সরেজমিনে তিনটিলা ও বাইট্টাপাড়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, অনেক পরিবার নিজ উদ্যোগে ত্রাণের টিনের সঙ্গে পোড়া টিন মিলিয়ে কোনোমতে ঘর তৈরি করছেন। এসব ঘরেই কোনও রকমে থাকা-খাওয়া ও রান্না-বান্নার কাজ চলছে।
তিনটিলা গ্রামের স্থানীয়রা জানান, লংগদুর ক্ষতিগ্রস্ত তিন গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে তিনটিলা গ্রামে। এই গ্রামের প্রায় সবাই সরকারি-বেসরকারি চাকরি করতেন। প্রতিটি বাড়িতে গত কয়েক বছর ধরে নতুন ঘর উঠেছে। তবে আগুনে সব শেষ। একের পর এক পোড়া ঘরের চিহ্ন এখনও স্পষ্ট দেখা যায়।
তিনটিলা গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত রেনু চাকমা পুড়ে নষ্ঠ হয়ে যাওয়া ভিটার পাশেই ছোট্ট একটি ঘর করেছেন। তিনি বলেন, ‘আত্মীয়ের বাড়ি ছিলাম। এভাবে পরের ঘরে আর কয়দিন থাকা যায়। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ থেকে এক বান্ডিল টিন ও উপজেলা প্রশাসন থেকে দুই বান্ডিল টিন দিয়েছিল। তা দিয়ে কোনও রকম ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার আমাদের ঘর বানিয়ে দেবে শুনেছি, কিন্তু কই? এতদিন হয়ে গেল কোনও খবরই পাচ্ছি না।’ রেনু চাকমা বলেন, ‘ঘর বানিয়ে দিলে কী হবে। ঘরের যেসব জিনিসপত্র ছিল, পুড়ে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন আর সেই টাকাও নাই, যে নতুন করে সব কিনবো। ’
তিনি বলেন, ‘আর সেই সময় আমাদের কৃষি জমিতে পাকা ধান ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে সেগুলো আর কাটতে পারলাম কই। পরে পানি আসায় সব ডুবে গেল। ঘরে এখন চালও নাই। আমার ছোট মেয়েটা এবার জেএসসি পরীক্ষা দেবে। কিন্তু তার জন্য প্রাইভেটের খরচ দিতে পারছি না। চুপ করে বসে থাকার চেয়ে জীবনযুদ্ধ নতুন করে শুরু করার চেষ্টায় আছি। সরকার যদি আমাদের রেশনের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে ভাতের চিন্তা করতে হতো না। সরকার আমাদের জন্য যা করবে, তাড়াতাড়ি করুক। আমরা খুব কষ্টে আছি।’
তিনটিলা গ্রামের আশি বছরের আরেক বয়স্ক খয়েন্দ্র চাকমা বলেন, ‘আগুনে আমার গরুর ঘরটার কোনও ক্ষতি হয়নি। তাই গরুর ঘরটায় আমরা থাকছি, আর গরুর জন্য পাশে আলাদা ঘর তৈরি করছি। এতদিন ছেলের বাসায় ছিলাম। গত শুক্রবার থেকে এখানে আছি। আপাতত আমরা তিনজন থাকছি। কষ্ট হয় তিনজন থাকতে। কী আর করবো। শুনেছি সরকার ঘর করে দেবে, কোনও তো খবরও পাচ্ছি না। সরকার তো আমাদের আর খবর নিচ্ছে না। কিভাবে বৃষ্টির মৌসুমে আমরা ছিলাম?’
তিনি আরও বলেন, ‘ছেলের বাসায় আর কয়দিন থাকবো। তাই চলে আসছি। সেখানে গরু রাখতে কষ্ট হয়। গরুর খাবারও পাওয়া যায় না। তাই এখানে আসছি সবজির ক্ষেত করবো। আর এখানে অনেক ঘাস, গরুরও খাবার হবে। নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করছি। আর যাতে এমন ঘটনা না ঘটে, সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। ’
বাইট্টাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মিথিলা চাকমা বলেন, ‘ঘটনার দিন জীবন নিয়ে কোনও মতে বেঁচে পালিয়েছি। প্রায় এক মাস পর বাড়িতে এসে এই ঘরটা তৈরি করি। আমার স্বামী কৃষি কাজ করে। এখানে-ওখানে থাকলে তো জীবন চলবে না। ঘরের ভেতর ধান ছিল সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। এখন ত্রাণের কিছু চাল আছে, তা দিয়ে চলছে। শেষ হলে কিভাবে খাবো তাও জানি না। ’
লংগদু সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কুলিন মিত্র চাকমা (আদু) বলেন, ‘আমরা রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরাসরি কথা বলেছি। আমরা বলেছি যত দ্রুত সম্ভব ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ি তৈরি করা যায় কিনা। কিভাবে সেটি করা যায়। সেই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি টেন্ডারে না দিয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে সেটি করা যায় কিনা, সেই বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সহযোগিতা কামনা করেছি। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।’
লংগদু উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোসাদ্দেক মেহ্দী ইমাম বলেন, ‘আমরা নকশা করে পাঠিয়েছি, নকশা অনুমোদন হলেই কাজ শুরু করা যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারে।’
উল্লেখ্য গত ১ জুন লংগদুর এক যুবলীগ নেতাকে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল থেকে লংগদু উপজেলা জনসংহতি সমিতির কার্যালয়সহ আশেপাশের পাহাড়িদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে আড়ইশয়েরও বেশি বাড়ি ছাই হয়ে যায় বলে জানান স্থানীয়রা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি করা হলেও একদিন পরেই তা প্রত্যাহার করা হয়।
আরও পড়ুন-
লংগদু অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১১ কোটি টাকা বরাদ্দ
ফিরে আসার উপায় নেই লংগদুর ধ্বংসস্তূপে