প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাইলেন মুজাক্কিরের মা-বাবা

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির হত্যার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় নোয়াখালী জেলা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান তারা।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, নিহতের বড় ভাই নূর উদ্দিন মুহাদ্দিস। তিনি বলেন, নিহত মুজাক্কির সাংবাদিকতা পেশার পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। অসুস্থ ও মূমূর্ষ রোগীদের পাশে দাঁড়াতেন। তিনি দুর্লভ এ- নেগেটিভ গ্রুপ রক্ত ২৬ জনকে দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। করোনাকালে নিজ এলাকার অসহায় ও গরীব মানুষের ঘরে ঘরে খাবার এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন। ঈদে দুস্থ ও এতিমদের গোপনে সহযোগিতা করতেন।

নূর উদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, গত শুক্রবার উপজেলার চাপরাশিরহাট পূর্ব বাজারে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষের সময় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন মুজাক্কির। এসময় আহত মুজাক্কির বাঁচার জন্য বার বার আকুতি জানালেও উপস্থিত স্থানীয় লোকজন, জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ সদস্যরা তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘসময় বাজারে পড়ে থাকার কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মুজাক্কির মারা যান। তবে, তারা আপ্রান চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেননি।

মুজাক্কিরকে আওযামী লীগ নেতারা কর্মী দাবি করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মুজাক্কির পড়া-লেখার পাশাপাশি সংবাদিকতা করতো। কিন্তু সে কোনও দল বা গ্রুপের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল না।

নিহতের পিতা মাওলানা নূরুল হুদা ওরফে মো. নোয়াব আলী মাস্টার বলেন, ঘটনার সময় তিনি বা তার পরিবারের কেউ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা দেখেননি। তবে যে বা যারা এ খুনের সঙ্গে জড়িত, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদের গ্রেফতারের দাবি জানান তিনি।

তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করে ফাঁসির দণ্ড দেওয়ার দাবি জানান।

নিহতের মা মমতাজ বেগম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার আদরের ছোট ছেলে মারা যাওয়ার পর, গতকাল (বুধবার) আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে একটি ভিডিও দেখেছিলাম। ভিডিওতে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি তাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে মারধর করছে। ওই হামলাকারী তাকে বলে ‘তোর কোন বাবা আছে?’, আমি ওই হামলাকারীকে গ্রেফতার করার জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ করছি।

তিনিও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

তবে, এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন নিহতের ভগ্নিপতি আবদুস সাত্তার।

আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর আগেও একবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির। গত ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরের মুজাক্কিরকে নির্যাতনের এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এখন ভাইরাল। ওই ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, হাসান ইমাম রাসেল নামের কোম্পানীগঞ্জের এক ব্যক্তি বসুরহাট বাজারের একটি দোকানে মুজাক্কিরকে মারধর করেন। এসময় মুজাক্কিরকে মারধর করতে করতে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে হাসান ইমাম রাসেল বলে, ‘বোলা, কারে বোলাবি বোলা, তোর কোন বাপ আছে বোলা, বোলাছ না, বোলা, কারে বোলাবি বোলা’। এ নির্যাতনের সময় সাংবাদিক মুজাক্কিরকে নির্যাতনকারী রাসেলের অপরসহযোগীর চলে যা চলে যা বলে কথার রেকর্ডও রয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর দেখা যায় মুজাক্কির ওই স্থান থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।

মুজাক্কিরকে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করে এ নির্যাতন করা হয় বলে আওয়ামী লীগের অনেকে দাবি করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে, হাসান ইমাম রাসেল মুঠোফোনে বলেন, মুজাক্কির আমাদের সঙ্গে কাজ করতো, তখন সে মাঝে মাঝে আসতো, নোয়াখালীতে পড়াশোনা করতো। কারো প্ররোচণায় পড়ে সে ফেসবুকে ফেক আইডি থেকে বাজে কমেন্ট করতো। তখন রনির দোকানে তাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন এসব করছে। সে বললো বাদল ভাইয়ের বিরোধিতা করেন সেজন্য আমি এমন করছি, তখন রাগ করে তাকে বকাঝকা করছি। আবার পাঁচ মিনিট পরই তাকে বুকে টেনে নিয়েছি। তিনি দাবি করেন মুজাক্কিরের মৃত্যুকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্ত (ওসি) মীর জাহিদুল হক রনি বলেন, মুজাক্কিরকে নির্যাতনের একটি ভিডিও ইতোমধ্যে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। ভিডিওটিতে দেখা গেছে উপজেলার কথিত সাংবাদিক রাসেল (হাসান ইমাম রাসেল) মুজাক্কিরকে গালমন্দ ও মারধর করছে। ওই দোকানটা বসুরহাট বাজারের অন্য একজন সাংবাদিকের। ওই সাংবাদিক আমাদের জানিয়েছেন মুজাক্কিরকে রাসেল মারধর করতে দেখে তিনি এসে বিষয়টি সমাধান করে দিয়েছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ভিডিওটি দেখছে, অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।

উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) উপজেলার চাপরাশিরহাট পূর্ব বাজারে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বাদলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশও কয়েক রাউন্ড টিয়ারসেল ও শটগানের গুলি ছুড়ে। ঘটনার ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে ত্রিমুখী সংঘর্ষের মুখে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক মুজাক্কির’সহ ৬-৭ জন। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় মুজাক্কিরকে প্রথমে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত শনিবার রাত ১০টা ৪৪ মিনিটে তার মৃত্যু হয়। মুজাক্কির অনলাইন নিউজ পোর্টাল বার্তা বাজারে জেলা প্রতিনিধি ছিলেন।


আরও পড়ুন:
কার গুলিতে লুটিয়ে পড়েন মুজাক্কির?
সাংবাদিক মুজাক্কিরকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলা
চাপরাশিরবাজারে পিবিআই, সাংবাদিক মুজাক্কির হত্যার তদন্ত শুরু
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আ. লীগের সব কার্যক্রম স্থগিত