চিকিৎসক ও জনবল সংকটসহ নানা সমস্যার মধ্য দিয়েই চলছে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কার্যক্রম। ৯ জন ডাক্তারের মধ্য ৫ জন অন্য হাসপাতালে বদলি হয়ে চলে গেছেন। আরএমওসহ এখন আছেন মাত্র ৪ জন। ডাক্তার সংকটের কারণে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে হাসপাতালটির চিকিৎসা সেবা। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে সেবা নিতে এসে রোগীদের পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। চিকিৎসক সংকটের কারণে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এক্সরে মেশিন থাকলেও তার রিপোর্ট আসে ঝাপসা, আলট্রা মেশিনও নষ্ট এক বছর ধরে। অপরদিকে, উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ২৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকেও ডাক্তারসহ জনবল সংকট। এসব ক্লিনিকের ভবনগুলোর অবস্থা স্যাঁতসেঁতে এবং পরিবেশও ঝুঁকিপূর্ণ।
চলতি মার্চ মাসেই রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৫ জন মেডিক্যাল অফিসার-ডা. সৈয়দ জোবায়ের, ডা. আসিফ নজরুল, ডা. সাররীন সাবা, ডা. ফাহমিদা ফাইজা ও ডা. ইমরান হোসেন মঞ্জু অন্য হাসপাতালে বদলি হয়ে চলে যান। তার মধ্যে ইমরান হোসেন মঞ্জু গত চার মাস যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করলেও বেতন তুলছেন রায়পুর থেকে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে (১৩ মার্চ) নবাগত সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবু হাসান শাহীন রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এলে ডাক্তারসহ জনবল সংকটের বিষয়টি জানানো হয়। সোমবার বিকালে (১৭ মার্চ) ডাক্তার সংকটের বিষয়টি ‘ডক্টরস’ নামের ফেসবুক পেজে প্রচার করা হয়। এছাড়াও ৩২ জন নার্সের মধ্য আছেন ১৮ জন। তাদের মধ্যে আবার ৪ জন প্রশিক্ষণে এবং ৩ জন মাতৃকালীন ছুটিতে রয়েছেন।
২০২৪ সালের জুন মাসে হাসপাতালটির ভেতরেই চার জন ডাক্তার দিয়ে ৩০০ টাকা ভিজিটে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রাখা হলেও গত ৭ মাস ধরে তা বন্ধ রয়েছে।
২০১৫ সালের ১৩ জুলাই জুনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থো.) ডা. মো. মহিউদ্দিন এবং ১ সেপ্টেম্বর থেকে মেডিক্যাল অফিসার কাজী সামসুদ্দোহা কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। মহিউদ্দিন ২০১৫ সালে ৬ এপ্রিল অর্থোপেডিক চিকিৎসক হিসেবে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন। ২০১৪ সালে ২০ নভেম্বর মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন কাজী সামসুদ্দোহা। পরে পারিবারিক কারণ দেখিয়ে ছুটি নেন, এরপর থেকে তারা আর কর্মস্থলে ফেরেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রায়পুর উপজেলার প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসাস্থল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। উন্নত স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী এতো বছরেও দেওয়া হয়নি প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও জনবল। ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের যে চিকিৎসক ও জনবল থাকার কথা বর্তমানে তাও নেই এই হাসপাতালে। এতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা, কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন উপজেলার বাসিন্দারা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে ১০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন ২ জন। আরেকজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ থাকলেও তিনি সপ্তাহে মাত্র দুই দিন সময় দেন, বাকি চার দিন ডেপুটেশনে কাজ করেন লক্ষ্মীপুর সদর ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এতে করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সেবাপ্রতাশীরা।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তিরত কয়েকজন রোগীর স্বজন জানান, সরকারি এ হাসপাতালে সঠিক কোনও সেবাই পাওয়া যাচ্ছে না। রোগী নিয়ে পড়তে হচ্ছে নানা দুর্ভোগে। গাইনি, অর্থপেডিক, মেডিসিন ও সার্জারিসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না থাকায় কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। ডিজিটাল এক্সরে মেশিন নেই, নেই আলট্রাসোনোগ্রাম মেশিনও। দালালের মাধ্যমে তিনগুণ মূল্যে বাহিরের হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা করিয়ে আসতে হয়।
রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তি হয়েও তারা সময়মতো ডাক্তারের দেখা পান না। ডাক্তাররা তাদের ইচ্ছামতো আসেন এবং যান। টাকা না দিলে অনেক সময় সেবিকাদের খারাপ আচরণের মুখে পড়তে হয় বলেও অভিযোগ ভর্তিরত একাধিক রোগী-স্বজনদের।
এদিকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা চরবংশী গ্রামের মাহমুদা বেগম, চরকাছিয়া গ্রামের মাহেনুর ও রায়পুর পৌর শহরের কাঞ্চনপুর গ্রামের নাজমুন নাজারসহ কয়েকজন রোগীর অভিযোগ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কাঙ্ক্ষিত ৩ টাকার পরিবর্তে ৫ টাকায় টিকিট পাওয়া গেলেও নির্দিষ্ট কক্ষে ডাক্তারদের দেখা পান না তারা। পরে বিমুখ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। রয়েছে প্রয়োজনীয় ওষুধ না পেয়ে বাইরে থেকে বেশি দামে কেনার অভিযোগও।
রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র সেবিকা ইয়াসমিন জানান, ডাক্তার ও জনবল সংকটের কারণে ওয়ার্ডে রোগীদের সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল হলেও এখানে প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ জন রোগী ভর্তি থাকে।
রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বাহারুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিকিৎসক ও জনবল সংকটের কারণে হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও আন্তঃবিভাগের রোগীদের মানসম্মত সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চলতি মার্চ মাসে ৫ জন ডাক্তার বদলি হয়ে চলে গেছেন। বিষয়টি নবাগত সিভিলসার্জনসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ডাক্তার সংকট নিরসন হলে রোগীরা মানসম্মত চিকিৎসা পাবেন।’
লক্ষ্মীপুরের নবাগত সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবু হাসান শাহীন বলেন, ‘রায়পুরের ডাক্তারসহ জনবল সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’