ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে শীত বাড়ার অপেক্ষা 

চট্টগ্রামে ঘরে ঘরে এখন ডেঙ্গু রোগী। প্রতিদিনই এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কয়েকশ’ লোক। সব বয়সীরাই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে শিশুদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম জুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ রোগ নিয়ে ব্যাপক আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘শীত বাড়লেই কমবে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার উপদ্রব।’ এদিকে মশার উপদ্রব বাড়লেও ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রমে সিটি করপোরেশনের উল্লেখযোগ্যহারে গতি বাড়েনি বলে দাবি নগরবাসীর। নগর জুড়ে মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ লোকজন।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি বছর (২২ নভেম্বর পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন চার হাজার ১৮৯ জন। আক্রান্তদের মধ্যে নগরীর তিন হাজার ১৩৯ জন ও বিভিন্ন উপজেলার এক হাজার ৫০ জন রোগী রয়েছেন। এরমধ্যে পুরুষ দুই হাজার ৭৪ জন, নারী এক হাজার ১০৩ জন ও শিশু এক হাজার ১২ জন।’

তিনি আরও বলেন, ‘জানুয়ারিতে ৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪ জন, মার্চে ১ জন, এপ্রিলে ৩ জন, জুনে ১৯ জন, জুলাইয়ে ৬৪ জন, আগস্টে ১১৪ জন, সেপ্টেম্বরে ৬০১ জন, অক্টোবরে এক হাজার ৮৬১ জন, নভেম্বরে এক হাজার ৪২৫ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। এদিকে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে কেউ মারা না গেলেও সেপ্টেম্বর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে সেপ্টেম্বরে ৩ জন, অক্টোবরে ১১ জন ও ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ১৭ জন। মারা যাওয়াদের মধ্যে ৯ জন পুরুষ, ১০ জন মহিলা ও ১২ জন শিশু রয়েছে।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বৃষ্টির মৌসুমে অর্থাৎ জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। আর তা সেপ্টেম্বরের দিকে কমে আসে। অন্যান্য বছরগুলোতে আমরা এমনটাই দেখে আসছি। তবে এ বছর নভেম্বর মাস চলে এসেছে। এরপরও ডেঙ্গুর দাপট কমছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘শীত বাড়লে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার দাপট কমবে। অর্থাৎ তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়ামের নিচে নামলে এডিস মশার উপদ্রব কমবে। একইভাবে বাতাসের আদ্রতা কমতে হবে ৮০ শতাংশের নিচে।’

ডা. মামুনুর রশিদ আরও বলেন, ‘ডেঙ্গুর লক্ষণের মধ্যে রয়েছে- জ্বর, শরীর ব্যাথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ দেখা যায়। এ রোগে আক্রান্তদের খাবারে রুচি কমে যায়। চিবিয়ে খেতে কষ্ট হয়। এ কারণে তরল বা পানি জাতীয় খাদ্য খেতে দিতে হয়। এ রোগে আক্রান্তদের মশারির ভেতর থাকতে হবে। তা না হলে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা বাসা তথা পাশের লোকও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন। প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি শুধুমাত্র প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে দিতে হবে।’

এদিকে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে ডেঙ্গু এবার আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এখনও রোগী কমছে না। এ রোগ নিয়ন্ত্রণে মশা নিধন করতে হবে। কাজটি সিটি করপোরেশনের। আমরা সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছি।’    

এদিকে সিটি করপোরেশনের মশার ওষুধ ছিটানো কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অধিকাংশ নগরবাসী। নগরীর বায়েজিদ এলাকার বাসিন্দা মো. আরিফ বলেন, ‘গত এক বছরেও আমার এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানোর কাজে নিয়োজিত স্প্রে-ম্যানদের দেখিনি। রাত-দিন সমানভাবে আছে মশার উপদ্রব। কয়েল জ্বালিয়েও কোনও কাজ হচ্ছে না। এলাকায় ঘরে ঘরে এখন ডেঙ্গু রোগী। শুধুমাত্র যাদের অবস্থা জটিল শুধুমাত্র তারাই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। অন্যরা ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন।’

চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা নওরিন জান্নাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ১৫ দিন আগে আমি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছি। আমার রক্তে প্লাটিলেট (অনুচক্রিকা) কমে গিয়েছিল। প্রচণ্ড মাথা ব্যথার পাশাপাশি শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সাতদিন হাসপাতালে থাকার পরও শরীর দুর্বলতার কারণে আরও অন্তত ১০ দিন ঘরে বেড রেস্টে থাকতে হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে খরচ হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘সিটি করপোরেশনের লোকজন মাসে-তিন মাসে একবার এসে স্প্রে করে।’

তবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা আবুল হাশেম দাবি করেছেন তাদের কর্মতৎপরতা বেড়েছে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা মশার ওষুধ স্প্রে কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছি। লিফলেট বিতরণ করছি এবং মাইকিং করে সচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রমও একই সঙ্গে চলমান আছে। পাশাপাশি বাসাবাড়িতে ছাদে কিংবা অন্য কোথাও এডিস মশার বাহক লার্ভা পাওয়া গেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হচ্ছে।’  

এদিকে চট্টগ্রামে ‘মসকুবার’ নামে মশার ওষুধ আবিষ্কার করেছে শ্যামল চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। তার আবিষ্কৃত আয়ুর্বেদিক মশার ওষুধ শতভাগ কার্যকর বলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। একই পরীক্ষায় সাধারণ মশার ওষুধের গুণগত মান এবং কার্যকারিত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

মশার ওষুধের আবিষ্কারক শ্যামল চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার তৈরি মশার ওষুধ মসকুবার শতভাগ কার্যকর এবং পরিবেশের জন্য কোন ক্ষতিকর নয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায়ও শতভাগ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও দেশের সিটি করপোরেশন তথা সংস্থাগুলো এ ওষুধ ব্যবহার করছে না। বরং পরীক্ষায় অকার্যকর তথা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে।’ এজন্য বর্তমানে দেশে যেসব মশার ওষুধ ব্যবহার করা হয় সেগুলো গুণগত পরীক্ষা করে যাচাই করার দাবি জানান তিনি।