চলন্ত বাসে ডাকাতি-সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

মহাসড়কে বাস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করে লুটপাট ও নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ডাকাতরা বাসটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আড়াই ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন সড়কে ঘোরালেও হাইওয়ে পুলিশ কিংবা থানা পুলিশের নজরে আসেনি। ফলে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন মহল ও বাস মালিকরা।

বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) সচেতন মহল, বাস মালিক ও যাত্রীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে পুলিশ এবং হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্ব-কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

টাঙ্গাইল শহরের বাসিন্দা কলেজশিক্ষক মো. আবু তাহের বলেন, ‘এর আগে কলেজশিক্ষার্থী রূপাকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করেছিল পরিবহন শ্রমিকরা। বাসেই তাকে হত্যার পর লাশ বনে ফেলে রেখে যায় তারা। একই ঘটনা ঘটেছে মঙ্গলবার রাতে। মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের টহল ও চেকপোস্ট না থাকায় একের পর এক ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে পুলিশের জোরালো কোনও পদক্ষেপ আমাদের চোখে পড়ছে না। ফলে যাত্রীদের উদ্বেগ বাড়ছে।’

টাঙ্গাইল শহরের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আগে মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের টহল ও চেকপোস্ট চোখে পড়তো। এখন টহল ও চেকপোস্ট কোথাও নেই। মহাসড়কের যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়। ফলে যাত্রী সেজে ডাকাতরা বাসে উঠে ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটায়। মহাসড়কে বাস থামিয়ে যাত্রী তুললেও হাইওয়ে পুলিশ পরিবহন চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। আবার অধিকাংশ ঘটনা পরিবহন শ্রমিকদের যোগসাজশে হচ্ছে। এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’

আরও পড়ুন: পথিমধ্যে বাসে উঠে ডাকাতি, লুটপাট শেষে নারী যাত্রীকে ধর্ষণ

ঈগল এক্সপ্রেসের পরিচালক সোলাইমান হক বলেন, ‘ডাকাতরা বাসটির চালকসহ যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাত-পা, মুখ ও চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর সবার টাকা-পয়সা ও মালামাল লুট করে নেয়। ঘটনার পর থেকে বাসের চালকসহ তিন স্টাফ পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আগে নিয়মিত মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট বসানো হতো। কিন্তু এখন চেকপোস্ট বসানো হচ্ছে না। সড়কে চেকপোস্ট থাকলে এমন ঘটনা ঘটতো না। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল হাইওয়ে পুলিশের।’

ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় রাজা মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সংস্থাটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যাত্রীবাহী বাসে এ ধরনের ঘটনা ন্যক্কারজনক। যাত্রীরা এমন ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিষয়টি উদ্বেগজনক। যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে সড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশি টহল ও চেকপোস্ট বসানো জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে।’

এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার (এসপি) সরকার মোহাম্মদ কায়সার বলেন, ‘বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান শুরু করে পুলিশ। রাতে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঘটনার মূলহোতাকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে যাত্রীদের তিনটি মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’

যাত্রীদের নিরাপত্তা ও উদ্বেগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবসময় সড়কে নিয়োজিত থাকে পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ। প্রয়োজনে সড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হবে।’

সড়কে চেকপোস্ট না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আতাউর রহমান বলেন, ‘মহাসড়কে চেকপোস্ট বসানো বন্ধ রয়েছে। কি কারণে চেকপোস্ট বসানো বন্ধ রয়েছে, তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন।’ 

তিনি বলেন, ‘সড়কে ডাকাতির ঘটনা বন্ধ করতে হলে মাঝপথে কিংবা পথিমধ্যে যাত্রী ওঠানামা বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি কাউন্টার থেকে যাত্রী ওঠানামা করলে ডাকাতি কিংবা এমন ঘটনা কমে যাবে।’

এর আগে মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেসের চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয় ডাকাতরা। আড়াই ঘণ্টা ডাকাতি ও নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ শেষে রাত সাড়ে ৩টার দিকে মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়ায় বালুর স্তূপে বাসটি উল্টে দিয়ে ডাকাত দল পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার ভোরে ঘটনার মূলহোতা ঝটিকা পরিবহনের চালক রাজা মিয়াকে গ্রেফতার করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

পুলিশ এবং ওই বাসের যাত্রীরা জানান, কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা বাসটি সিরাজগঞ্জ মহাসড়কের পাশে জনতা হোটেলে রাত সাড়ে ১১টার দিকে যাত্রীদের রাতের খাবারের জন্য যাত্রাবিরতি দেয়। যাত্রীদের খাওয়া-দাওয়া শেষে যাত্রা শুরু করে বাসটি। রাত ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়ের কাছাকাছি পৌঁছালে ১০-১২ জন যুবক যাত্রী সেজে বাসে ওঠে। 

আরও পড়ুন: বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় ‘মূলহোতা’ গ্রেফতার

বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড়ে পৌঁছালে রাত ১টার দিকে চালককে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয় ওই যুবকরা। বাসচালকের গলায় ছুরি ধরে তারা। যাত্রীদের হাত-পা ও মুখ বেঁধে টাকা, স্বর্ণালংকার এবং মোবাইল লুট করে নেয় তারা। এ সময় যাত্রীদের বারবার তল্লাশি করেছিল। তল্লাশির সময় এক নারী প্রতিবাদ করেন। এতে দুই যুবক ওই নারীকে মারধর করেন। আবারও ওই নারী প্রতিবাদ করেন। পরে পাঁচ-ছয় মিলে ওই নারীকে ধর্ষণ করে। 

বাসটি আড়াই ঘণ্টা ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের নাটিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন সড়কে ঘুরিয়েছে ডাকাতরা। পরে মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়ায় বালুর স্তূপে বাসটি উল্টে দিয়ে পালিয়ে যায় তারা। ওই সময় চালক-হেলপারও পালিয়ে যায়। 

তখন যাত্রীদের উদ্ধার করে স্থানীয়রা। সেই সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি। 

মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাজহারুল আমিন বলেন, ‘বাসটিতে ২৪-২৫ জন যাত্রী ছিলেন। এরমধ্যে ছয়-সাত জন নারী ছিলেন। বাসের সবাইকে জিম্মি করে সবকিছু লুট করেছে ডাকাতরা। ডাকাতিতে বাধা দেওয়ায় ওই নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় এক যাত্রী বাদী হয়ে মামলা করেছেন। টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ওই নারীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। জবানবন্দি দেওয়ার জন্য তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত অপর আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’