নাট্যচর্চার আঁতুড়ঘর এখন ধ্বংসস্তূপ 

মূল ভবনের ভেতরে ময়লার স্তূপ। মেঝেতে পানি জমে পরিণত হয়েছে ছোটখাটো পুকুর। বন্য গাছগাছালি ভবনের গা জড়িয়ে আছে। টিনের চালা ভেঙে দেখা যাচ্ছে আকাশ। পিলারের পলেস্তারা ভেঙে পড়ছে। মূল ফটকের সামনে দাঁড় করানো মরচেপড়া কয়েকটি গাড়ি। পুরো ভবনজুড়ে পোড়ার ক্ষতচিহ্ন। মুন্সীগঞ্জের নাট্যচর্চার আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত ‘গণসদন’ নাট্যমঞ্চের চিত্র এটি। একসময় নাট্যকর্মীদের পদচারণায় মুখরিত হতো শহরের মালপাড়ার এই নাট্যমঞ্চ। এই মিলনায়তনকে কেন্দ্র করেই জেলার সাংস্কৃতিক চর্চা বেগবান হয়েছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই মিলনায়তন এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। 

বর্তমানের গণসদন দেখলে কারোরই বোঝার উপায় নেই অতীতে এখানে নাটক হতো, মাসব্যাপী আয়োজন করা হতো নাট্য উৎসবের।

গণসদন মিলনায়তন হলের কাজ চলার সময় থেকেই নাটক মঞ্চায়িত হতে শুরু করে। ১৯৭৭ সাল থেকে সেখানে নাটক, নাট্যোৎসব করা হতো। ১৯৭৯ সালের ৭ জুলাই সেই সময়ের সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী অধ্যাপক এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ‘গণসদন’ নাট্যমঞ্চটি উদ্বোধন করেন। দীর্ঘদিন পর ১৯৯৭-৯৮ সালে আবার সংস্কার করা হয় হলটিকে। সে সময় মূল ভবনের দুইপাশ দিয়ে বারান্দা তৈরি করা হয়। নির্মাণ করা হয় মেকআপ রুম। জেলা শহরে একমাত্র নাট্যমঞ্চ হিসেবে গণসদন হলটি ব্যবহৃত হয়েছে ২০০২ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। এক রাতে অগ্নিকাণ্ডে হলটির বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যায়। এরপর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থাতেই পড়ে আছে নাট্যমঞ্চটি। বিভিন্ন সময় সংস্কারের আশ্বাস পেলেও কোনও কাজ হয়নি। 

অন্যদিকে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তন মঞ্চের অবস্থাও বেহাল। নাটক মঞ্চায়ন করার মতো পরিস্থিতি শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চেও নেই।

গণসদন মিলনায়তনের ভেতরে ময়লার স্তূপ

মুন্সীগঞ্জের নাট্যকর্মীরা বলছেন, মঞ্চের অভাবে জেলাটিতে ব্যাহত হচ্ছে নাট্যচর্চা। নাট্যকর্মীদের আধুনিক একটি মঞ্চের দাবি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন তারা।

নাট্যকর্মীরা বলছেন, জেলাটিতে শহরকেন্দ্রিক নাট্যচর্চার ইতিহাস দীর্ঘ বছরের। মুক্তিযুদ্ধের আগে শহরের জগধাত্রীপাড়া নাট মন্দির, সরকারি হরগঙ্গা কলেজের আশুতোষ হল ও দর্পণা সিনেমা হল, ছবিঘর সিনেমা হলে নাটক মঞ্চায়ন হতো। এ ছাড়া পাড়া-মহল্লায় অস্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ করেও নাটক মঞ্চায়ন হয়েছে সে সময়ে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুরু হয়। সে সময় প্রবাহ নাট্যগোষ্ঠী, অনিয়মিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এবং সৌখিন নাট্যচক্র এই তিনটি সংগঠন মূল ধারার নাট্যচর্চার পথপ্রদর্শক হিসেবে খ্যাত ছিল। পরবর্তীতে মুন্সীগঞ্জ থিয়েটার, থিয়েটার সার্কেল, সঞ্চালক নাট্যচর্চাকেন্দ্র ও হিরণ কিরণ থিয়েটার নাট্যচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।  

হিরণ কিরণ থিয়েটারের সভাপতি নাট্যকার জাহাঙ্গীর হোসেন ঢালী বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জে ৬২টি সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। এরমধ্যে দুই-তিনটি দলের কার্যক্রম চলছে। অন্যগুলোর কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো নয়।’

জেলার নাট্য সংগঠনগুলো সচল থাকলেও মঞ্চের অভাবে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। জেলা শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে নাটক মঞ্চায়ন করতে গেলে লাইট, সাউন্ড ভাড়া করে আনতে হয়। আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় নাটক মঞ্চায়ন করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে নাট্য দলগুলো।

জানা গেছে, বিশ্ব নাট্য দিবসের প্রবর্তন হয় ১৯৬১ সালে। ২৭ মার্চকে বিশ্ব নাট্য দিবস বা থিয়েটার দিবস বলা হয়। বাংলাদেশে এই দিবস পালন শুরু হয় ১৯৮২ সাল থেকে। 

পরিত্যক্ত গণসদন মিলনায়তন

থিয়েটার সার্কেলের সভাপতি নাট্যকার শিশির রহমান বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জে সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে ৬২টি, গ্রুপ ফেডারেশনভুক্ত আছে চারটি ও গ্রুপ ফেডারেশনের বাইরে আরও চারটি রয়েছে। থিয়েটার দিবসে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক, গান, গল্প, কবিতা, আবৃত্তি ও আলোচনা অনুষ্ঠান করা হয়। আমাদের এখানে পৃষ্ঠপোষক কম। একটি নাটক করতে যে পরিমাণ খরচ হয়, তা সংগ্রহ করা মুশকিল হয়ে পড়ে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা বিত্তবানরা যদি শিল্প-সংস্কৃতির দিকে নজর দেয় তাহলে আমরা আরও কিছু করতে পারবো। তবু সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে নাট্যচর্চা অব্যাহত রয়েছে। করোনার সময়ে নাট্যচর্চায় কিছুটা ভাটা পড়লেও তা কাটিয়ে উঠেছে নাট্য দলগুলো। ফিরেছে নিয়মিত নাট্যচর্চায়।’

মুন্সীগঞ্জ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুজন হায়দার জনি বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জে সাংস্কৃতিক ও নাট্যচর্চার গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। করোনাকালীন নাট্যচর্চায় কিছুটা ভাটা পড়লেও সেই সংকট কাটিয়ে উঠে এখন শতভাগ সচল নাট্য দলগুলো। পাশাপাশি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটভুক্ত ৬২টি সাংস্কৃতিক সংগঠনও নিয়মিত কাজ করছে। তবে একটি মঞ্চের অভাব আমাদের নাট্যচর্চা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।’

নাট্যমঞ্চ নির্মাণের ব্যাপারে জানতে চাইলে মুন্সীগঞ্জ জেলা কালচারাল কর্মকর্তা মোখলেছা হিলালী বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চসহ আরও কিছু মঞ্চ সংস্কার করার জন্য গণপূর্ত বিভাগকে বলা হয়েছে।’