ফাঁদপদ্ধতিতে সবজিতে বিপ্লব!

গ্রামের পথেপ্রান্তরে টাটকা গন্ধ। মাঠে মাঠে সবুজ সবজি। বাতাসে সবজির ম-ম গন্ধ। কৃষকরা মুখে হাসি নিয়ে সবজির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন। আর গ্রামের নববধূরা সবজি তোলা, সবজি রান্না দিয়েই দিনের শুরু করেন। এমন চিত্র কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার মুগুজি গ্রামে। অথচ বছর দুয়েক আগে বাম্পার ফলন আসার পরও কৃষকরা থাকতেন হতাশ।

ঐতিহ্যবাহী সবজির গ্রাম মুগুজি গ্রাম ঘুরে জানা যায়, দুই-তিন বছর আগেও এই গ্রামে কৃষিজমিতে সবজি ঠিকই ফলত কিন্তু কৃষকের হতাশা আর আর্তনাদ ভেসে বেড়াত মাঠে। কারণ বিভিন্ন পোকার আক্রমণ ও রোগে সবজি নষ্ট হয়ে যেত। বাবা-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে দিশেহারা হয়ে পড়েন কৃষকরা। এবার সবজি চাষে ব্যবহার করেছেন ফাঁদপদ্ধতি। এতে সবজি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটানোর পাশাপাশি সবজি বিদেশেও রফতানি করতে প্রস্তুত কৃষকরা। কেটেছে হতাশাও।

ফাঁদ ব্যবহারের আগের অবস্থান
আগে সবজি চাষের জন্য এই এলাকার কৃষকরা জমিতে ১০ বার কীটনাশক ও সার দিতেন। এতে খরচ বেড়ে হতো কয়েক গুণ। অবশেষে নষ্ট হয়ে যেত সবজি। এ ছাড়া দামও পেতেন না। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বিষয়টি কৃষকরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে জানান। পরে কৃষি কর্মকর্তারা মুগুজিসহ আশপাশের এলাকার সবজির মাঠ পরিদর্শন করেন। তারা কীটনাশকের পরিবর্তে পোকামাকড় মারার ফাঁদ ব্যবহারের পরামর্শ দেন।

ফাঁদ ব্যবহারের পরের অবস্থান
অফিসিয়ালি দুটি ফাঁদকে বলা হয় স্টিকি ট্র্যাপ ও সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ। একটি প্লাস্টিকের পটের মতো, অন্যটি কাগজের ওপর আঠাযুক্ত। এই দুই পদ্ধতির ফাঁদ ব্যবহারের পর থেকেই এলাকার কৃষিতে একরকম বিপ্লব শুরু হয়। আস্তে আস্তে মাঠে ভর ওঠে সবজি। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, আগের চেয়ে বিষমুক্ত ও সতেজ সবজি প্রচুর উৎপাদিত হওয়ায় এখন বিদেশে রফতানির প্রস্তাবও আসছে বলে জানান তারা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, যদি এই ফাঁদগুলোর ব্যবহার সঠিক ও সফলভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে শুধু বরুড়া নয়, সারা দেশে কৃষিতে নতুন মাত্রা আসবে।

যেভাবে কাজ করে ফাঁদ
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, সেক্স ফেরোমেন ফাঁদে প্লাস্টিক পাত্রের (পটের) মুখ থেকে সেক্স ফেরোমন টোপটি একটি সরু তার দিয়ে এমনভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যা পানি থেকে মাত্র ২-৩ সেন্টিমিটার ওপরে থাকে। সেই সেক্স ফেরোমনের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পুরুষ মাছি ও পোকা প্লাস্টিক পাত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ও সাবানপানিতে পড়ে আটকে পড়ে মারা যায়।

ইয়েলো স্টিকি ট্র্যাপ বা হলুদ ফাঁদ হচ্ছে পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব। সাদা মাছি ও শোষক পোকা হলুদ রঙে আকৃষ্ট হয় বেশি। এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে হলুদ আঠালো ফাঁদ পেতে ক্ষতিকর পোকাগুলোকে মারা হয়। সবজি চাষের প্রতি বিঘা জমিতে ২৫ থেকে ৩০টি হলুদ আঠালো ফাঁদ লাগালেই হয়। মূলত দুই ধরনের হলুদ আঠালো ফাঁদ পাওয়া যায়। একটি হলো হলুদ কাগজে স্টিকার লাগানো, আরেকটি হলো হলুদ পলিশিট, যাতে আঠা লাগানো থাকে।

