কুমিল্লায় মাঠ থেকে ধান কিনছে না কেউ

ধান কেটে বয়ে বাড়ি নিচ্ছেন কয়েকজন কৃষক (ছবি– প্রতিনিধি)

কুমিল্লায় এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে বাজারে ধানের দাম কম হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রান্তিক কৃষকরা বলছেন, এখন পর্যন্ত সরাসরি খাদ্য কর্মকর্তাদের কাছে একমুঠো ধানও বিক্রি করতে পারেননি তারা।

তবে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বলছেন, জেলার ১৭ উপজেলা থেকে ৪ হাজার ৯১৮ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের লক্ষমাত্রা রয়েছে তাদের। কৃষকদের নামের তালিকাও করা হচ্ছে। মাঠে গিয়ে প্রত্যেক প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করবেন তারা।

কুমিল্লা জেলা খাদ্য অধিদফতর জানায়, কৃষকদের লাভবান করতে সারাদেশ থেকে এবার ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে কুমিল্লার ১৭ উপজেলায় সরকারিভাবে ৪ হাজার ৯১৮ মেট্রিক টন ধান কেনা হবে।

স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন, তারা এখন পর্যন্ত সরকারের খাদ্য বিভাগের কাছে ধান বিক্রির সুযোগ পাননি। তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় বোরো ও আমনের বাম্পার ফলন হচ্ছে। অথচ প্রতিবছর কৃষকদের লোকসান গুনতে হয়। তবু বাপ-দাদার কৃষিকাজের পেশা বুকে আঁকড়ে রেখে মাঠে ফসল ফলাচ্ছেন তারা।

জেলার বিভিন্ন জায়গার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ কৃষক মাঠে নামেন ঋণের টাকায় নির্ভর করে। মাঠ থেকে ধান উঠিয়ে ঋণ পরিশোধের তাগিদে ধানের ক্রেতা খুঁজতে হয়। ক্রেতা হিসেবে পাওয়া যায় মিলারদের সিন্ডিকেট করে রাখা লোকজনকে। তারা প্রতিমণ ধানে কেনেন সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে।

কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন, সরকারি বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে বলা হচ্ছে, সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল কেনা হবে। অথচ এর সুফল জেলার কোনও কৃষক এখন পর্যন্ত পাননি।

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, বাগমারাসহ একাধিক এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অতিরিক্ত শ্রমিক মজুরি ও ধানের মূল্য কম হওয়ায় ক্ষোভে পাকা ধান কাটছেন না কৃষকরা। এখনও মাঠে ধান পড়ে আছে। তবে বড় কৃষক বা বিত্তশালীরা তাদের জমির ফসল ঘরে তুলছেন। প্রান্তিক ও অসহায় কৃষকদের কেউ কেউ খরচের ভয়ে সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত জমির ধান অন্যকেও দিয়ে দিচ্ছেন কেটে নেওয়ার জন্য।  

সরকারিভাবে কেজিপ্রতি ধানের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬ টাকা। কুমিল্লা জেলার ১৭ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদন করেন বুড়িচং ও লাকসামের কৃষকরা। আর সবচেয়ে কম ধান উৎপাদন হয় মেঘনা ও তিতাসে।

জেলার লালমাই উপজেলার বাগমারা পূর্ব নোয়াগাঁও এলাকার কৃষক শাহাজাহান জানান, তার আবাদ করা এক-তৃতীয়াংশ জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু অংশ জমির ধান এখনও মাঠে পড়ে আছে। অতিরিক্ত শ্রমিক মজুরির অভাবে ধান কাটতে পারছেন না তিনি। এবারের বোরো মৌসুমে তিনি যে পরিমাণ জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছেন, তার এক-তৃতীয়াংশ জমির ধান বাড়িতে তুলেছেন। সার, বীজ, পানি, শ্রমিক মজুরি ও অন্য খরচ এবং ধানের বর্তমান বাজারমূল্য অনুসারে তিনি প্রায় ৬০ হাজার টাকা লোকসানে আছেন।

হাটে বস্তায় বস্তায় রাখা হয়েছে ধান (ছবি– প্রতিনিধি)

কৃষক শাহাজাহান অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা কৃষকরা শরীরের ঘাম ঝরিয়ে চাষাবাদ করে ধান বাড়ি তুলি। কিন্তু কিছু সিন্ডিকেল ব্যবসায়ী এসে কম বাজারমূতা ধান নিয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘মাসের পর মাস তাদের পেছনে বিক্রি করা ধানের দাম আদায় করতে ঘুরতে হয়।’ 

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার কিং বামিশা এলাকার কৃষক হারুন মিয়া জানান, এবারের বোরো মৌসুমে তিনি যে পরিমাণ জমিতে ধানের চাষ করেছেন, তার অধিকাংশ ধান এখনও মাঠে রয়েছে। ধানের মূল্য ও ব্যয় অনুযায়ী তিনিও লোকসানে আছেন।

সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর বাজারের ধানের বেপারি আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ধানের বর্তমান বাজার অনুসারে ৫২০ দরে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনছি। ধানের মূল্য মিলাররা ঠিক করে থাকেন। তাদের সঙ্গে খাদ্য কর্মকর্তাদের সম্পর্ক ভালো থাকে। কারণ, মিলারদের কাছ থেকে গুদামে চাল সংগ্রহ করে জেলা খাদ্য অধিদফতর।’

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এস এম কায়সার আলী বলেন, ‘মিলারদের কাছ থেকে আমরা চাল ছাড়া ধান সংগ্রহ করি না। ধান শুধু জেলা কৃষি কর্মকর্তাদের তালিকা অনুসারে প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করি এবং করবো।’

তিনি বলেন, ‘এবার জেলার ১৭ উপজেলা থেকে ৪ হাজার ৯১৮ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করবো। প্রত্যেক উপজেলার কৃষকদের তালিকা করা হচ্ছে। তালিকার অনুসারে প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করবো।’