পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি, অভিযান অভিযান খেলায় প্রশাসন

চট্টগ্রাম এলাকার বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় মানুষের বসবাস বাড়ছে। দুই বছর আগেও যেখানে মানুষের আনাগোনা ছিল না, সে সব এলাকায় এখান বসতি গড়ে উঠেছে। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ বসবাস হয়ে উঠতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ। বিপরীতে ঝুঁকিপূণ এই বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে প্রশাসনের নেই কোনও স্থায়ী উদ্যোগ। অভিযোগ রয়েছে, শুধুমাত্র অভিযান অভিযান খেলায় পড়ে রয়েছে প্রশাসন। প্রতি বছর বৃষ্টির আগে কেবল প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়। তবে স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকায় লোক দেখানো অভিযানের পরপরই পাহাড়ে পুনরায় ফিরে যান বসবাসকারীরা।

স্থানীয় পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরা বলছেন, প্রশাসনের উদাসীনতা, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের লেজুড়বৃত্তি, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করাসহ সমন্বিত উদ্যোগ না থাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী বাড়ছে।

অন্যদিকে প্রশাসন বলছে, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পাহাড় মালিকদের উদাসীনতা, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও রাজনৈতিক চাপের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরিয়ে নেওয়া ও পুনর্বাসনে সফলতা আসছে না। উল্টো আবাসনগত সব সুযোগ-সুবিধা থাকায় পাহাড়ে বসতি বাড়ছে।

রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে নিহত ১৩০

জানা যায়, গত দুই বছরে বায়েজিদ লিংক রোডকে কেন্দ্র করে ঘরে উঠছে বসতি। গত দুই বছরে সড়কটির দুই পাশে পাহাড়ে বসতি গড়ে তুলেছেন অন্তত ২০ হাজার পরিবার। এদের অধিকাংশই পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন। শুধু বায়েজিদ এলাকা নয়, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ে প্রতিনিয়ত গড়ে তোলা হচ্ছে বসতি। কয়েক বছর আগেও যেখানে চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষ বসবাস করতো, সেখানে এখন ফয়’স লেক সংলগ্ন উত্তর পাহাড়তলী ও খুলশী এলাকায় রেলওয়ের পাহাড়ে বসবাস করছেন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিগত তিন দশকে চট্টগ্রাম নগরীতে শতাধিক পাহাড় বিলীন হয়েছে। এসব পাহাড় কেটে আবাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। নগরীতে বর্তমানে কোনোভাবে ৮৬টি পাহাড় টিকে আছে। তবে এগুলোর অস্তিত্বও বিলীন হওয়ার পথে। এই ৮৬টি পাহাড়ের মধ্যে অক্ষত রয়েছে মাত্র ১৩টি। অবশিষ্ট ৭৩টি পাহাড় কেটে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার পাঁয়তারা চলছে। এই ৭৩টি পাহাড়ের মধ্যে ২২টি পাহাড়ের এক তৃতীয়াংশ এবং অপর ২৪টি পাহাড়ের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ কেটে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। অবশিষ্টগুলো নানাভাবে কেটে ফেলার কাজ চলছে। আর ৪৮টি পাহাড়ের উপরে-নিচে, আশপাশে ৯০৭ টি বস্তি গড়ে তোলা হয়েছে, যা অতি ঝুঁকিপূর্ণভাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীতে সরকারি ৬টি সংস্থার মালিকানাধীন পাহাড় রয়েছে সাতটি। অবৈধ দখলে থাকা এসব পাহাড়ের অধিকাংশ রেলওয়ের। অন্য পাহাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে, গণপূর্ত অধিদফতরের মালিকানাধীন আমবাগান এলাকার বাটালি হিলের পাহাড়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন টাইগার পাসের মোড়ে ইন্ট্রাকো সিএনজির পেছনের পাহাড়, লেকসিটি আবাসিক এলাকার পাহাড়, বিশ্ব কলোনী বড় পানির ট্যাংকির পাহাড় এবং ওয়াসার মতিঝর্ণা পাহাড়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নগরীর আকবর শাহ থানার ফয়’স লেকের পশ্চিম পাশে ঝিল ১, ২ ও ৩ নম্বর এলাকা, কনকর্ড এমিউজমেন্ট পার্কের ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের পাশে জিয়া নগর, মুজিবনগর ও মধ্যমনগর নামের বসতি এবং লেকের পাহাড়ের পেছনে শান্তিনগর ও লেকসিটি নামের এলাকা গড়ে উঠেছে। এসব পাহাড়ে কাঁচা, সেমিপাকা ও বহুতল পাকা ভবনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনাও আছে। মাটি কেটে কয়েক ধাপে উপরে-নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে এসব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।

অন্যদিকে পাহাড় কেটে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক করায় ওই সড়কটিকে ঘিরে নতুন করে ওই এলাকার পাহাড়ে বসতি বেড়েছে। গত দুই বছরে সড়কের দুই পাশে উঁচু উচু পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসতি গড়ে তুলেছেন কয়েক হাজার পরিবার।

অভিযোগ রয়েছে এসব এলাকায় রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে ঘর, বাড়ি ও বস্তি তৈরি করে এসব ঘর-বাড়ি কম টাকায় ভাড়া দেন প্রভাবশালীরা। সেই অবৈধ ঘরগুলোতে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ থাকায় নগরীর স্বল্প আয়ের মানুষেরা ওইসব ঘরে ভাড়া থাকছেন। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ বসবাস রোধ করতে না পারার কারণে দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল।

এরআগে, ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। ওই বছর বর্ষার শুরুতে চট্টগ্রাম নগরীর সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসে এই ১২৭ জন মারা যান। এরপরই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন, গঠন করা হয় বিভাগীয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে এই কমিটি কাজ করার কথা থাকলেও গত ১৫ বছরে উল্লেখযোগ্য কোনও ভূমিকা রাখতে পারেনি কমিটি। উল্টো তাদের চোখের সামনে দিনের পর দিন পাহাড়ে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি। ১৫ বছর আগে যেখানে ১০ থেকে ১৫ হাজার পরিবার ছিল সেখানে এখন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েক লাখ মানুষ।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোমিনুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এরপরও এটি রোধ করা যাচ্ছে না। জেলা প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করলে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীরা সরে যায়। কিছুদিন পর আবার তারা আগের মতো পাহাড়ে বসবাস শুরু করে। তাদের স্থায়ীভাবে সরিয়ে নিতে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। ইতোমধ্যে সিডিএ’র পক্ষ থেকে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সেটি বাস্তবায়ন করা হলে তখন আর কেউ পাহাড়ে বসবাস করতে পারবে না। সবাইকে স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়া হবে।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুর্গম পাহাড়ে যদি পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব সুযোগ-সুবিধা থাকে, তখন লোকজন অবশ্যই পাহাড়ে থাকতে চাইবে। যাদের পক্ষে বাসা ভাড়া নেওয়া সম্ভব না, তারা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও পাহাড়ে বসবাস করবে। যেইসব সংস্থা এইসব ইউটিলিটি প্রদান করে, তাদের জিজ্ঞাসা করেন-পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীরা কীভাবে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস লাইন পেয়েছে। এটি তারাই ভালো বলতে পারবে।