বিদেশে রফতানি হবে সবজি
স্থানীয় কৃষক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, মুগুজি গ্রামের মাঠে নানা ধরনের সবজির চাষ হচ্ছে। তবে শুধু নিরাপদ শসা চাষ হচ্ছে ছয় কোটি টাকার। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এই গ্রামের শসা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেতে প্রস্তুত হবে। গেল বছর এই মাঠে সাড়ে চার কোটি টাকার শসা বিক্রি হয়। এবার কীটনাশকমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে চাষ করায় বেড়েছে শসা উৎপাদন, সঙ্গে বেড়েছে চাহিদাও।

কৃষকদের মুখে সবুজ হাসি
ফাঁদ ব্যবহারে খরচ কমে বেড়েছে উৎপাদন। দিগুণ সবজি পেয়ে আনন্দিত মুগুজি এলাকার কৃষকরাও। কৃষক মনির হোসেন বলেন, ‘বাবা-দাদারা সবজি করে কবরে গেছেন। আমরাও একই পথে আছি। এত খাটাখাটনি করে দিন শেষে আর কিছুই ঘরে আসত না। গত বছর আর এ বছর আশার আলো দেখছি। সারও দেওয়া লাগে না তেমন আর ফলনও ভালো। ১২ শতকে খরচ হয়েছে ৭০ হাজার। বিক্রি হবে দেড় লাখ টাকা। তবে সরাসরি বিদেশে রফতানি করতে পারলে আমাদের আয়ও বাড়ত। বিষমুক্ত শসার উৎপাদনে কৃষি অফিস আমাদের সব সহায়তা করছে। আশা করছি ভালো ফলন হবে।’

স্থানীয় কৃষক আমীর হোসেন বলেন, ‘২০ শতক জমিতে শসা চাষে আমার এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছি ৩ লাখ টাকা বিক্রি হবে। বিষমুক্ত উপায়ে চাষ করায় ক্রেতাদের চাহিদা বেড়ে গেছে। আগে ১০ বার সার আর ওষুধ দিতে হতো। এখন তা দিতে হয় না। গত বছরও এই ফাঁদ ব্যবহার করেছি। আগে শসাগুলোয় একধরনের পোকা কামড় দিলে সেগুলো বাঁকা হয়ে যেত। এখন আর তা হয় না। এই ফাঁদগুলো ব্যবহার করলে পোকমাকড় ফাঁদে আটকে মারা যায়। যে কারণে শসাও ফলনও বাড়ে। এতে ভালো দামও পাওয়া যায়।’

মুগুজি ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বরুড়ার খোশবাস ইউনিয়নের মুগুজি গ্রামে ২৫-৩০ বছর ধরে কৃষকরা শসা উৎপাদন করেন। এখানের ৫০০ কৃষককে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি ও শসা উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ফাঁদ ও যাবতীয় সহায়তা করা হয়। এখানের শসা স্থানীয় চাহিদা মেটানোর সঙ্গে বিদেশে রফতানি করা যাবে। আশা এই প্রযুক্তি কুমিল্লাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।

কুমিল্লা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মোহিত কুমার দে বলেন, নিরাপদ সবজি চাষ বিষয়টি এখানকার কৃষকরা প্রশংসনীয়ভাবে আত্মস্ত করেছেন। আমরা এই অগ্রগতি ধরে রাখবো। এটি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।

পরিচালক (সরেজমিন উইং) মো. তাজুল ইসলাম বলেন, দেশের ২০টি ইউনিয়নে নিরাপদ শসা চাষের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তার একটি বরুড়ার খোশবাস দক্ষিণ ইউনিয়ন। খরপোষ থেকে আমরা বাণিজ্যিক কৃষিতে এসেছি। কৃষি পণ্য বিদেশে রফতানির জন্য তাদের কিছু শর্ত থাকে। আমরা তা পূরণের চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে রফতানিকারকরা আসা শুরু করেছেন।