিনটিলা পাড়ায় তিনটিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, আরেকটি বাইচ্চাপাড়ার আলতাফ মার্কেট এলাকায়।’
লংগদু সরকারি হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. নুরুল হুদা জানান, এ ঘটনায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে তিনটি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। একটি লংগদু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে, আরেকটি তিনটিলার বৌদ্ধ বিহারে। এছাড়া জরুরি প্রয়োজনে সেবা দিতে একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স রয়েছে।
অন্যদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের রিপোর্টের পরপরই ঘরবাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হবে।
উল্লেখ্য, গত ১ জুন বৃহস্পতিবার লংগদু উপজেলা থেকে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক ও স্থানীয় সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন দুজন যাত্রী নিয়ে দীঘিনালার দিকে রওনা হন। দুপুরের পর দীঘিনালার চার মাইল এলাকায় তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পরে সন্ধ্যায় ফেসবুকে তার মৃতদেহের ছবি দেখে শনাক্ত করে পরিবার ও বন্ধুরা। শুক্রবার সকালে নয়নের লাশ লংগদুতে তার গ্রামের বাড়ি বাইট্টাপাড়ায় আনা হয়। সেখান থেকে লংগদুবাসীর ব্যানারে কয়েক হাজার বাঙালির একটি বিশাল শোক মিছিল উপজেলা সদরের দিকে যাচ্ছিল। পথেই একই উপজেলার ঝরনাটিলা এলাকায় মারফত আলী নামে এক বাঙালির বাড়িতে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়েছে, এমন খবর পেয়ে ওই মিছিল থেকেই প্রধান সড়কের পাশের লংগদু উপজেলা জনসংহতি সমিতির কার্যালয়সহ আশেপাশের পাহাড়িদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে ২৫০টির বেশি বাড়ি ছাই হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি করা হলেও একদিন পরেই তা প্রত্যাহার করা হয়।
/বিএল/এফএস/এপিএইচ/
আরও পড়ুন-
লংগদুতে হামলা: এখনও শুরু হয়নি পাহাড়িদের ঘরবাড়ি নির্মাণ